ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এর প্রকৃত নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়। তবে, তিনি স্বাক্ষর করতেন ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা নামে। বিদ্যাসাগর উপাধিটি সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ নামের সাথে যুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে তাঁর লেখা গদ্য এবং সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডের বর্ণনা পড়ানো হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুরে ‘বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বিদ্যাসাগর সেতু তাঁর নামেই উৎসর্গীকৃত।
পরিচয়
অনেকেই তাকে শুধু গদ্যকার হিসেবে চিনলেও, তিনি সমাজ সংস্কার এবং বাংলা ভাষার লেখ্যরূপের সংস্কারেও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। বিদ্যাসাগরের পরিচয়-
- জন্ম তারিখঃ ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০
- জন্মস্থানঃ বীরসিংহ গ্রাম, হুগলি জেলা(ব্রিটিশ ভারত)। বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুর
- পিতাঃ ঠাকুরদাস বন্দোপাধ্যায় মাতাঃ ভগবতি দেবী
- ধর্মঃ হিন্দু
- দাম্পত্যসঙ্গীঃ দীনময়ী দেবী
- শিক্ষাঃ সংস্কৃত কলেজ
- আন্দোলনঃ বাংলার নবজাগরণ
- মৃত্যুঃ ২৯ জুলাই ১৮৯১
নারী শিক্ষায় অবদান ও শিক্ষা সংস্কার
তিনি হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তিনি তৈরি করেছিলেন যা পরে বেথুন কলেজ নামে নামকরণ করা হয়। এখানে মেয়েদের পড়াশোনার ব্যয়ভারও বহন করা হত। ১৮৫৪ সালে চার্লস উডের শিক্ষা সনদ অনুযায়ী গ্রামাঞ্চলে শিক্ষা সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
১৮৫৫ সালে তিনি প্রায় ২০ টি স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন(এগুলো সবই ছিল সরকারি খরচে)। এর বাইরে নিজ খরচেও তিনি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দক্ষিণবঙ্গের ৩৫ টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকাই প্রধান ছিল।
আমরা শুধু ঈশ্বরচন্দ্রের সাহিত্যবিষয়ক বইগুলো নিয়ে বেশী আলোচনা করি। ব্যাকরণ বিষয়ক বইগুলোর মধ্যে রয়েছে– ব্যাকরণ কৌমুদি, বর্ণপরিচয়, সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা, ঋজুপাঠ ইত্যাদি।
দক্ষিণী বিদ্যাসাগর কাকে বলা হয়?
ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নেয়া একজন সমাজ সংস্কারক কান্দুকুরি বীরসালিঙ্গম পানতুলুকে বলা হয় দক্ষণী বিদ্যাসাগর। দক্ষিণ ভারতে তার জন্ম, আর তিনি বিদ্যাসাগরের মতোই সমাজ সংস্কারে বিশ্বাসী ছিলেন, ছিলেন বিধবা বিবাহের কট্টর সমর্থক।
মহাদেব গোবিন্দ রানাডে নামের একজন রাজনীতিবিদ, বিচারক এবং সমাজ সংস্কারক তাকে দক্ষিণী বিদ্যাসাগর আখ্যা দিয়েছিলেন। পানতুলু ছিলেন জাতিভেদ, বাল্যবিবাহ, অস্পৃশ্যতা ইত্যাদির ঘোর বিরোধী একজন মানুষ।
বাংলা সাহিত্যে অবদান
বাংলা গদ্যের জনক হিসেবে পরিচিত ঈশ্বরচন্দ্র কিন্তু বাংলা গদ্যের প্রথম লেখক ছিলেন না। তবে তাঁর আগে যারা গদ্য লিখেছিলেন তাদের লেখা খুব একটা সুখপাঠ্য ছিল না। সেগুলো ছিল নীরস, অসংলগ্ন বাক্যসমন্বিত এবং গতিহীন। তাঁর অনুবাদ করা বইগুলোতেও তাঁর যোগ্যতার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়।যেমনঃ
শকুন্তলার অধরে নবপল্লবশোভার সম্পূর্ণ আবির্ভাব ; বাহুযুগল কোমল বিটপের বিচিত্র শোভায় বিভূষিত ; আর, নব যৌবন, বিকশিত কুসুমরাশির ন্যায়, সর্বাঙ্গ ব্যাপীয়া রহিয়াছে।
– (শকুন্তলা, প্রথম পরিচ্ছেদ)
শকুন্তলা pdf
অনেক পাঠক কালিদাস প্রণীত অভিজ্ঞানশকুন্তলম এর বাংলা অনুবাদ ‘শকুন্তলা’ এর pdf খুজে পাচ্ছেন না। তাদের জন্য এখানে লিংক দিয়ে দিচ্ছি। আপনারা চাইলে ডাউনলোড করে নিতে পারেন-
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের শকুন্তলা pdf
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদ্যাসাগর সম্পর্কে একটি কথা বলেছিলেন-
“বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যভাষার উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সুবিভক্ত, সুবিন্যস্ত, সুপরিচ্ছন্ন ও সুসংহত করিয়া তাহাকে সহজ গতি ও কর্মকুশলতা দান করিয়াছিলেন।”ফারসি শব্দবহুল বাংলা সাহিত্য বা, অশ্লীলতায় পূর্ণ সাহিত্যের যে চর্চা বাংলা দেশে সেই সময়ে চলতো তা থেকে তাঁর লেখাগুলো মুক্ত ছিল।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিদেশে থাকাকালীন সময়ে যখন অর্থকষ্টে পড়েছিলেন, তখন বিদ্যাসাগরকে তিনি চিঠি লেখেন। তিনি মাইকেলকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেন। কিছুদিন আগে জনপ্রিয় শিল্পী অনুপম রায় এই ব্যাপারটি নিয়ে একটি গান প্রকাশ করেছেন, শুনুন-
আরো শুনুন-
মৌলিক গ্রন্থঃ
অনেকে এই ধারণা করে বসে আছেন যে এই লোকটি সারাজীবন অনুবাদই করেছেন, মৌলিক কিছুই বোধহয় লেখেননি। তাদের হতাশ করার জন্য একটি লম্বা লিস্ট দিতে যাচ্ছি-
- সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৩)
- বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৫)
- বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার (প্রথম খন্ড ১৮৭১, ২য় খন্ড ১৮৭৩)
- অতি অল্প হইল (১৮৭৩)
- আবার অতি অল্প হইল (১৮৭৩)
- ব্রজবিলাস (১৮৮৪)
- রত্নপরীক্ষা (১৮৮৬)
- প্রভাবতী সম্ভাষণ (সম্ববত ১৮৬৩)
- জীবন-চরিত (১৮৯১ ;
- মরণোত্তর প্রকাশিত)শব্দমঞ্জরী (১৮৬৪)
- নিষ্কৃতিলাভপ্রয়াস (১৮৮৮)
- ভূগোল খগোল বর্ণনম্ (১৮৯১ ; মরণোত্তর প্রকাশিত)
বিধবা বিবাহ প্রচলনে বিদ্যাসাগরের অবদান
একাধিক বই লিখে, বিভিন্ন রকম প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যখন আইন পাশ করা হলো বিধবা বিবাহ চালু হলো তখনো সংশয় ছিলো বিয়ে দেবে কে? ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর শুধু আইন পাস করানোর উদ্যোগ নিয়ে ক্ষান্ত হন নি, প্রথম বিয়েটা তিনিই দিয়েছিলেন। সমাচার সুধাবর্ষণ পত্রিকায় তাঁর সমালোচনা বেরুলো-
“… সাজ গো বিধবাগণ, ফুটিয়াছে ফুল।
তোমাদের সৌভাগ্য, ঈশ্বর অনুকূল।”
চারিদিকে যখন নিন্দার ঝড় চলছে(অল্পবিস্তর প্রশংসাও আছে বটে) তখন, পাসকৃত আইনের বলে ঈশ্বরচন্দ্র বিয়ের আয়োজন করেছিলেন। ব্রহ্মানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ১০ বছর বয়সী বিধবা মেয়েকে(৪ বছরে বিয়ে এবং ৬ বছরে তিনি বিধবা হয়েছিলেন) জমকালো অনুষ্ঠান করে বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন, পাত্র ছিলেন শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন।
বিয়ের পরে বরকে পতিত ঘোষণা করা হয়, যিনি বিয়ে দিয়েছিলেন তাকে গুন্ডা দিয়ে মারানোর ব্যবস্থা করা হয়(অবশ্য বরের লাঠিয়াল তাকে রক্ষা করেন)। বিদ্যাসাগরের পুত্র নারায়ণ বন্দোপাধ্যায়ের সাথে তাঁর সম্পর্ক খুব একটা ভালো না থাকলেও তাঁর ছেলে বিধবা বিবাহ করে পিতার মুখ রক্ষা করেছিলেন।
অন্যান্য রচনা
ইংরেজী, সংস্কৃত এবং হিন্দি থেকে অনেকগুলো বই অনুবাদের মাধ্যমে এই লোকটি ভাষাজ্ঞানের সার্থক পরিণতি ঘটিয়েছিলেন। তাকে নিয়ে লেখা বইয়ের তালিকা দিতে গেলে বিরক্তি বাড়বে। কার সময় আছে এত সময় নিয়ে বকবকানি পড়ার।
বাংলা গদ্য বা, আধুনিক বাংলা গদ্যের জনক বলে পরিচিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আত্মজীবনীমূলক রচনার নাম ‘বিদ্যাসাগর চরিত’। শেক্সপিয়রের লেখা ‘Comedy of Errors’ এর বঙ্গানুবাদ ‘ভ্রান্তিবিলাস’। এই গল্পটি নিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। এই ছিলো ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সংক্ষিপ্ত জীবনী।
আরো পড়তে পারেন-
- হেনরি লুই ডিরোজিওর জীবনী
- বাংলা সাহিত্যের পঞ্চপান্ডব এবং পঞ্চকবি
- বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন
- বাংলা নববর্ষ প্রচলন
- বাংলা আর্টিকেল রাইটিং
তথ্যসূত্রঃ
চমৎকার। বেশ। অভিনন্দন ।
সুন্দর✨