বোকা মা
আফছানা খানম অথৈ
কদমের তিনদিন ধর খুব জ্বর।তার বাবা গরীব মানুষ কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকে সারাক্ষণ।কারণ একদিন কাজ না করলে উপোস কাটাতে হবে যে।এজন্য ছেলেটার দিকে তেমন একটা খেয়াল দিতে পারছে না।এদিকে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া হালিমার কাগজ কলম কিনে দিতে পারে নাই বিধায় স্কুলের টিচার’রা বুক বকাঝকা করে।হালিমা স্কুল থেকে ফিরে উঁ উঁ উঁ উঁ করে মায়ের পাশে বসে কাঁদে।বাবা কাজ থেকে ফিরে মেয়ের কান্না দেখে বলে,
মারে কান্দছ ক্যান?
কথাটা বলতে হালিমা আরো জোরে উঁ আঁ উঁ আঁ করে কেঁদে কেঁদে বলে,
বাবা কাগজ কলম কিন্ন্যা দেওনা ক্যান,আজ স্যার আমারে আবার মারছে।
সে বলে আর কাঁদে।বাবা তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
কান্দিস না মা,আজ হাট থেইক্যা কাগজ কলম নিয়া আহুমনি।
হালিমার কান্না থামতে না থামতে এবার দুবছরের মাছুম বাচ্চা কদম জোরে জোরে কেঁদে উঠল।বাবা কদমকে কোলে নিয়ে বলে,
বাবা কান্দছ ক্যান,কি অইছে তর?
মা রান্না ঘর থেকে ছুটে এসে বলে,
পোলাডার আজ কদিন ধইরা জ্বর। পোড়া কপাল আমার এখনো ডাক্তার দেহাইবার পারতাছি না।উঁ উঁ উঁ।
বউ কাইন্দ না।সবর কর,মহাজনেরতেন কামের টেকা লই।তই ডাক্তার দেহামুনি।
কদমের বাবা বউকে কোন রকম বুঝিয়ে একটা কীটনাশকের ঔষধ বউয়ের হাতে দিয়ে বলল,
বউ এ ঔষধখানা ভালোমতন থুইও।কাল ক্ষেতে দিমুনে।ধানে পোকা লাগছে।
বউয়ের হাতে ঔষধ তুলে দিয়ে কদমের বাবা ছুটে গেল মহাজনের কাছে কাজের টাকার জন্য।মহাজন তাকে দেখে বলে,
কি কদমের বাপ কামকাজ ঠিক মতন করো তো?
জ্বী মহাজন সাব।
তই হুন?
জ্বী কন।
আমি এখন টাকা দিবার পারুম না।আগামী হপ্তায়ে নিও।
কোনকিছু বলার আগে মহাজন ভিতরে চলে গেল।
কদমের বাবার রাগে চোখ দুটো লাল হয়ে গেল।কড়া চোখে তার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।তবুও সাহস হলো না মহাজনেরে কিছু বলার।একবুক ব্যথা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসল।বউ জিজ্ঞাসা করলো,
কি অইল কদমের বাপ,মন খারাপ ক্যান,মহাজন টেকা দেয় নাই?
দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে কদমের বাপ উত্তর দিলো,
নারে বউ দেয় নাই।আগামী হপ্তাহে দিবে কইছে।
ও কদমের বাপ এইডা কি কইলেন,আমার পোলারে ডাক্তার দেহামু না।
কান্দিস না বউ ব্যবস্থা এক্কান অইব।
কদমের বাবা হনহন করে ছুটে গেল পাশের বাড়ির সগীর মিয়ার কাছে। তিনি বিপদ-আপদে লোজনকে সাহায্য করেন।তবে লাভ ছাড়া নয়,একটু কায়দা করে ঘুষ খান। তবে সরাসরি ঘুষ না বলে,বলেন লাভ শতকরা এত পার্সেন্ট।তাই কদমের বাবাকে দেখামাত্রই জিজ্ঞাসা করলো,
আরে সাবেদ যে কি মনে কইরা?
সগীর ভাই আমার এক্কান উপকার করেন।
কও কি উপকার?
আজ দুতিন ধইরা কদমের খুব জ্বর টেকার জন্য ডাক্তার দেহাইবার পারতাছি না।
তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সগীর মিয়া বলল,
ও বুঝবার পারছি।তোমার টেকা লাগব এই তো…।
জ্বী সগীর ভাই।
তা কত লাগব?
শ’পাঁছেক হলে চলব।
ঠিক আছে লইয়া যাও।তই মাসে মাসে লাভ দিয়া যাইও।
সাবেদ আর কোন কথা না বলে টাকা নিয়ে বাড়ি গেল।তারপর কদমকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেল।ডাক্তার থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মেপে ঔষধ দিয়ে দিলেন।সাবেদ বাড়ি এসে কদমকে ঔষধ খাওয়াল।তারপর ঔষধের শিশিটা টেবিলের উপর রেখে বউকে বলল
বউ,সময়মতন কদম’র ঔষধ খাওয়াবে।
বউকে খাওয়ার নিয়ম বুঝিয়ে দিয়ে সাবেদ কাজে গেল।এদিকে ঔষধ খাওয়ার সময় হলে,কদমের মা ছেলেকে ঔষধ খাওয়ালেন।ঔষধ খাওয়ার সাথে সাথে কদমের মুখ দিয়ে লালা বের হচ্ছে।সে কাঁদে আর দাঁপাদাঁপি করে।কদমের মা কাঁদে আর চিৎকার করে বলে,
এই তোমরা কে কোন হানে আছ, আহ দেইখ্যা যাও,ডাক্তারের ঔষধ খাইয়্যা আমার পোলা মইরা যাইতাছে।
পাড়া প্রতিবেশী সবাই এক গতিতে ছুটে আসল।এসে দেখল কদমের মুখ থেকে কীটনাশকের ঔষধের গন্ধ।তাই আর দেরী না করে কদমকে দ্রুত হসপিটালে নিয়ে গেল।যাক আল্লাহ সহায় ছিলেন সময়মতো ডাক্তার কদমের মুখ থেকে কীট নাশক ঔষধ বের করলেন।তারপর কদমের মা’কে বললেন,
আপনি কি সৎ মা?
তফুরা কেঁদে উঠে বলে,
কি কন,ডাক্তার আপা,আমি সৎ অমু ক্যান,কদম আমার নিজের পেটের পোলা।
তাহলে নিজের ছেলেকে বিষ খাওয়ালেন কেনো?
ডাক্তার আপা আমার কোন দোষ নাই।আমাগো বাজারের ডাক্তার কদমের জ্বরের লাইগ্যা এই ঔষধ খান দেছে।আর এই ঔষধ খাইয়া কদমে মরতে….।
আমি ঐ ডাক্তারের লাইগ্যা কেচ করমু।
বলতে না বলতে তফুরা কেঁদে কেঁদে হাসপাতাল মাতিয়ে তোলে।ডাক্তার বুঝতে পারলো এর ভিতরে কিছু একটা ভুল হয়েছে।কারণ ডাক্তার কখনো বিষ দিতে পারে না।কিছু একটা গন্ডগোল তো আছে।তিনি তফুরাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
শুনুন?
জ্বী কন আপা?
আপনার ঘরে কি আর কোন ঔষধ ছিল?
জ্বী আপা ছিল।ক্ষেতের পোকা মারনের ঔষধ।
এক্ষণি ঐ ঔষধটা নিয়ে আসুন।
তফুরা ছুটে গিয়ে ঔষধটা নিয়ে আসল।তারপর ডাক্তারের হাতে দিয়ে বলল,
আপা এটা পোকা মারনের বিষ।আমি খুব যত্তন কইরা রাখছি।আমার পোলারে আমি বিষ খাওয়ামু ক্যান।
ডাক্তার দেখল,তফুরার অজ্ঞতার কারণে এই ভুলটা হয়েছে।জ্বরের ঔষধকে বিষ মনে করে রেখে দিয়ে,বিষকে জ্বরের ঔষধ ভেবে কদমকে খাওয়ালেন।যার কারণে কদমের প্রাণ যায় যায় ভাব….।ডাক্তার দুটো শিশি হাতে নিয়ে তফুরাকে বললেন,
শুনুন কদমের মা।
জ্বী কন আপা।
ভুল ডাক্তার নয়,আপনি করেছেন?
কি কন ডাক্তার আপা,আমি ভুল করুম ক্যান,আমি ঠিক মতন কদমরে ঔষধ খাওয়াইছি।
না আপনি ঠিকমতো ঔষধ খাওয়াননি।ভুল করে ভুল ঔষধ খাইয়েছেন।মানে জ্বরের ঔষধকে বিষ ভেবে ফেলে রেখেছেন।আর বিষকে জ্বরের ঔষধ ভেবে খাইয়েছন।যার কারণে কদম মরতে বসেছে।
সত্য কইতাছেন ডাক্তার আপা?
জ্বী সত্যি।এমন ভুল আর কখনো করবেন না।বাচ্চাদেরকে ঔষধ খাওয়ানোর সময় দেখে শুনে খাওয়াবেন।আজ আপনার মতো একজন “বোকা মা’র” জন্য কদম’র মতো ফুটফুটে বাচ্চা মরতে বসেছিল।নিজে না বুঝলে কারও কাছ থেকে বুঝে নিবেন ঔষধ খাওয়ার নিয়ম কানুন।
ঠিক বলেছেন ডাক্তার আপা।
তফুরা নিজের ভুল বুঝতে পারলো এবং ডাক্তারকে সালাম দিয়ে বাড়ি ফিরে আসল।
ঃসমাপ্তঃ
