খ্রিস্ট ধর্ম নাজারাথের যিশুর জীবন এবং শিক্ষার উপর প্রতিষ্ঠিত। এই ধর্মে বিশ্বাসীরা মনে করে, যিশু ঈশ্বরের পুত্র, যিনি পিতা ছাড়াই মাতা মেরীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এই ধর্মে বিশ্বাসীরা খ্রিস্টান নামে পরিচিত, তাদের ধর্মগ্রন্থের নাম বাইবেল।
বিশ্বাসীরা মনে করে ওল্ড টেস্টামেন্টে ইহুদি জাতির ইতিহাস এর বর্ণনা যেমন আছে তেমন যিশুর আগমনের ব্যাপারে ইঙ্গিতও দেয়া আছে, আর তার আগমন ঘটেছে মানবজাতিকে রক্ষা করতে। তিনি মেসিয়াহ বা, ত্রানকর্তা।
গানঃ বিভিন্ন ভক্তিমূলক গান খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারীরা গাইতে এবং শুনতে পছন্দ করেন। বাংলাদেশেও বাংলা ভাষায় এইসব গান গাওয়া হয়। এরকম একটি গান-
খ্রিস্টান ধর্মের মূলনীতি
ক্যাথলিকরা বিশ্বাস করেন- পবিত্র পিতা, পবিত্র পুত্র এবং পবিত্র আত্মা এই তিনজনই ঈশ্বর এবং তিনি হচ্ছেন যিশু। সোজা কথায় ঈশ্বর তিনটি আলাদা রূপে মানুষের কাছে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন। ইহুদি আর, ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা এই ত্রিত্ববাদ অস্বীকার করে।
ট্রিনিটি এবং মানবজাতীর পাপের জন্য যিশু মারা গেছেন এই বিশ্বাসকে খ্রিস্টানদের বড় একটি অংশ তাদের ধর্মের মূলনীতি বলে মনে করেন। অন্যান্য আব্রাহামিক ধর্মগুলোর মত এটিও একেশ্বরবাদী। মানুষরূপী যিশু জাতিতে ছিলেন একজন ইহুদি। তিনি ছিলেন ইহুদিদের রাজা এবং অনেক অলৌকিক কাজ সম্পাদন করেছিলেন-
- তিনি মৃতকে জীবিত করতে পারতেন
- অসুস্থকে সুস্থ করতে পারতেন
- আবহাওয়া নিয়ন্ত্রন করতে পারতেন
- মানুষকে খাদ্য ও পানীয় যুগিয়েছিলেন
- মৃত্যুর তিনদিন পর তিনি ফিরে আসেন
বাইবেলের নতুন নিয়ম অনুসারে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর তিনদিন পরে যিশু আবার পৃথিবীতে ফিরে আসেন। এই সময় অনেকেই তাকে দেখেছে বলে বাইবেলে বর্ণিত আছে। এর কিছুদিন পরে তিনি আবার স্বর্গে তার পিতার নিকট ফিরে গিয়েছিলেন।
যিশুর বারোজন শিষ্য ছাড়াও সন্ত পৌল, আদি খ্রিস্টধর্ম প্রচারকদের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছেন। বাইবেলের নতুন নিয়মের বেশ কিছু পুস্তক তিনি রচনা করেছেন। যিশুর মৃত্যুর পর তার শিষ্যরা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং যিশুর শিক্ষা মানুষের মাঝে প্রচার শুরু করেন।
খ্রিস্ট ধর্মের প্রবর্তক কে?
ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মুসলিমদের মাঝে যিশুকে নিয়ে মতভেদ আছে। খ্রিস্টানদের বিভিন্ন দল বা, মন্ডলী থাকলেও একেশ্বরবাদী এই ধর্মটির কেন্দ্রে রয়েছেন যিশু খ্রিস্ট– এটি সবার ক্ষেত্রেই সত্যি। যিশুর জীবন, শিক্ষা, মৃত্যু, পুনরুত্থান ইত্যাদি বিষয়গুলো এই ধর্মের প্রধান বিষয় হিসবে প্রতীয়মান হয়েছে।
তাই, যিশুকেই এই ধর্মের প্রবর্তক বলা যেতে পারে। তার বারোজন শিষ্যের মাধ্যমে এটি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। একনকার সময়ে যারা ভ্যাটিকানের পোপের উপর নির্ভর করেন তাদেরকে বলা হয় পোপিস্ট।
খ্রিস্ট ধর্মের বইঃ খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থের দুটি ভাগ রয়েছে- একটি ওল্ড টেস্টামেন্ট আরেকটি নিউ টেস্টামেন্ট। খ্রিস্টানরা মনে করেন তারা নিউ টেস্টামেন্টের যুগে বাস করেন, ওল্ড টেস্টামেন্ট ঈশ্বরের বাণী হলেও এখন প্রযোজ্য নয়। অন্য ধর্মাবলম্বীরা যেসব বিষয় নিয়ে সাধারণত অভিযোগ তোলেন সেগুলো আছে ওল্ড টেস্টামেন্টে।
খ্রিস্ট ধর্মের ইতিহাসঃ প্রথম খ্রিস্টাব্দ থেকেই এই ধর্মের শুরু। যিশুর মৃত্যুর কিছুদিন পর থেকেই তাঁর শিষ্যরা রোমে বিভিন্ন অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করে ধর্মপ্রচার করতে থাকে। পরে এটি একসময় রোমের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পায়। এটি মূলত ইহুদি ধর্মের ধারাবাহিকতায় তৈরি হওয়া একটি ধর্ম, ইসলাম ধর্মও তাই। কারণ, ইহুদিদের ইতিহাস, নবী, কিতাব সবকিছু আত্মীকরণ করা হয়েছে। একইসাথে সেটি ধর্মের অপরিহার্য্য বিশ্বাসও বটে।
খ্রিস্ট ধর্মের প্রসারঃ এটি রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় মূলত ৩১৩ খ্রিস্টাব্দের পরে। কনস্টান্টাইনের সময় থেকে এটি প্রসার লাভ করতে থাকে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী মানুষের অনুসরণ করা এই ধর্মের অনুসারী সংখ্যা ২৪০ কোটিরও বেশী। বাংলাদেশী পাদ্রী প্যাট্রিক ডি রোজারিও ক্যাথলিক গীর্জার একজন কার্ডিনাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ধর্মগ্রন্থের নাম বাইবেল
বাইবেল শব্দের অর্থ বই বা বইসমূহ, আরবিতে বলা হয় কিতাবুল মুকাদ্দাস। বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটিও আরবি নামটি বাংলাতে ব্যবহার করেছে, তারা নতুন শব্দ আবিষ্কার করেনি। এটি মূলত পবিত্র গ্রন্থগুলোর একটি সংকলন। মুসলিমদের একটি ভুল ধারণা আছে যে তাদের ভাষায় যেটি ইঞ্জিল সেটিই বাইবেল। প্রকৃতপক্ষে এই কথাটি সত্য নয়।
সাধারণ মুসলিমদের অনেকেই মনে করেন আল্লাহ ঈসা (আঃ) এর কাছে কোরআনের মত একটি বই পাঠিয়েছিলেন, সেটিই বাইবেল। আসলে খ্রিস্টানদের বাইবেল এমনটা নয়।
আসল বাইবেলের দুটি অংশ রয়েছে, এই দুটি অংশের ধরণও আলাদা। খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারিরা বাইবেলের নতুন নিয়ম অনুসরণ করেন। বাইবেলের দুটি ভাগ-
- ওল্ড টেস্টামেন্ট বা, পুরাতন নিয়ম
- নিউ টেস্টামেন্ট বা, নতুন নিয়ম
পড়ুন- কুরআন অনুবাদের ইতিহাস
ওল্ড টেস্টামেন্ট বলতে যা বুঝায়
- প্রথম পাঁচটা বইকে বলা হয় তোরাহ
- দ্বিতীয়টি ইতিহাসের বই যা ইসরাইলি জাতির ইতিহাস বর্ণনা করে
- তৃতীয়টি ভালো ও মন্দ সম্পর্কে কাব্যিক জ্ঞানের বই
- চতুর্থটি বাইবেলের নবীদের কথা
নিউ টেস্টামেন্ট
নিউ টেস্টামেন্ট খ্রিস্টান বাইবেলের দ্বিতীয় অংশ। এটি মূলত যিশুর শিক্ষা, জীবনপযাপন এবং প্রাথমিক যুগের খ্রিস্ট ধর্ম নিয়ে আলোচনার বইয়ের সংগ্রহ। এই সংগ্রহে মোট ২৭ টি বই আছে। এগুলো যিশুর অনুসারী এবং শিষ্যদের লেখা। এখানে যিশুর নিজের বক্তব্যও পাওয়া যাবে। শুধু যিশুর নিজের বক্তব্য নিয়ে যে বাইবেল সেটিকে বলা হয় রেড লেটার বাইবেল।
যা বলছিলাম, নিউ টেস্টামেন্টের ২৭ টি বই হচ্ছে-
- ৪ টি ক্যানোনিকাল গসপেল
- ১ টি শিষ্যদের আচরণ সম্বলিত
- ১৪টি পৌলের(সন্ত পল) বই
- ৭টি ক্যাথলিক এপিস্টল
- ১ টি আপ্তবাক্য বা, দৈববাণীর বই
- Psalm বাইবেলের সবচেয়ে বড় অধ্যায়( হিব্রু বাইবেলে তৃতীয়)। এটিকেই মুসলিমরা যাবুর কিতাব বলেন, কারণ এটিই দাউদ(আঃ) এর কিতাব
- সবচেয়ে পুরনো Bible এর কপি পাওয়া যাবে ভ্যাটিকানের লাইব্রেরীতে
- যিশুর নামের হিব্রু উচ্চারণ দুটি- ইয়েসুস এবং ইয়েশুয়া। যিশুর ভাষা ছিল এরামাইক(হিব্রু ও আরবি এটা থেকে এসেছে)
- বুক অফ ওবাদিয়াহ সবচেয়ে ছোট বই
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশী ভাষায় অনুবাদ হওয়া বইয়ের নাম বাইবেল। ৩৩১২ টি ভাষায় এটি অনুবাদ হয়েছে(অন্তত একটি বই হলেও)।
ইভাঞ্জেলঃ
Do not be anxious about tomorrow, for tomorrow will be anxious for itself. Let the day’s own trouble be sufficient for the day.
খ্রিস্ট ধর্মে বাপ্তাইজম
বাপ্তাইজম বলতে বুঝায় খ্রিস্টধর্মে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার একটি পদ্ধতি। এটির মাধ্যমে বিশ্বাস ও স্বীকার করে নেয়া হয় যে বাপ্তাইজ ব্যক্তি যিশুর অনুসারী। খ্রিস্টের ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া এবং তিন দিন পর পুনরুত্থিত হওয়ার ঘটনা এর মাধ্যমে প্রতিকীরুপে মেনে নেয়া হয়।
প্রকাশ্যে বলা হয়-
“Go into the world. Go everywhere and announce the message of God’s good news to one and all. Whoever believes and is baptised is saved; whoever refuses to believe is damned.” Mark 16:16 MSG
যোহন বাপ্তাইজ
যোহন পৃথিবীতে এসেছিলেন যিশুর জন্মের আগে। তিনি খ্রিস্ট ধর্মের একজন গুরুতপূর্ণ ব্যাক্তিত্ব, বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টে তার একটি গসপেল রয়েছে। তার পিতার নাম সখরিয়া এবং মাতার নাম এলিজাবেথ।
এলিজাবেথ বৃদ্ধা বয়সে একটি সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন এবং তার নাম রেখেছিলেন যোহন যার অর্থ “ঈশ্বর প্রেমময়”। যোহন তার অনুসারীদের বাপ্তাইজ করতেন বলে তাকে এই নামে ডাকা হয়। তিনি যিশুর আগমনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন।
ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের পার্থক্য
একত্ববাদঃ সৃষ্টিকর্তাকে একজন মনে করা হয়
|
ত্রিত্ববাদঃ একমাত্র সৃষ্টিকর্তার তিনটি রূপের কথা ভাবা হয়।
|
মেসিয়াহ বলতে একজন সৎ রাজাকে বুঝানো হয় |
মেসিয়াহ বলতে এমন সত্ত্বাকে বুঝানো হয় যিনি সবার পাপের জন্য উৎসর্গ করেছেন, ঈশ্বর। |
অতীতের কোন পাপ নেই, সবার পাপের হিসাব প্রথম থেকেই শুরু হয়। | আদম এবং ঈভের সময় থেকে মানুষের পাপের হিসেব শুরু |
তোরাহ লিখিত এবং মৌখিক | তোরাহ শুধুই লিখিত রূপে আছে |
মুসার দশটি আজ্ঞা স্বর্গীয়, মানতেই হবে | মুসার আজ্ঞা মানার বাধ্যবাধকতা আমাদের নেই |
সব ভালো মানুষ স্বর্গে যাবে | শুধু খ্রিস্টানরা যাবে |
ইহুদিরা ঈশ্বরের বেছে নেয়া জাতি | আলাদা করে ইহুদি জাতির কোন গুরুত্ব নেই |
(তথ্যগুলো jewsforjudaism.orgনামে একটি ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করা)
এছাড়া বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টের কোন গুরুত্ব ইহুদিদের কাছে নেই, যিশু ইহুদিদের মত অনুযায়ী একজন সাধারণ ইহুদি রাবাই ছাড়া কিছুই ছিলেন না তার, জন্মের অলৌককতাও তারা বিশ্বাস করে না। সৃষ্টিকর্তাকে দুই ধর্মের মানুষেরাই ইয়েহওয়েহ নামে ডাকে।
কোশের খাবার, হানাকাহ, উপাসনা পদ্ধতি সহ আরো নানা পার্থক্য রয়েছে। আরো পার্থক্য চোখে পড়লে নিচের কমেন্ট বক্সে মন্তব্য করে জানান।
ইহুদিদের বিশ্বাস সম্পর্কে ডেভিড আব্রাহাম বলেছেন-
“Deny the Trinity; there is only one God; Jesus is not the Son of God or the Messiah; the Holy Spirit is not a person”
খ্রিস্টপূর্ব কাকে বলে?
খ্রিস্টপূর্ব বা, BC বলতে বুঝায় Before Christ অর্থাৎ, খ্রিস্টের জন্মের আগে। আর, খ্রিস্টাব্দ বলতে বুঝায় AD বা, Anno Domini বা, Year of the lord. এখানে যিশুকে স্রষ্টা হিসেবে মেনে নেয়া হয়। এই কারণে, ইহুদি এবং মুসলিমরা B.C. এবং A.D. এর বদলে ব্যবহার করে BCE এবং CE. BCE হচ্ছে Before Common Era এবং CE হচ্ছে Common Era. বাংলাতে যেহেতু লর্ড নেই, তাই আমরা খ্রিস্টাব্দ আর, খ্রিস্টপূর্ব অব্দ ব্যবহার করি।
যিশু খ্রিস্ট কি ঈসা নবী?
হ্যাঁ, যিশু খ্রিস্টই ঈসা নবী। যিশুর ভাষা ছিল এরামাইক, আর এরামাইক থেকে হিব্রু এবং আরবি ভাষা এসেছে। যিশুর নাম হিব্রুতে ইয়েসুস বা, ইয়েশোয়া। ইয়েসুস থেকে জেসুস থেকে জিসাস থেকে বাংলায় যিশু এসেছে। আর, খ্রিস্ট বলতে বুঝায় anointed one বা, মসীহ। ঈসা নবী আর, যিশু খ্রিস্ট যে একই ব্যক্তি তাতে কারো দ্বিমত নেই।
শেষ কথাঃ খ্রিস্ট ধর্ম বা, খ্রিস্টান ধর্ম যাই বলেন না কেন, এই ধর্মটি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী মানুষের বিশ্বাসের অংশ। ইসলাম ধর্মের যিশু একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, একজন বিখ্যাত নবী।
আরো পড়ুন-