নীলু : দূর! বিয়েতে গোলাপি রঙের শাড়ি ভালো লাগে নাকি? বিয়েতে তো টকটকে লাল রঙের শাড়ি পড়তেই ভালো লাগে। বিয়ে বিয়ে একটা ফিল আসে।
নীলুর কথা শুনে নীলুর মা সাহারা খাতুন মেয়ের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে জবাব দিলেন-
সাহারা খাতুন : কি আর করার? তোর শ্বশুর বাড়ি থেকে যেহেতু এই রঙের শাড়ি দিয়েছে সেহেতু এটাই তো এখন পড়তে হবে তোকে।
নীলু : মা! একটা কথা বলি?
সাহারা খাতুন : কি কথা? বল।
নীলু : মা ছোট ফুপুর রুমে যে একটা লাল টকটকে বিয়ের শাড়ি রয়েছে, সেটা পড়ি?মেয়ের কথা শুনে সাহারা খাতুন কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন। অতঃপর নিজেকে সামলিয়ে বললেন-
সাহারা খাতুন : না নীলু! এটা কেমন দেখায়? তোর শ্বশুর বাড়ির লোকজন কি ভাব্বে?
নীলু : আমার গোলাপি শাড়ি পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না মা।
সাহারা খাতুন : পড়ে নে মা। একদিনেরই তো ব্যাপার।নীলু সেখান থেকে মুখ ফুলিয়ে চলে গেলো। নীলু ভেবে পায় না কি হবে সেই শাড়িটা পড়লে? বিয়েতে লাল শাড়ি ছাড়া কোনো ফিল আসে নাকি? বিয়ে কি বার বার হয় ? একবারই তো হয়, আর এই একবার যদি নিজ পছন্দ মতো শাড়িই না পড়া যায় তাহলে বিয়ের মজা থাকে নাকি? হুট করে নীলুর মাথায় এক বুদ্ধি খেলে গেলো। নীলু যদি ওর দিদাকে বলে তাহলে নিশ্চয় দিদা না করবে না! পরিকল্পনা মোতাবেক নীলু চলে গেলো তার দিদার রুমে। গিয়ে দেখলো দিদা বসে বসে কাঁথা সেলাই করছেন।
নীলু : এই বয়সে আর কত কাঁথা সেলাই করবে দিদা? এবারতো একটু বিশ্রাম নাও!
দিদা : আমার কি কোনো কাজ আছে নাকি? সারাদিন তো শুয়ে-বসেই দিন কাটছে। সারাদিন শুয়ে-বসে থাকা যায়? তাই মাঝে মাঝে একটু কাঁথা সেলাই করি।
নীলু : তুমি পারো বটে!
দিদা : জানিস দিদিভাই! এই কাঁথাটা আমি তোর জন্য সেলাই করছি।
নীলু : বাসায় এত্তো এত্তো কাঁথা রয়েছে, তুমি আবার কষ্ট করতে গেলে কেন?
দিদা : সেটা তুই বুঝবি না দিদিভাই। তুই যেদিন আমার বয়সের হবি সেদিন বুঝবি।
নীলু : আচ্ছা শুনো না!
দিদা : হ্যাঁ বল।
দিদা : ছোট ফুপুর শাড়ির কথা শুনলে বাসার সবাই এইভাবে ঘাবড়ে যায় কেন বলো তো?
দিদা : থাক না দিদি ভাই। এসব জেনে আর কি লাভ?
নীলু : এতো করে সবাই কে জিজ্ঞেস করে আসছি এতোদিন কিন্তু কেউ কিছু বললো না। এখন আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি তাও তোমরা কেউ আমার জবাব দিচ্ছো না। আর আসবো না আমি এই বাড়িতে। একবার শুধু বিয়েটা হোক!দিদা কাঁথা সেলানো বাদ দিয়ে নীলুর দিকে তাকালো। তারপর মুচকি হেসে বলতে শুরু করলো-
দিদা : জানিস দিদিভাই, তুই দেখতে পুরো তোর ছোট ফুপুর মতো হয়েছিস। তাই তো ওর নামে আমি তোর নাম রেখেছিলাম। আমার মেয়েটা অনেক রূপবতী ছিলো, একদম তোর মতো।
নীলু : তারপর?
দিদা : তারপর একসময় আমার রাজকন্যার বিয়ের দিন এলো। আমার মেয়েটাও ঠিক তোর মতোই লাল শাড়ির বায়না ধরেছিলো। কারন আমার রাজকন্যার শ্বশুর বাড়ি থেকে সবুজ রঙের শাড়ি দিয়েছিলো। তখন তোর দাদু সবকিছু অবজ্ঞা করে সেদিনই শহর থেকে লাল রঙের একটা শাড়ি এনে দেয়। সবকিছু তখন পর্যন্ত ঠিক ছিলো। কিন্তু যখন বিয়ের সময় হয় তখন বর নিখোঁজ। অনেক খেঁজাখুজি করেও পাওয়া যায় নি ছেলেকে।
নীলু : ছেলের খোঁজ পরে আর কখনোই পাও নি?
দিদা : পেয়েছিলাম। সেদিনই পেয়েছিলাম। খোঁজাখুজি শেষ করে সবাই যখন হতাশ হয়ে বসে ছিলো তখন খবর আসে ছেলে তার প্রেমিকাকে বিয়ে করে বাড়ি চলে গেছে।
নীলু : এমা তখন ফুপু কাঁদে নি?
দিদা : ওই সময়টা তোদের এই সময় থেকে পুরোপুরি ভিন্ন ছিলো। ওই ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার পরে তোর ফুপু ওই ছেলেকে না দেখেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো। তাই যখন এই কথা শুনে তোর ফুপু, তখন অনেক কেঁদেছিলো।
নীলু : এইজন্যই বুঝি ফুপু আর বিয়ে করে নি?
দিদা : হ্যাঁ। সেদিনের পর থেকে সবাই আমার মেয়েটাকে দোষ দিতে শুরু করে। আশেপাশের লোকজন অনেক বাজে কথা বলতে শুরু করে। একসময় আমার মেয়েটা সেসব সহ্য করতে না পেরে ওই লাল রঙের শাড়িটা পড়ে আত্মহত্যা করে।
নীলু : আহারে! এতো কষ্ট সহ্য করে ফুপু মারা গেলো! কিন্তু এটা এতোদিন আমাকে কেউ বলে নি কেন? আর মাকে শাড়িটার কথা বলতেই মা কেন ঘাবড়ে গিয়েছিলো? উপরন্তু ছোট বেলা কতো করে পড়তে চাইতাম শাড়িটা, কিন্তু কেউ পড়তে দিতো না।
দিদা : কাহিনি যে এখানেই থেমে থাকে নি দিদিভাই!
নীলু : তাহলে?
দিদা : তোর ফুপুর মৃত্যুর পরে আমি ওই লাল শাড়িটা অনেক যত্ন সহকারে তুলে রেখেছিলাম। তারপর একদিন পাশের বাড়ির শিউলির বিয়েতে শিউলির মা এসে এই শাড়িটা দুদিনের জন্য নিয়ে যায়। কারন শিউলির নাকি ইচ্ছে ছিলো ওর বিয়েতে এমনই একটা শাড়ি পরবে। আর যে ছেলের সাথে শিউলির বিয়ে ঠিক হয় সে ছেলেটার আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিলো না। তাই আমিও শাড়িটা দিয়েছিলাম। কিন্তু শিউলির বিয়ের দিন আবারো সেই একই ঘটনা পুনরাবৃত্তি ঘটে। ছেলে নিখোঁজ হয়ে যায়, তবে পরে আর ছেলের খোঁজ কোনোদিনও পাওয়া যায় নি। তাই সবার ধারণা ওই শাড়ির সাথে তোর ফুপুর আত্মা রয়েছে। আর ছেলেদের প্রতি তোর ফুপুর একটা ঘৃণা তৈরী হয়েছে। তাই তোর নীলু ফুপুই ওই ছেলেকে নিখোঁজ করে দিয়েছে।
নীলু : এ! এটাও সম্ভব?
দিদা : আগের দিনে অনেক কিছুই সম্ভব হতো রে দিদিভাই।
নীলু : আমি বিশ্বাস করি না!দিদা আর কিছু বলবে তার আগেই নীলুর ডাক পরলো। তাই নীলু সেখান থেকে উঠে চলে গেলো। আর দিদা নীলুর যাওয়ার পানে তাকিয়ে মনে মনে বলতে লাগলো,”শুধু দেখতেই না, তোর আচার-আচরণ, চলাফেরাও যে আমার রাজকন্যার সাথে মিলে যায় দিদিভাই!”
বিয়ের দিন-
সাহারা খাতুন সবে মাত্র নীলুর রুমে প্রবেশ করেছেন, এটাই দেখতে যে নীলুর সাজ কতোদূর। কারন একটু পরেই বরযাত্রী চলে আসবে। কিন্তু নীলুকে দেখার সাথে সাথেই সাহারা খাতুন ভয় পেয়ে গেলেন। নীলুকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে নীলুর কাছে এসে বললেন-
সাহারা খাতুন : এ কি অলুক্ষুণে কান্ড ঘটিয়েছিস তুই নীলু? এই শাড়ি পরেছিস কেন? তাড়াতাড়ি খুল এটা, তোর শ্বশুর বাড়ি থেকে যেটা পাঠিয়েছে সেটা পরে নে।
নীলু : কেন মা? এটায় আমাকে সুন্দর লাগছে না?
সাহারা খাতুন : আহা নীলু তুই বুঝতে পারছিস না। কোনো অঘটন ঘটে যাওয়ার আগেই তারাতাড়ি শাড়ি পালটে নে।
নীলু : মা, মা, মা! তুমি একদম চিন্তা করো না। দেখো কিচ্ছু হবে না। সব ঠিকঠাকই থাকবে।নীলু আরো কিছু বলবে তার আগেই নীলুর বান্ধুবি স্নিগ্ধা সেখানে দৌড়ে এলো। আর হাপাতে হাপাতে বললো,”নীলু, নীলু তোর বরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”
সমাপ্ত

ভালো লিখেছেন কবি
ধন্যবাদ আপনাকে❤️