আমি তখন ক্লাস ২ তে পড়ি। সদ্য শৈশবের দুরন্তপনা ছুঁয়েছে। ফুটবল বিশ্বকাপে সেবার স্পেইন চ্যাম্পিয়ন হয়েছে জানি তবুও আশরাফুল/সাকিবের টানে ক্রিকেটে নেশা চাপে সেই ছোট্ট বয়সেই। যথারীতি কেজি স্কুল থেকে এক তপ্ত রোদেলা দুপুরের দিকে ফিরেই ব্যাগ রেখে বাবাকে বললাম ২০ টাকা দেও ক্রিকেট বল কিনবো।।
সেই কয়েকবছর টানা শিলাবৃষ্টি, বাতাস, বন্যায় ধানের দাম কম ছিলো। একটি মধ্যবিত্ত যৌথ পরিবারের জন্য এই অর্থনৈতিক দূরাবস্থার ধকল নিয়ে কারোর শখ পূরণ করাও এক প্রকার দূ:সাধ্য ব্যপার। ঠিক যেমন টা হওয়ার কথা, বাবার থেকে টাকা টা পেলাম না।।
দাদীর কাছে গিয়ে বললাম টাকা আমাকে দিতে হবে দিতেই হবে। ছোটবেলা থেকে দাদী আমাকে একদম কোলে পিঠে মানুষ করেছে। বাড়িতে ভালো কিছু রান্না হলে সবাই যদি ১ বেলা খায় তবে আমার জন্য দাদী সেই খাবার ৩ বেলার ব্যবস্থা রাখতো, ফুপু বা চাচা দের কেউ দাদীর জন্য কোনো খাবার আনলে সেটার দুই তৃতীয়াংশ আমার পেটে গিয়েছে তা নির্দ্বিধায় স্বীকার করবো। সবচেয়ে মনে পড়ে বৃষ্টির দিনে দাদীর বিছানায় বসে আম দুধ খাওয়া আর বৃষ্টি দেখা।।
যাই হোক দাদীকে বলা মাত্র উনি তার আলমারি থেকে খুঁজে খুঁজে একটা ২০ টাকার নোট হাতে দিলেন।।
সদ্য কৈশরে পদার্পন করা আমি তখন বাবার পুরোনো বড় সাইকেলের হাফ প্যাডেলে (সীটে উঠতে পারি না তখন; এক হাত সীটে আরেক হাত হাতলে রেখে সাইকেল চালানো) চালাতে শিখেছি মাত্র। সেই পুরোনো রঙ উঠে যাওয়া সাইকেলে করে বাড়ির পাশের বাজারে গেলাম বল আনতে। নতুন বলের আনন্দের মেজাজে বল টা আর ভালো ভাবে দেখে শুনে আনা হলো না। বাড়িতে ফিরেই মহা আনন্দে খেলতে যাবো এই প্রত্যাশায় বল মাটির দিকে বাড়াতেই এক ফ্যাকাশে ধ্বনিই আমাকে জানান দিলো বল টা আগে থেকেই একদিকে ফেটে যাওয়া ছিলো।
আমি আর দাদীকে কখনোই বলি নি বল টা ফাটানো ছিলো!
একটা ছোট্ট হৃদয়ের সেই বড় ব্যথা সেদিন কে বুঝেছিল?
২০ টাকার ক্রিকেট বলে যে পূরণ না হওয়া এক আকাশচুম্বি দুরন্তপনা হাতছানি ছিলো তা কে জানতো?
নিরবে নিভৃতে এক ছোট্ট শিশুও যে সেদিন কি নিদারুণ কষ্ট সহ্য করেছে তা কে শুনেছিলো কোনোদিন?সেদিনের সেই আবেগ আজ নেই
নেই আমার খেলার সাথীরা ।।মহাকালের মস্ত বড় মরিচিকা ক্ষুধা আর খাবারের চিন্তা দূরে ঠেলে দিয়েছে আমার প্রাণবন্ত সেই উচ্ছ্বাস আর উচ্ছলতাকে!
