তাকলীদ সম্পর্কে কিছু আপত্তি ও জবাব

1

তাকলীদ সম্পর্কে কিছু আপত্তি ও জবাব

 

📒 আপত্তি —১

 

তাকী উসমানি দেওবন্দী লিখেছেন- “এমনকি তার (মুকাল্লিদের) দৃষ্টিতে মুজতাহিদের কোন সিদ্ধান্ত হাদীস বিশেষের পরিপন্থী মনে হলেও চক্ষু বুঝে তাকে (মুকাল্লিদকে) মেনে নিতে হবে। [মাযহাব কী ও কেন: ৭২]

 

📗 ১ম জবাব

 

এটি একদম সঠিক কথা। কারণ সাধারণ মুকাল্লিদ (জনগণ) তো হাদীস সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না। হাদীসটা জাল নাকি জয়ীফ নাকি! আম নাকি খাস! আমলযোগ্য নাকি আমলযোগ্য নয়। মুযতারাব নাকি মুনকার, শায নাকি মারদূদ নাকি মানসূখ!

 

📗 ২য় জবাব

 

বলা হয়েছে, মুকাল্লিদের দৃষ্টিতে হাদীস বিশেষের পরিপন্থী মনে হলেও। অতএব, মুকাল্লিদের দৃষ্টিতে কোনো আমল বাহ্যিকভাবে হাদীসপরিপন্থী মনে হলেও সমস্যা নাই। কারণ, বাস্তবিক পক্ষে অর্থাৎ শরীয়তের দৃষ্টিতে তো আমলটি হাদীসপরিপন্থী নয়।

 

📗 ৩য় জবাব

 

যে হাদীসটা তার সামনে এসেছে সেটা হতে পারে আমলযোগ্য নয়, মুকাল্লিদ তা জানে না। কিন্তু মুকাল্লিদ যদি মাযহাবের আমলটি এই আমল-অযোগ্য হাদীসের বিপরীতে দেখে হাদীসের আমলটাই গ্রহণ করে নেয় তবে সেটা মূর্খতা হবে। কারণ, তার তো আর জানা নেই যে, অনেকগুলো কারণে হাদীসটি আমলের উপযুক্ত নয়। যার কারণে মুজতাহিদ ইমাম হাদীসটিকে গ্রহণ করেননি।

 

মোটকথা: এখানে মুকাল্লিদের দৃষ্টিতে হাদীসপরিপন্থী হওয়ার কথা বলা হয়েছে, বাস্তবিক পক্ষে হাদীসপরিপন্থী হওয়ার কথা বলা হয়নি।

 

📗 ৪র্থ জবাব

 

একটি উদাহরণ দিই— হানাফী মাযহাবের মাসআলা হচ্ছে আগুনে পাকানো খাদ্য খেলে ওযু ভঙ্গ হয় না, এটি কেবল হানাফী মাজহাবের মাসআলা নয় বরং লা-মাযহাবীসহ অন্যান্য মাযহাবের মাসআলাও হচ্ছে এটি।

 

কিন্তু হাদীসে স্পষ্ট এসেছে যে, আগুনে পাকানো খাদ্য খেলে ওযু ভঙ্গ হয়ে যায়।

 

سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ ‏ “‏ الْوُضُوءُ مِمَّا مَسَّتِ النَّارُ

 

যায়দ ইবনু সাবিত রাযি. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, আগুনে পাকানো খাবার খেয়ে ওযু করতে হবে। মুসলিম, হাদীস নং: ৬৭৪

 

এখন মুকাল্লিদ যদি এই হাদীসটা পেয়েই মনে করে যে হানাফী মাযহাবের এই মাসআলাটা হাদীসপরিপন্থী, তাই সে আগুনে পাকানো খাদ্য খেলে ওযু ভেঙ্গে যায়— এই হাদীসের উপর আমল করা শুরু করে, তখন কেমন হবে বলুন তো।

 

বাহ্যত দেখা যাচ্ছে, হানাফী মাযহাবের এই মাসআলাটা সত্যিই হাদীসপরিপন্থী কিন্তু বাস্তবতার দৃষ্টিতে দেখলে দেখা যায় যে বরং হানাফী মাযহাবের মাসআলাটাই হচ্ছে হাদীস অনুযায়ী।

 

অতএব সঙ্গত কারণেই, কোনো একটি হাদীস দেখলেই, মাযহাবের মাসআলাটা হাদীসপরিপন্থী মনে করে হুমড়ি খেয়ে তা গ্রহণ করার অনুমতি নেই।

 

যদি এই অনুমতি থাকে তবে তো উপরোক্ত হাদীসটিও গ্রহণ করতে হবে। কারণ, হানাফী মাযহাবের মাসআলাটা এই হাদীসের পরিপন্থী। অথচ লা-মাযহাবীরাও এই হাদীসটা গ্রহণ করে না।

 

📒 আপত্তি —২

 

শাইখ আহমাদ সারহিন্দী লিখেছেন- “মুকাল্লিদের জন্য প্রযোজ্য নয় যে, মুজতাহিদের রায়ের বিপরীতে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে বিধানাবলী গ্রহণ করবে এবং তার উপর আমল করবে।” [মাকতূবাতে ইমামে রববানী, নির্ভরযোগ্য উর্দূ অনুবাদ, ১/৬০১ পত্র নং ২৮৬]

 

📗 ১ম জবাব

 

কথা একদম সঠিক। কারণ, সে কুরআন হাদীস থেকে বিধানবলি গ্রহণ করার যোগ্যতাই রাখে না। যদি সে সরাসরি কুরআন হাদিস থেকে বিধান গ্রহণ করতে পারতো তবে সে নিজেই মুজতাহিদ হতো। মুকাল্লিদ হওয়ার দরকার থাকতো না।

 

📗 ২য় জবাব

 

যদি সবাইকে কুরআন হাদীস থেকে সরাসরি বিধান গ্রহণ করার সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে তো সবাই নিজে নিজে কুরআন হাদীস থেকে মনমতো বিধান গ্রহণ করবে এবং ভুল ভ্রান্তিতে নিপতিত হবে। এবং উপরিউক্ত হাদীসটি গ্রহণ করে বসে থাকবে। অথচ উক্ত হাদিস গ্রহণ করা যাবে না।

 

📒 আপত্তি —৩

 

নাসিরুদ্দীন চাঁদপুরী দেওবন্দী লিখছেন- “ইমাম মুজতাহিদের কথার খিলাফ কোন হাদীস পেলে একজন সাধারণ ‘আলিমের জন্যও ইমামের রায় ছেড়ে হাদীসের উপর ‘আমাল কর জায়েয নয়।” [ইমাম মানব কেন: ৪০]

 

📗 ১ম জবাব

কথা একদম সঠিক। কারণ হাদীস পেলেই তো হবে না, হাদীসটা কি আমলযোগ্য নাকি আমলযোগ্য নয় তাও তো জানতে হবে। খাবার দেখেই খাওয়া শুরু করলে তো হবে না, খাবারটা আসলে খাওয়ার উপযুক্ত কিনা তাও তো যাচাই-বাছাই করে দেখতে হবে। আর কোনো হাদীস আমলযোগ্য আর কোন হাদীস আমলযোগ্য নয় তা ইমামগণ ভালোই বুঝতেন।

 

📗 ২য় জবাব

 

যদি এক্ষেত্রে উক্ত বক্তব্য গ্রহণ না করে লা-মাযহাব বন্ধুদদের কথা অনুযায়ী হাদীস গ্রহণ করি, তাহলে প্রশ্ন, কেউ “আগুনে পাকানো খাবার খেলে ওযু করতে হয়” এই হাদীসটি ইমামের কথার খিলাফ পেয়েছে, এখন এই হাদীসটি আমল করতে পারব তো? যদি আমল করতে না পারে তাহলে সে ইমামের কথা মানতে গিয়ে হাদীস অস্বীকার করলো না তো!

 

📗 ৩য় জবাব

 

প্রথম আপত্তির জবাবগুলো দ্রষ্টব্য।

 

📒 আপত্তি —৪

 

মুফতী আহমাদ ইয়ার না’ঈমী ব্রেলভী লিখেছেন- “চার মাযহাব ছাড়া অন্য কোন মাযহাবের তাক্বলীদ বা অনুসরণ করা জায়েজ নয়, যদিও সে মাযহাব সাহাবীদের উক্তি, সহীহ হাদীস ও কুরআনের আয়াতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়, যে চার মাযহাবের কোন একটির অনুসারী নয়, সে পথভ্রষ্ট ও পথভ্রষ্টকারী।” [জা-আল হাক্ব: ২/৩০]

 

নোটঃ উক্ত আলোচনার সারমর্ম এই যে, ইমাম আবু হানীফা রহ. এর কথার খিলাফে যদি কুরআন, সহীহ হাদিস ও সাহাবীদের ইজমা হয় তাহলেও মুকাল্লিদের জন্য আবু হানিফা (রহ.) এর ফতোয়া ছেড়ে কুরআন, সহীহ হাদীস, সাহাবীদের ইজমার দিকে প্রত্যাবর্তন করা নাজায়েয এবং পথভ্রষ্টতা। (নাউ’জুবিল্লাহ)

 

📗 জবাব—১

 

চার মাযহাব ছাড়া অন্য কোন মাযহাবের তাকলীদ বা অনুসরণ করা জায়েয নয়— এ কথা তিনি একা বলেননি বরং পূর্ববর্তী অনেক ইমামগণই বলেছেন।

 

চার মাযহাবের যে কোনো একটির তাকলীদের ব্যাপারে ইজমা

 

ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. এর বিশিষ্ট ছাত্র এবং হাম্বলী মাযহাবের বিশিষ্ট ফক়ীহ আল্লামা ইবনুল মুফলিহ রাহ. স্বীয় গ্রন্থে বলেন,

الإجماع انعقد على تقليدِ كلٍّ من المذاهب الأربعة، وأن الحق لا يخرج عنهم

 

চার মাযহাবের যে কোন একটির তাকলীদ করার উপর ইজমা সংঘটিত হয়েছে। এবং সত্য এই চার মাযহাবের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। [অর্থাৎ চার মাযহাবের বাইরে কোন সত্য নেই]। আল ফুরূ —ইবনুল মুফলিহ: ৬/৩৭৪

 

উসুলে হাদীস শাস্ত্রে ইমাম ইবনুস সালাহ রাহিমাহুল্লাহ হচ্ছেন ইবনে হাজার আসকালানী রাহ-এর চেয়ে অগ্রগণ্য! হাদীস শাস্ত্রে ‘মুকাদ্দিমাতু ইবনিস সালাহ’ কিতাবটির অবস্থান কে না জানে! এবং উসুলে হাদীস এর প্রায় সব কটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থই কিন্তু তাঁর লিখিত।

 

সেই জগদ্বিখ্যাত উসুলে-হাদীসবিদ ইমাম ইবনুস সালাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন,

 

لَا يَجُوزُ تَقْلِيدُ غَيْرِ الْأَئِمَّةِ الْأَرْبَعَةِ

চার ইমাম ব্যতীত অন্য কারো তাকলীদ বৈধ নয়।

 

[ইকদুল জীদ ফী আহকামিল ইজতিহাদ ওয়াততাকলীদ: ৩০। নিহায়াতুল মুহতাজ ইলা শারহিল মিনহাজ: ১/৪৭]

 

শাফেয়ী মাযহাবের বিদগ্ধ ফকীহ আল্লামা যারকাশী রাহ. লিখেন,

وقد وقع الاتفاق بين المسلمين على أن الحق منحصر في هذه الأربعة ، وحينئذ فلا يجوز العمل بغيرها ، فلا يجوز أن يقع الاجتهاد إلا فيها.

 

এ ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর মাঝে ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, হক এ চার মাযহাবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সুতরাং এ চার মাযহাব ব্যতীত অন্য কোনো মাযহাবের অনুসরণ করা বৈধ নয় এবং এ চার মাযহাবের মধ্যেই কেবল ইজতিহাদ করা যাবে। [আল বাহরুল মুহীত: ৮/২৪০]

 

আল্লামা যারকাশী রাহ.আরো লিখেন,

الدَّلِيلُ يَقْتَضِي الْتِزَامَ مَذْهَبٍ مُعَيَّنٍ بَعْدَ الْأَئِمَّةِ الْأَرْبَعَةِ، لَا قَبْلَهُمْ

 

দলীলের দাবি হলো, চার মাযহাবের কোনো একটি নির্দিষ্ট মাযহাব অনুসরণ করা জরুরী, এর পূর্বের কোনো মাযহাব নয়। [আল বাহরুল মুহীত: ৮/৩৭৪]

 

ইমাম যাহাবী রহ, বলেন,

 

لا يكاد يوجد الحق فيما اتفق أئمة الاجتهاد الأربعة على خلافه ، مع اعترافنا بأن اتفاقهم على مسألة لا يكون إجماع الأمة ، ونهاب أن نجزم في مسألة اتفقوا عليها بأن الحق في خلافها

 

চার ইমাম যে বিষয়ে একমত এর বিপরীতে সঠিক মত পাওয়া যায় না বললেই চলে । যদিও আমরা স্বীকার করি চারজনের ইজমা সরাসরি পুরো উম্মতের ইজমা নয়। তবে তাদের ঐক্যমত হওয়া বিষয়ের বিপরীতে কোনো মাসয়ালায় সঠিক মত আছে এটা জোর দিয়ে বলতে আমরা ভয় করি। [সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা: ৭/১১৭]

 

ইমাম নববী রহ. (মৃ: ৫৭৬ হি) রাওযাতুত তালেবীন নামক গ্রন্থে লিখেন— উলামাগন বলেন ইজতেহাদে মুতলাক ইমাম চতুষ্টয় পর্যন্ত খতম হয়ে গেছে তাই তারা ইমাম চতুষ্টয়ের কোন একজনের তাকলীদ মুসলিম উম্মাহর জন্য ওয়াজিব সাবস্ত করে দিয়েছেন।

 

ইমামুল হারামাইন জুয়াইনী রহ: (মৃ:৪৭৮হিঃ) ইমাম চতুষ্টয়ের তাকলীদ ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে ইজমা উল্লেখ করেছেন। [নুরুল হিদায়া হতে সংকলিত পৃ-১০/ ফয়জুল কাদীর: ১/২১০। শরহুল মুহায্যাব নববী: ১/৯১। অধ্যায় আদাবুল মুস্তাফতী]

 

ইমাম ইবনে তাহমিয়া রহ. (মৃ: ৭২৮হি.) তিনি বলেন মুসলিম উম্মাহর ইজমা অপেক্ষা করে চার মাযহাবের বিপরীত কোন মাযহাব তৈরী করা বা গ্রহন করা বৈধ হবেনা। [মাজমূউল ফাতওয়া —ইবনে তাইমিয়াহ: ২/৪৪৬]

 

ইমাম ইবনে হাজার মাক্কী রহ: তিনি তার নিজের প্রসিদ্ধ কিতাব ফাতহুল মুবীনে বলেন— আমাদের যুগের বিশেষজ্ঞেদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইমামে আ‘যম ইমাম আবু হানীফা, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম মালেক ও আহমদ বিন হাম্বল রহ. এ চার ইমাম ছাড়া অন্য কারো তাকলিদ জায়েয নয়। [ফাতহুল মুবীন: ১৯৬]

 

মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব নজদী। লা-মাযহাবীরা দাবি করে থাকেন যে, আব্দুল ওয়াহাব নজদীও লা-মাযহাবী ছিলেন। তিনি বলেন, চার মাযহাব এর যে কোন একটির তাকলীদ করা যাবে এবং এ চার মাযহাব ছাড়া অন্য কোন মাযহাব এর অনুসরন করা যাবে না। [তারীখে নাজদ —আলূসী: ৫৪-৫৬। ছিয়ানাতুল ইনসান: ৪৭১]

 

১০

শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী রহ: (মৃ-১১৭৬ হি:) তার সুপ্রসিদ্ধ কিতাব হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগায় লিখেন— চার মাযহাব হক হওয়ার উপর সকল ইমামগণের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। [হুজ্জাতুল্লাহিল বালোগা:১-১২৩]

 

১১

ইমাম মোল্লা জিওন রহ. তাফসীরে আহমদিয়ায় লিখেছেন যে, ইনসাফ হলো চার মাযহাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ হওয়া। এক্ষেত্রে দলীল ও ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ নেই।

 

১২

বিখ্যাত উসূলে হাদীস বিশারদ ইবনে নুজাইম রহ: (মৃ. ৯৭০ হি.) লিখেন— যে ব্যাক্তি চার ইমামের বীপরীত মত পোষন করবে। সে মুসলিম উম্মাহর ইজমা তথা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত বিরোধী হিসাবে চিহ্নিত হবে। [আল আশবাহ ওয়ান নাযাইর: ১৩১]

 

১৩

আল্লামা শা’রানী রহ: তার বিখ্যাত কিতাব আল মীযানে লিখেন- নিজে পথভ্রষ্ট না হওয়া এবং অপরকে পথভ্রষ্ট না করার জন্য নির্দিষ্ট মাযহাব এর অনুসরন জরুরী।[ইনতেছারুল হক: ১৫৩]

 

১৪

ইমাম বুখারী ও মুসলিম এর উস্তাদ। হাদিসের জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বজন স্বীকৃত ইমাম বিশেষত হাদীস যাচাই-বাচাই বা জারহ-তা’দীলের অতুলনীয় ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিদ্যাসাগর ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন রহ: অসীম জ্ঞানের অধিকারী সত্বেও তিনি লাগামহীনতার পথ বন্ধ করার লক্ষ্যে ইমামে আ‘যম আবু হানীফার তাকলীদ করে চলতেন। তিনি বলেন- আমার নিকট গ্রহনযোগ্য ক্বিরাআত হামযাহ এর ক্বিরাআত এবং গ্রহণযোগ্য ফিক্বহ ইমাম আবু হানিফার ফিক্বহ। সকল মানুষকেও আমি এর উপর ঐক্যবদ্ধ পেয়েছি। [তারিখে বাগদাদ: ১৩/৩৪৭]

 

এভাবে পূর্ববতী সকল গ্রহনযোগ্য আলেমই চার মাযহাব এর পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। চাইলে আমি নিকট অতীতের প্রায় ডজন খানেক সৌদি শায়খের মন্তব্য উল্লেখ করতে পারবো। তবে জ্ঞানীদের জন্য এতোটুকুই যথেষ্ট মনে করছি।

 

মোটকথা: চার মাযহাব এর বিপক্ষে পূর্ববতী কোন গ্রহনযোগ্য আলেম এর অবস্থান কেউ দেখাতে পারবে না।

 

📗 ২য় জবাব

 

[বাকি থাকলে তাঁর এই কথা যে, যদিও সে মাযহাব সাহাবীদের উক্তি, সহীহ হাদীস ও কুরআনের আয়াতের সাথে সংগতিপূর্ণ হয়, যে চার মাযহাবের কোন একটির অনুসারী নয়, সে পথভ্রষ্ট ও পথভ্রষ্টকারী।]

 

এর উত্তরও ১ম ও ৩য় আপত্তির জবাবে চলে গিয়েছে; আবারও দেখে নিয়ে যেতে পারে। তবুও দু’ শব্দ বলছি, সহীহ হাদীস ও কুরআনের আয়াতের সাথে সংগতিপূর্ণ কি সংগতিপূর্ণ নয় তা সে কিভাবে বুঝবে! এইসব ব্যাপারে সাধারণ মানুষের জ্ঞান তো নিতান্তই কম।

 

📗 ৩য় জবাব

 

আর তিনি যে সংগতিপূর্ণের কথা বলেছেন— তাও মূলত মুকাল্লিদের বাহ্যিক দৃষ্টিতে সংগতিপূর্ণ। ইসলামের দৃষ্টিতে সংগতিপূর্ণ নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে যা সংগতিপূর্ণ তা তো ইমামগণ গ্রহণ করেই নিয়েছেন। বাহ্যিক দৃষ্টিতে তো মানুষের কাছে অনেক অসংগতিপূর্ণ ও ভুলভাল জিনিসও সংগতিপূর্ণ মনে হয়। নাস্তিকদের কাছে তো নাস্তিকতাটাই সংগতিপূর্ণ। অতএব সংগতিপূর্ণ মনে হলেই গ্রহণ করে নিতে হবে ব্যাপারটা তা নয়। কারণ, কোনটা সঠিক ও সংগতিপূর্ণ তা নির্ধারণ করবে শিক্ষক, ছাত্র নয়। এ বিষয়ে প্রথম আপত্তির দ্বিতীয় জবাব দেখে নেয়া যেতে পারে।

 

📒 সতর্কবার্তা

 

আপত্তিকারী নোট লিখতে গিয়ে লিখলেন— উক্ত আলোচনার সারমর্ম এই যে, ইমাম আবু হানীফা রহ. এর কথার খিলাফে যদি কুরআন, সহীহ হাদিস ও সাহাবীদের ইজমা হয় তাহলেও মুকাল্লিদের জন্য আবু হানিফা (রহ.) এর ফতোয়া ছেড়ে কুরআন, সহীহ হাদীস, সাহাবীদের ইজমার দিকে প্রত্যাবর্তন করা নাজায়েয এবং পথভ্রষ্টতা। (নাউ’জুবিল্লাহ)

 

📗 জবাব

 

আমরা বলবো— আপত্তিকারী এখানে সুকৌশলে সাহাবীদের ইজমা ঢুকিয়ে দিয়েছেন, অথচ “জা-আল হাক্ব” এর লিখক সাহাবীদের ইজমার কথা বলেননি। এভাবেই লা-মাযহাবরা সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে থাকে।

 

📒 আপত্তি —৫

 

ক্বাযী যাহিদ হুসায়নী দেওবন্দী লিখছেন, “প্রত্যেক মুকাল্লিদের জন্য শেষ দলীল হলো মুজতাহিদের বক্তব্য যেমনটা ‘মুসাল্লামুস সুবূত’ গ্রন্থে আছে “মুকাল্লিদের দলীল হল মুজতাহিদের কথা। [মুসাল্লামুস সুবূত: ১৩]

 

📗 জবাব

 

এই কথাতেও কোন সমস্যা নেই, কারণ মুকাল্লিদের শেষ দলীল হলো মুজতাহিদের বক্তব্য। আর মুজতাহিদের বক্তব্যের দলীল হলো কুরআন ও সহীহ হাদীস। সুতরাং মুজতাহিদের বক্তব্যের অনুসরণ মানেই কুরআন-হাদীসের অনুসরণ! মুজতাহিদের বক্তব্য গ্রহণ করার অর্থ হচ্ছে, যাতে করে সে কুরআন হাদীসের মানার ক্ষেত্রে কোনো ভুল ভ্রান্তিতে নিপতিত না হয়।

 

যেখানে ইমামগণের পর্যন্ত ভুল হতে পারে সেখানে সাধারণ মানুষের ভুল হওয়া তো আরও বেশি স্বাভাবিক। তাই এই সমস্ত ভুল-ভ্রান্তি থেকে বাঁচার জন্যই মূলত ইমামগণের অনুসরণ করা। ইমামের ভুল হলেও সমস্যা নেই; কারণ, মুজতাহিদ ইমামের ভুল আল্লাহ মাফ করে দেন। অতএব এক্ষেত্রে আমরা পার পেয়ে গেলাম।

 

লা-মাযহাব বন্ধুরা যেভাবে কুরআন ও সহীহ হাদীসের গ্ৰন্থ থাকা সত্ত্বেও তাদের শায়খের বক্তব্য শোনে এবং শেয়ারের মাধ্যমে অন্যকে শোনার প্রতি আগ্রহী করে এবং তাদের লিখিত বই পড়ে। এর অর্থ কি তারা কুরআন ও সহীহ হাদীস বাদ দিয়ে শায়েখকে অনুসরণ করছে? কিংবা কুরআন ও সহীহ হাদীস বাদ দিয়ে শায়খদের লিখিত কিতাবের অনুসরণ করছে?

 

নাকি তারা শায়খদের কথার অনুসরণ এবং তাদের লিখিত কিতাবের অনুসরণ করার মাধ্যমে কুরআন-হাদীস অনুসরণ করছে? তারা অবশ্যই বলবে আমরা কুরআন ও সহীহ হাদীসের অনুসরণ করছি। তো আমরাও বলবো, আমরা ইমামের অনুসরণ করছি না বরং কুরআন হাদীসেরই অনুসরণ করছি।

 

যদি প্রশ্ন করা হয়, তা কীভাবে? মানছো ইমামের কথা, বলছো কুরআন-হাদীসের অনুসরণ; এটা কিভাবে সম্ভব?

 

তাহলে আমরাও বলবো, আপনারা শুনছেন শায়খের কথা, বলছেন কুরআন হাদীসের অনুসরণ। তা কীভাবে সম্ভব? যদি আপনাদের জন্য সম্ভব হয় তাহলে আমাদের জন্যও সম্ভব।

 

যেভাবে (আপনাদের দাবি অনুযায়ী) শায়খদের কথা মানা মানে কুরআন-হাদীস মানা, একইভাবে মুজাহিদ ইমামকে দলীল মানা মানেও কুরআন-হাদীসকেই দলীল মানা। এ সামান্য বিষয়টুকু বোঝারও কি জ্ঞান নেই?

 

সংশয় নিরসন: শায়খদের অনুসরণ করলে কুরআন-হাদিসের অনুসরণ হবে না। কুরআন হাদিসের অনুসরণ করতে হলে মুজতাহিদ ইমামগণের অনুসরণ করতে হবে।

 

📒 আপত্তি —৬

 

যারা ইমাম আবু হানীফাহ রহ.-কে তাবে’ঈ দাবি করলেও তাদের উপরোক্ত মন্তব্যে বোঝা যায় ইমাম আবু হানীফাহ রহ.-কে তারা রাসূল সা. থেকেও বেশি মানে। কুরআন-হাদীস থেকেও আবু হানীফাহ রহ. এর রায়কে বেশি মূল্যায়ন করে। নাউজুবিল্লাহ।

 

📗 জবাব

 

এই মূর্খতাপূর্ণ কথার জবাব দেওয়া জরুরী মনে করি না, তবুও ছোট্ট একটি জবাব দিচ্ছি। যেখানে আমরা ইমাম আবূ হানীফা রাহ. এর ছাত্র ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদের কথার সামনেই ইমাম আবূ হানীফার রায়কে বর্জন করি। সেখানে আমাদের ক্ষেত্রে যদি বলা হয়, আমরা ইমাম আবু হানীফা রাহ.কে কুরআন হাদীসও রাসূলের চেয়েও বেশি মূল্যায়ন করি, তাহলে সেটা প্রহসন বৈ কী?

লুবাব হাসান সাফ‌ওয়ান

আরো পড়ুন-


Screenshot 3
বিজ্ঞাপনঃ বই কিনুন, বই পড়ুন

1

লুবাব হাসান সাফ‌ওয়ান

Author: লুবাব হাসান সাফ‌ওয়ান

লুবাব হাসান সাফ‌ওয়ান। ঠিকানা: নোয়াখালী। কর্ম: ছাত্র। পড়াশোনা: আল-ইফতা ওয়াল হাদীস [চলমান] প্রতিষ্ঠান: মাদরাসাতু ফায়দ্বিল 'উলূম নোয়াখালী।

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

কবিতা আল কোরআনের প্রতীক আফছানা খানম অথৈ

আল কোরআনের প্রতীক আফছানা খানম অথৈ মা আমেনার গর্ভেতে জন্ম নিলো এক মহামানবের, নাম হলো তার মুহাম্মদ রাসুল আসলো ভবের

ফোরাত নদীতে স্বর্নের পাহাড় আফছানা খানম অথৈ

ফোরাত নদীতে স্বর্নের পাহাড় আফছানা খানম অথৈ ইমাম মাহাদী (আ:) আগমনের পূর্বে ফোরাত নদীর তীরে স্বর্নের পাহাড় ভেসে উঠা কেয়ামতের

কবিতা দাজ্জাল আফছানা খানম অথৈ

দাজ্জাল আফছানা খানম অথৈ কেয়ামতের পূর্বে দাজ্জাল আসবে নিজেকে খোদা বলে দাবি করবে, কাফের মুনাফিক যাবে তার দলে ঈমানদার মুমিন

গল্প হযরত মুহাম্মদ (সা:) জীবনের গল্প আফছানা খানম অথৈ

জন্ম:হযরত মুহাম্মদ (সা:) বর্তমান সৌদি আরবে অবস্থিত মক্কা নগরীর কুরাইশ গোত্রে বনি হাশিম বংশে ৫৭০ খৃষ্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন।তার পিতার

One Reply to “তাকলীদ সম্পর্কে কিছু আপত্তি ও জবাব”

Leave a Reply