কোরআন অনুবাদের ইতিহাস

গিরিশচন্দ্র সেন বিতর্ক

0

পবিত্র কুরআনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ করেছিলেন ভাই গিরিশচন্দ্র সেন- এই তথ্যটি আমাদের সবার জানা। সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে প্রথম অনুবাদক গিরিশচন্দ্র ছিলেন না, ছিলেন আমিরুদ্দীন বসুনিয়া। এই লেখাটিতে প্রশ্নের উত্তর খোজার চেষ্টা করবো।

তথ্যসূত্র হিসেবে উইকিপিডিয়া, উইকিসোর্স, স্বীকৃত সংবাদপত্র এবং বাংলাপিডিয়াকে ব্যবহার করবো– কারো বক্তব্য গ্রহণযোগ্য মনে হলে সেটিও গ্রহণ করবো। আপনারা কমেন্ট করে আপনাদের বক্তব্যও জানাতে পারেন।

অনুবাদক মাওলানা আমিরুদ্দীন বসুনিয়া

উৎস অনুসন্ধান করতে গিয়ে পাচ্ছি- ফেসবুক, ঢাকা পোস্ট, দৈনিক কক্সবাজার এবং একটি উইকিপিডিয়া আর্টিকেলে লেখা আছে বাংলায় কোরআন শরীফ প্রথম অনুবাদ করেন মাওলানা আমিরুদ্দীন বসুনিয়া এবং পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ করেন মাওলানা নাঈমুদ্দীন।

মাওলানা নাঈমুদ্দীন

দৈনিক কক্সবাজারে অধ্যাপক রায়হান উদ্দীন তার কলামে যা লিখেছেন সেটি অনেকটা এরকম-

গিরিশচন্দ্র সেন হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং তা প্রচারে সচেষ্ট হন। একজন মাওলানার কাছ থেকে তিনি ফারসি ভাষা এবং আরবি ব্যাকরণ শিখে আসেন। ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে আমিরুদ্ধীন বসুনিয়া অনুবাদ শুরু করেন। মাওলানা নঈমুদ্দীন ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে পূর্ণাঙ্গ কুরআন অনুবাদ করেন(ভাই গিরিশচন্দ্রের জন্ম ১৮৩৫ সালে)। (সূত্র উল্লেখ নেই)

নিউইয়র্ক থেকে ড. ওমর ফারুক সম্পাদিত দৈনিক ঢাকা পোস্টের একটি লেখায় দেখতে পাচ্ছি, ১৮৩৬ সালে নাঈমুদ্দীন পূর্ণাঙ্গ কুরআন অনুবাদ করেন এবং সেটি পুস্তক আকারে সন্নিবেশিত করে প্রকাশ করেন গিরিশচন্দ্র সেন ১৮৮৬ সালে। তাই তাকে আমরা প্রকাশক বলতে পারি।(সূত্রঃ সংগৃহীত)

উইকিপিডিয়াতে একটি আর্টিকেল আছে, সেখানে তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে ঢাকা পোস্ট, নিয়াজ রহমান নামে একজন ব্যাক্তির ফেসবুক পোস্ট, এবং নয়া দিগন্তের একটি আর্টিকেল(শাহজাহান আলী খান এর লেখা)। সেখানে মাওলানা নাঈমুদ্দীন নন(তাকে আংশিক অনুবাদক বলা হয়েছে), বরং, পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার মৌলভী আব্বাসউদ্দীন কে বলা হয়েছে প্রথম মুসলিম অনুবাদক(১৯০৭ সালে) ।

অনুবাদক গিরিশচন্দ্র সেন

দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায় ২০১৬ সালে জুবায়ের আলী জুয়েল এর একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তিনি দাবি করেছেন, ১৮৮০-১৮৮৬ এই সাত বছর পরিশ্রম করে ভাই গিরিশচন্দ্র সেন কুরআনের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন।

এর আগে আমিরুদ্দীন বসুনিয়া আমপারার কাব্যানুবাদ করেছিলেন ১৮০৮-১৮০৯ সালে। মাওলানা নঈমুদ্দীনও আংশিক অনুবাদ করেছেন। চব্বিশ পরগনার আব্বাস আলী নামের একজন মৌলভী মুসলিমদের মধ্যে প্রথম পবিত্র কোরআন শরীফের বঙ্গানুবাদ করেছিলেন ১৯০৭ সালে।

আগেও বলেছি, নয়া দিগন্তে শাহজাহান আলী খান এর লেখাতেও একই তথ্য পাওয়া যায়। মোহাম্মদ জাকারিয়া শাহীন নামে একজন লেখক, প্রাবন্ধিক যুগান্তর পত্রিকায় লিখেছেন– কুরআনের প্রথম অনুবাদ করেন গিরিশচন্দ্র সেন।

এর আগে আংশিক অনুবাদ অনেকেই করেছেন- আমিরুদ্দীন বসুনিয়া, তারপর কলকাতার আকবর আলী, রাজেন্দ্রনাথ মিত্র, খ্রিস্টান পাদ্রী তারাচরণ বন্দোপাধ্যায়, নঈমুদ্দীন, আকবর উদ্দীন, শ্রী ফিলিপ বিশ্বাস(খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে) এবং আরো কিছু নাম তিনি লিখেছেন।

অনেকগুলো নাম এই লেখাটিতে পাওয়া যাচ্ছেকালের কন্ঠ পত্রিকায় মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ বিস্তারিত লিখেছেন। সব লেখা পড়ার পরে এই লেখাটি আমার কাছে গোছানো এবং গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। তিনি ড. মুহাম্মদ হান্নান এর গবেষণার তথ্য তার লেখাতে ব্যবহার করেছেন। তার মতে, শাহ মুহাম্মদ সগীর প্রথম কিছু সূরার কাব্যানুবাদ করেছিলেন।

হয়তো এর আগে থেকেও কুরআনের বাংলা অনুবাদ হয়েছিল কিন্তু লিখিত আকারে প্রকাশিত হয় নি। ১৮৮১ সালে গিরিশচন্দ্র সেন প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করেন এবং লিখিত আকারে তা প্রকাশ করেন। মুসলিম সমাজে সেই কুরআন জনপ্রিয়তা পায় নি, তার কারণ সেখানে প্রচুর সংস্কৃতজাত শব্দ ছিল।

(হিন্দু ধর্মাবলম্বী কেউ লেখাটি পড়লে তার জন্য বলে রাখি- সংস্কৃতজাত শব্দে সমস্যা নেই, সমস্যাটা হচ্ছে শব্দে অংশিবাদ প্রকাশ পেলে- সেটা ছিল। যেমনঃ আল্লাহর বদলে ঈশ্বর বা, নামাজের বদলে উপাসনা শব্দের ব্যবহার মূল অর্থকে বদলে দিতে পারে)

কুরআন অনুবাদের ইতিহাস

আমরা এখানে বাংলা ভাষায় কুরআন অনুবাদের ইতিহাস বুঝাচ্ছি, অন্য কোন ভাষায় নয়। যেহেতু আমি মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহর দেয়া তথ্যে আস্থা রাখছি তাই ধারাক্রম তার কাছ থেকে গ্রহণ করেই আপনাদের কাছে উপস্থাপন করছি-

১৩৩৯– শাহ মুহাম্মদ সগীর(সূরার কাব্যানুবাদ)

১৬২০– আব্দুল হাকিম(বাংলা অনুবাদের তাগিদ দিয়েছেন)

১৮০৮– আমপারা পয়ার ছন্দে অনুবাদ

১৮৬৮– আকবর আলী(তরজমা আমছেপারা)

১৮৭৩– পাদ্রী তারাচরণ মিত্র(প্রথম ১২ পারা)

১৮৮১– গিরিশচন্দ্র সেন(পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ)

১৮৮৭– মাওলানা নঈমুদ্দীন(গিরিশচন্দ্র সেনের অনুবাদ মুসলিম সমাজে গৃহীত না হওয়ায় নতুন অনুবাদ করেন)

১৮৮৯– আকবর উদ্দীন

১৮৯১– ফিলিপ বিশ্বাস(মুসলিমদের হেয় করার উদ্দেশ্যে অনুবাদ করা হয়েছে এই অভিযোগে বাজেয়াপ্ত)

১৯০৫– মাওলানা আব্বাস আলী,মাওলানা আকরম খা

১৯০৮– রেভারেন্ড উইলিয়াম গোল্ডস্যাক(অপপ্রচারের উদেশ্যে ১২ বছর ধরে অনুবাদ সম্পন্ন করেন)

১৯১১– মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ সানী

১৯১৩-আলাউদ্দীন আহমদ

১৯১৪– মাওলানা খোন্দকার আবুল ফজল আবদুল করিম

১৯১৬– মুন্সী করিম বকশ

১৯১৭– আব্দুল ছাত্তার ছুফী(কাব্যানুবাদ)

১৯২০– মাওলানা এয়ার আহমদ এলটি

কালের কন্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাটিতে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তালিকা এবং সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আছে। নিচের তথ্যসূত্রে লিংক দেয়া আছে, কেউ চাইলে পড়ে দেখতে পারেন।

গিরিশচন্দ্র সেন কুরআন pdf

গিরিশচন্দ্র সেনের অনুবাদ দেখলেই বোঝা যায় সেটি কোন মুসলিমের লেখা না। যারা বলছেন গিরিশচন্দ্র সেন অনুবাদ করেন নি, তিনি প্রকাশক ছিলেন এবং মাওলানা নাঈমুদ্দীন এর অনুবাদ তিনি প্রকাশ করেছিলেন- আমি এই বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করছি।

মাওলানা নাঈমুদ্দীন পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করেছিলেন কি না, গিরিশচন্দ্র সেনের পরে অনুবাদ করেছিলেন কি না  এই বিতর্কে আমি কোন মত প্রকাশ করতে চাই না। এই ব্যাপারে তথ্য সর্বসম্মত নয়। যাদের গিরিশচন্দ্র সেনের অনুবাদ পড়ার ইচ্ছা আছে তারা pdf ডাউনলোড করে নিতে পারেন(পড়তেও পারেন)-

গিরিশচন্দের অনুবাদ ডাউনলোড

যে লিংকটি দিয়েছি সেটি উইকিসোর্সের, এটি ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাবলিক ডোমেইনের সম্পদ। কপিরাইটের নির্ধারিত মেয়াদ অর্থাৎ, ৬০ বছর শেষ হয়ে গিয়েছে।

স্পর্শকাতর একটি বিষয়ে মত প্রকাশ করলাম, অনিচ্ছাকৃত কোন ভুল হলে আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। মন্তব্যে যুক্তিসহ ভুল ধরিয়ে দিন- লেখাটি সংশোধন করা হবে

লেখাটি মতামত বিভাগের।

কুরআন শরীফের দাম কত?

বিভিন্ন অনলাইন মার্কেটপ্লেসে পবিত্র কোরআন শরীফ আরবিতে, বাংলা অনুবাদ এবং ইংরেজী অনুবাদ সহ কিনতে পাওয়া যায়। কাগজের কোয়ালিটি, প্রকাশক, অনুবাদক ভেদে দামের ভিন্নতা রয়েছে। 

যেমনঃ রকমারিতে আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলীর ইংরেজী অনুবাদ এবং বাংলা অনুবাদসহ আরবি কোরআন ৪৯০ টাকায় পাবেন, দারাজে বুকশপবিডির একটি পেপারব্যাক ভার্সন আছে যার দাম ৪০০ টাকা, আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলীর আরেকটা অনুবাদ আছে কালার কোডেড ইংরেজী যার দাম ১৯৯৮ টাকা। যারা স্বচ্ছল তারা এই অনুবাদটিও কিনতে পারেন। নূর বুকস এ ২০০-২০০০ টাকায় নানারকম অনুবাদ পাবেন। 

গিরিশচন্দ্র সেনকে যাদের কাছে প্রকাশক মনে হচ্ছে, তারা প্লিজ ঐ অনুবাদটি কিনে পড়ে তারপর বলুন মুসলিম কোন মাওলানা অনুবাদ করেছিলেন কি না- ৪৫০ টাকায় ঐ অনুবাদ পাওয়া যাচ্ছে রকমারিতে। 

 

তথ্যসূত্রঃ


Screenshot 3
বিজ্ঞাপনঃ বই কিনুন, বই পড়ুন

0

প্রবন্ধ লেখক

Author: প্রবন্ধ লেখক

বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ লেখার চেষ্টা করছি

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

গদ্য কবিতার বই প্রকাশ

কবিঃ মোঃ আরিফ হোসেন সর্দার বইয়ের নামঃ কনকচাঁপা দোদুল দোল মোট কবিতার সংখ্যাঃ ৮০টি মূল্যঃ মাত্র একশ' দশ টাকা প্রাপ্তিস্থানঃ

২০২৪ একুশে বইমেলায় আমার নতুন বই ( কনকচাঁপা দোদুল দোল) প্রকাশ ( আপডেট, ১৬ ফেব্রুয়ারী) )

অমর  একুশে বইমেলা ২০২৪ ( সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এ আমার  কবিতার বই প্রকাশ পেয়েছে । আমার লেখক আইডি - মোঃ আরিফ

নিন্দুক। সুমাইয়া আক্তার বৃষ্টি

আমাদের সমাজে বিচিত্র কিছু মানুষ রয়েছে। যারা অন্যের ভালো কিছুতেই দেখতে পারে না। কেউ যদি খারাপ পথ থেকে নিজেকে ফিরিয়ে
কনফেডারেশনঃ বিভক্ত মার্কিনীরা

কনফেডারেশনঃ বিভক্ত মার্কিনীরা

কনফেডারেশন শব্দটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কারও কাছে স্বর্গের মত আবার কারও কাছে নরকের চেয়েও খারাপ। এখন কথা হচ্ছে, কেন আমি কনফেডারেশন

One Reply to “গিরিশচন্দ্র সেন বিতর্ক”

Leave a Reply