সুলতান মাহমুদ গজনবী কি মাযহাব পরিবর্তন করেছিলেন —৩

0

সিরিজের সবগুলো লেখা-

সুলতান মাহমুদ গযনবীর হানাফী থেকে শাফে’ঈ হওয়ার কল্পকাহিনী —৩

 

(তৃতীয় পর্ব বোঝারর জন্য প্রথম ২ পর্ব পড়ে নেওয়া আবশ্যক)

 

১২. এই ঘটনা যদি সত্য হতো অর্থাৎ হানাফী মাযহাব যদি এতই ঠুনকো হতো যে দুই রাক’আত সালাত দেখেই সুলতান হানাফী মাযহাব ত্যাগ করেছেন, তাহলে এমন নজির পৃথিবীতে আরো অনেক থাকার কথা ছিলো। সকল সত্যসন্ধানী রাজা-বাদশা ও আলিম-উলামাগণ হানাফী মাযহাব ত্যাগ করে শাফে’ঈ হয়ে যেতেন। কারণ, তারা তো হানাফী মাযহাবের সালাত সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত ছিলেন। তাদের কাছে এ বিষয়টি গোপন ছিল না।

 

কিন্তু আমাদের জানামতে এমন নজির আর আর কারো ক্ষেত্রে ঘটেনি। তার মানে কি তারা হানাফী মাযহাবের সালাত সম্পর্কে জানতেন না?

 

১৩. এই ঘটনা যদি সুলতান মাহমুদের সত্য গ্রহণের উদাহরণ হয়ে থাকে, তাহলে অন্যান্য রাজা-বাদশা ও ওলামাগণ যারা এমনটি করেননি তাদের হুকুম কী হবে? এখন কি এই মিথ্যা কাহিনীর পক্ষপাতিত্বকারীরা তাদেরকে সত্য গ্রহণে অস্বীকারকারী হিসেবে জানবে? কারণ, ইতিহাস থেকে জানা যায় সকল রাজা-বাদশা হানাফী ছিলেন।

 

ভারত উপমহাদেশে হাদীস শাস্ত্রের অন্যতম পুরোধা শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলবী রহ. বলেন- “সকল শহরের আর সকল দেশের বাদশা ছিলো হানাফী। আর অধিকাংশ কাযী, শিক্ষক ও সাধারণ মানুষও ছিলো হানাফী”। [কালিমাতে তায়্যিবাত-১৭৭]

 

অতএব, এটি সত্য গ্রহণের উদাহরণও নয়। কারণ, এটি যদি সত্য গ্রহণের উদাহরণ হতো, তার মানে কি বাকিরা সত্য গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে?

 

১৪. এই ঘটনা যদি সত্যিও হয় তাহলেও হানাফী মাযহাবের কিছুই হবে না বরং সুলতান মাহমুদ গজনবীর শিশুসুলভ আচরণ প্রকাশ পাবে। কারণ, তিনি কোনো এক প্রতারকের খপ্পরে পড়ে (প্রতারণা পূর্ণ সালাত দেখেই) মাযহাব ত্যাগ করেছেন; অথচ বড় বড় ফকীহগণও হানাফী মাযহাব অনুযায়ীই চলে থাকেন। তারা কি হানাফী মাযহাবের সালাত সম্পর্কে জানতেন না? তারা কেন এত কিছু জানা সত্ত্বেও হানাফী মাযহাব ত্যাগ করা প্রয়োজন মনে করেননি? অতএব সুলতান মাহমুদ গযনবির কাজটি শিশুসুলভ আচরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি প্রতারকের প্রতারণা বুঝতে অক্ষম হয়েছেন।

 

 

📗 জাল ঘটনার ভিত্তিতে ইতিহাস বিকৃতি

 

ইতোমধ্যে আমরা প্রমাণ করে দিয়েছি যে কাহিনীটি সম্পূর্ণ বানোয়াট ও মিথ্যা। তো এমন একটি মিথ্যা ও কল্পকাহিনীর উপর ভিত্তি করে ইতিহাস বদলে যায় না। অথচ কোথাও কোথাও লেখা দেখেছি, সুলতান মাহমুদ গজনবী হানাফী- পরবর্তীতে শাফে’ঈ- যা সম্পূর্ণ অন্যায় ও ইতিহাস বিকৃতির শামিল। তার শাফে’ঈ হওয়ার ক্ষেত্রে এই কল্পকাহিনী ছাড়া দ্বিতীয় কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। আমি বুঝি না মানুষ ইতিহাস না জেনেও কেন কলম ধরে!

 

 

📗 এই কল্পকাহিনীর পিছনে রহস্য কী?

 

যেহেতু দেশে দেশে হানাফীদের দাপট ছিলো বেশি ও অবস্থান ছিল উঁচুতে। আর অধিকাংশ রাজা বাদশাহই হানাফী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। এই কারণে শাফে’ঈ ও অন্যান্য মাযহাবের সাধারণ মানুষের ভিতরে ব্যাপক অন্তর্জ্বালা ছিলো। কাজেই তারা এমনসব কল্পকাহিনী ও নোংরা প্রতারণার মাধ্যমে সুলতান মাহমুদ গজনবীকে শাফে’ঈ বানানো ও হানাফীদেরকে তুচ্ছ করার বৃথা চেষ্টা করেছে। যদি তাদের ভাগ্যে একজন সুলতান জুটে যায় এই আশায় আর কি!

 

আর যদি গায়ের জোরে ঘটনাটিকে সত্যও বলা হয়, তবুও এই ঘটনার মাধ্যমে হানাফীদের বিরুদ্ধে শাফে’ঈদের নোংরামো ও প্রতারণা সুস্পষ্ট। আর এই নোংরামো ও প্রতারণাটাও হানাফীদেরকে পঁচানোর জন্য। হে শাফে’ঈ বন্ধুগণ, হানাফীদের মতো ফিকহী গবেষণা করলে এমন লজ্জাজনক নোংরামি ও প্রতারণা করতে হতো না।

 

📗 উপসংহার —১

 

অবশেষে একটা কথাই বলবো- ইতিহাসে এমন বহু আজগুবি কল্পকাহিনী প্রচলিত রয়েছে- যা বিদ্বেষীরা হানাফীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। তারা ফিকহী যোগ্যতায় বহু পেছনে থাকলেও ইতিহাস ও রিজাল শাস্ত্রের নাম দিয়ে হানাফিদের বিরুদ্ধে অনেক ষড়যন্ত্রই করেছে। বেছে বেছে হানাফী উলামাদেরকে য’ঈফ সাব্যস্ত করেছে।

 

হানাফীদের মধ্যে এমন বহু রাবী এমন রয়েছে যাদেরকে কেবল ইমাম আবূ হানিফার অনুসারী হওয়ার কারণে য’ঈফ সাব্যস্ত করা হয়েছে। আহমদ বিন হাম্বল তো ইমাম আবু ইউসুফের হাদীস গ্ৰহণ না করার কেবল একটা কারণই বলেছে। সেটা হচ্ছে, তিনি ইমাম আবু হানীফার সাথী।

 

বুঝেন তাহলে অবস্থা। আর কোনোই কারণ নেই, কেবল একটা মাত্র কারণ, তিনি ইমাম আবু হানীফার সাথী। ইমাম আবু হানীফার সাথিদের প্রতি যাদের এতো এলার্জি, খোদ ইমাম আবু হানিফার প্রতি তাদের কতো এলার্জি হবে ভেবে দেখুন। অথচ কিছু সত্যবিমুখের দল প্রতিনিয়ত ঐ সমস্ত হিংসুক ইমামদের ক্বওল উলামায়ে আহনাফের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে থাকে।

 

হানাফিদের বিরুদ্ধে তাদের হিংসার লেভেলটা কতো তা বুঝতে সে সময়ের কথাটা কল্পনা করুন, যখন শাফে’ঈ ফকীহ আবু বকর আল-ক্বাফফাল তাশাহহুদ পড়ে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে উচ্চস্বরে বায়ু নিঃসরণ করেছে। আমার বিবেক মতে কোন সুস্থ মস্তিষ্কের লোক এমন কাজ করতে পারে না।

 

📗 উপসংহার —২

 

এই ঘটনাটি যদি সত্য হয় তাহলে অনেকের উপর নানা ধরনের অভিযোগ উত্থাপন হয়। যা আমরা ইতিপূর্বে বিস্তারিত আলোচনা করেছি‌। কিন্তু, আমরা কারো উপর অভিযোগের আঙ্গুল তুলতে চাই না। বরং এই ঘটনার ক্ষেত্রে আমাদের এবং সত্যসন্ধানীদের সবচেয়ে নিরাপদ অবস্থান হলো, এ ঘটনাটা সম্পূর্ণ কল্পকাহিনী বা রূপকথা।

 

সাধারণত রাজা বাদশার ক্ষেত্রে এমন বহু রূপকথা এমনিতেই প্রচলিত থাকে। তাছাড়া রূপকথাতেই এমন অদ্ভুত বিষয় থাকে যা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়। আর রূপকথা হিসেবে ধরে নিলেই লেখক জুয়াইনা’ঈ রহ, সুলতান মাহমুদ, শাফে’ঈ ফকীহ ক্বাফফাল, হানাফী ফকীহ ও অন্যান্য হানাফি রাজা বাদশা সকলেই বিভিন্ন অভিযোগ থেকে মুক্তি পাবে। নয়তো তারা সবাই বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত হতে বাধ্য। অতএব আমরা এটাই বলবো বরং এটা সঠিক যে এ ঘটনাটি সম্পূর্ণ রূপকথা।

 

লুবাব হাসান সাফওয়ান


Screenshot 3
বিজ্ঞাপনঃ বই কিনুন, বই পড়ুন

0

লুবাব হাসান সাফ‌ওয়ান

Author: লুবাব হাসান সাফ‌ওয়ান

লুবাব হাসান সাফ‌ওয়ান। ঠিকানা: নোয়াখালী। কর্ম: ছাত্র। পড়াশোনা: আল-ইফতা ওয়াল হাদীস [চলমান] প্রতিষ্ঠান: মাদরাসাতু ফায়দ্বিল 'উলূম নোয়াখালী।

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

কবিতা আল কোরআনের প্রতীক আফছানা খানম অথৈ

আল কোরআনের প্রতীক আফছানা খানম অথৈ মা আমেনার গর্ভেতে জন্ম নিলো এক মহামানবের, নাম হলো তার মুহাম্মদ রাসুল আসলো ভবের

ফোরাত নদীতে স্বর্নের পাহাড় আফছানা খানম অথৈ

ফোরাত নদীতে স্বর্নের পাহাড় আফছানা খানম অথৈ ইমাম মাহাদী (আ:) আগমনের পূর্বে ফোরাত নদীর তীরে স্বর্নের পাহাড় ভেসে উঠা কেয়ামতের

কবিতা দাজ্জাল আফছানা খানম অথৈ

দাজ্জাল আফছানা খানম অথৈ কেয়ামতের পূর্বে দাজ্জাল আসবে নিজেকে খোদা বলে দাবি করবে, কাফের মুনাফিক যাবে তার দলে ঈমানদার মুমিন

গল্প হযরত মুহাম্মদ (সা:) জীবনের গল্প আফছানা খানম অথৈ

জন্ম:হযরত মুহাম্মদ (সা:) বর্তমান সৌদি আরবে অবস্থিত মক্কা নগরীর কুরাইশ গোত্রে বনি হাশিম বংশে ৫৭০ খৃষ্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন।তার পিতার

One Reply to “সুলতান মাহমুদ গজনবী কি মাযহাব পরিবর্তন করেছিলেন —৩”

Leave a Reply