নাস্তিক্যবাদ

নাস্তিকতাবাদ বা, নাস্তিক্যবাদ আসলে কেমন?

0

নাস্তিকতাবাদ বলতে আমরা এমন মতবাদকে বুঝি যেখানে ঈশ্বরের বা, কোন সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না। এর বাইরে আরো কতগুলো মত থাকতে পারে যেগুলো আমরা বাংলা ভাষায় সাধারণত ব্যবহার করি না।

অনেক সময় অবিশ্বাসী বুঝাতেও এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়, যেমন বেদে অবিশ্বাসীকে নাস্তিক বলা হয়। এমনকি ভূতে অবিশ্বাসীকেও নাস্তিক বলা হয়। ইসলাম ধর্মে অবিশ্বাসী, খ্রিস্ট ধর্মে অবিশ্বাসী এদেরকেও বলা হয়। আমরা ছোটবেলায় পড়েছি সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসীকে আস্তিক এবং সৃষ্টিকর্তায় অবিশ্বাসীকে নাস্তিক বলা হয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শিন্টো, তাও, বৌদ্ধ, জৈন এরকম আরো অনেক ধর্মে সুনির্দিষ্ট স্রষ্টার ধারণা নেই। এইসব ধর্মের অনুসারীদের সেই ধর্মের অনুসারীই বলা হয়।

নাস্তিক সমার্থক শব্দ?

নাস্তিক শব্দের অর্থ হচ্ছে যার ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই। এর সমার্থক শব্দ হচ্ছে- নিরীশ্বরবাদী, বেদবিরোধী, অবিশ্বাসী ইত্যাদি। ইসলামী পরিভাষায় আল্লাহকে যিনি অস্বীকার করেন তাকে বলা হয় কাফির(যার ঈমান বা, বিশ্বাস নেই), বেঈমান শব্দটিও একইরকম অর্থ বহন করে। নাস্তিক এবং কাফির শব্দ দুটিকে একই অর্থে ব্যবহার করা যায়।

নাস্তিক মানে কি?

প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাস করে না এমন কিছু মতবাদ থাকতে পারে। তাদের সবাইকে ঢালাওভাবে নাস্তিক বলাটা বোধহয় ঠিক না। চলুন দেখে নেই কেমন ধরণের বিশ্বাস মানুষের মাঝে থাকতে পারে-

  • সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নেই বলে মনে করা
  • সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব আছে কি না সেটা জানা সম্ভব না
  • সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব আছে কিন্তু পৃথিবীতে প্রচলিত কোন ধর্মই ঠিক না
  • মানুষ এবং সমগ্র জগত নিজেই সমষ্টিগতভাবে সব কিছুর স্রষ্টা এবং আলাদাভাবে সৃষ্ট বস্তু/প্রাণী

এক নম্বর দলের লোকদেরকে আমরা ইংরেজীতে Atheist এবং বাংলায় নাস্তিক এবং এই মতবাদকে নাস্তিকতা(Atheism) বলতে পারি। বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত নাস্তিক দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর সম্পর্কে পড়তে পারেন। এটি আসলে কোন ধর্ম নয়, ধর্মহীনতা। নাস্তিকতার কোন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেই।

দুই নম্বর মতবাদকে বলতে পারি অজ্ঞেয়বাদ বা, Agnosticism। সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব আছে কি নেই, তাতে এদের কিছু আসে যায় না। এরা বিশ্বাসও করে না, অবিশ্বাসও করে না। সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব এদের কাছে অনিশ্চিত।

তিন নম্বর মতবাদে বিশ্বাসী লোকদের ইংরেজীতে বলা হয় dissenter এবং বাংলায় বলা যেতে পারে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মবিরোধী(একবাক্যে অন্য কিছু বলা যায় মনে হলে কমেন্টে জানাবেন)। ইংরেজীতে বলা হয় Deism।

চার নম্বর দলের অনুসারীদের মতকে বলা যায় অসৃষ্ট(Non Creationalism) মতবাদ(জৈন ধর্মের অনুসারীরা এই মতে বিশ্বাসী)। এজন্য এটাকে ধর্ম না বলে অনেকে দর্শন বলেন, বৌদ্ধ ধর্মের ক্ষেত্রেও এমনটা বলা হয়। তবে, বৌদ্ধ ধর্মে ঈশ্বরের অস্তিত্ব ব্যক্তিরূপে না ভেবে নিয়মরূপে ভাবা হয়।

বাংলায় সংজ্ঞায়নের ক্ষেত্রে অনেক সময় সবগুলো গ্রুপকেই নাস্তিক বলা হয়, আমার মতে সেটি ঠিক না। আলাদা আলাদা বিশ্বাসের মানুষদের আলাদা নাম থাকা উচিত।

নাস্তিক দেশ

পৃথিবীতে অনেক দেশ আছে যেগুলোকে বাংলাদেশের মানুষেরা সাধারণত নাস্তিক দেশ বলে অভিহিত করে থাকে। অনেক মানুষ আছেন যারা নিজেকে একটি ধর্মের অনুসারী বলে পরিচয় দেন, পালন করেন কিন্তু বিশ্বাস করেন না। তিনি নিজে না বললে আসলে জানা সম্ভব না যে তার ধর্মীয় পরিচয় কি। উইকিপিডিয়াতে এরকম অনেক দেশের তালিকা আছে-

  • উত্তর কোরিয়া(৭১%)
  • জাপান(৫৭%)
  • হংকং(৫৬%)- চীনের অংশ
  • চীন(৫২%)
  • চেক প্রজাতন্ত্র(৭৫%)
  • এস্তোনিয়া(৬০%)

অস্ট্রেলিয়ার ৩০ শতাংশ মানুষ ধর্মে বিশ্বাস করেন না, আমেরিকার ২৪ শতাংশ, সৌদি আরবে ৫ শতাংশ নাস্তিক বলে নিজেদের দাবি করেছে।

সৃষ্টিকর্তাকে অবিশ্বাস করে এমন ধার্মিকও আছে

অজ্ঞতার কারণে অনেকে মোটা দাগে সব রকম মতবাদের মানুষদের নাস্তিক হিসেবে উপস্থাপন করেন যা সত্য নয়। বৌদ্ধ ধর্মের নিয়মতান্ত্রিকতা বা, জৈন ধর্মের স্রষ্টা এবং সৃষ্টির মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ার যে মত সেটি বেশ আকর্ষণীয়। এবং এটির সাথে পদার্থবিজ্ঞানের কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে মিলিয়ে আবার অনেকে কোয়ান্টাম মেথড, সমন্বিত চেতনা ইত্যাদি ধারণা তুলে ধরার চেষ্টা করেন। সংগত কারণে তাদের এই মতটাও জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

যারা পদার্থবিজ্ঞানের কোয়ান্টাম মেকানিক্স সম্পর্কে ধারণা রাখেন তারা জানেন যে, এটি শুধুই একটি বলবিদ্যা যা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। চেতন জগত নিয়ে কোয়ান্টাম মেকানিক্স কখনোই কাজ করে না। এর কাজ শুধুই প্রাণহীন জড় জগতের আচরণ নিয়ে।

আর, দৃশ্যমাণ বস্তুগুলোর ক্ষেত্রে নিউটনীয় বলবিদ্যা এখনও কার্যকর। পদার্থবিজ্ঞানীদের মতে Collective Consciousness এর ধারণা ভাওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই না। যারা ধর্ম এবং বিজ্ঞান সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখেন তারা কখনোই এই দুটির একটিকে দিয়ে আরেকটি প্রমাণের চেষ্টা করেন না।

প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে অবিশ্বাসীদের এর বাইরে আর কোন মত থাকতে পারে বলে এই মুহুর্তে আমার মনে হচ্ছে না। ঈশ্বরে বিশ্বাসীদের মাঝেও একেশ্বরবাদী, সর্বেশ্বরবাদী এবং আরো বিভিন্ন মত রয়েছে।

নাস্তিক সম্পর্কে ইসলাম কি বলে?

এই সম্পর্কে কোরআনের আয়াত কি বলে সেটি আপনাদের জানানোর চেষ্টা করবো। ইসলাম ধর্মের নানারকম গোষ্ঠীর মাঝে নানারকম মত প্রচলিত আছে। কিন্তু একমাত্র কোরআনের আয়াত যে কোন মাজহাবে বিশ্বাসী মুসলিমই মেনে নেবে। চলুন দেখে নেই কোরআনে কি আছে,

4:56: Those who reject (Kafaru) our Signs, We shall soon cast into the Fire

5:86: But those who reject Faith (Kafaru) and belie our Signs, – they shall be companions of Hell-fire.

3:4: Then those who reject Faith (Kafaru) in the Signs of Allah will suffer the severest penalty,

58: 4: For those who reject (Him) (Kafirin), there is a grievous Penalty.

58:5: And the Unbelievers (Kafirin) (will have) a humiliating Penalty,-

সবগুলো আয়াতেই দেখতে পাচ্ছেন, কুরআন অনুযায়ী অবিশ্বাসীরা আখিরাতে দোযখে যাবে। দুনিয়ার ব্যাপারে এমন কোন কিছু আমি খুজে পাই নাই। সুতরাং কেউ যদি কুরআনের বিশ্বাসী হয়ে থাকেন তিনি কখনোই অবিশ্বাসের কারণে কাউকে আক্রমণ করবেন না। কারণ কুরআনে আছে-

“বলো, “কাফিরেরা শোনো! তোমরা যা উপাসনা করো, আমি তা করি না।”- সূরা আল কাফিরুন

“তোমাদের ধর্ম তোমাদেরই থাকুক, আমার ধর্ম আমার” — আল-কাফিরুন

কাউকে খুন করে কেউ বেহেশতে যাবে কুরআনে এমন কোন নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না, বরং জাহান্নামের নিশ্চয়তা পাওয়া যায়। উমর (রাঃ) একসময় অবিশ্বাসী ছিলেন। জন্ম থেকে যারা মুসলিম না, তারা সবাই অবিশ্বাসী, কিন্তু মৃত্যু পর্যন্ত তারা কি সবার বিশ্বাস একই থাকে?

আল্লাহ যাদেরকে ভালোবাসেন দেখুন,

“Surely those who believe and do good, righteous deeds, the All-Merciful will assign for them love…” (Maryam 19:96)

অর্থাৎ, “অবশ্যই যারা বিশ্বাস করে এবং সৎকাজ করে, পরম করুণাময় তাদেরকে ভালোবাসেন“,- সূরা মারইয়াম।

মানুষ মারা বা, মানুষকে ঘৃণা করা কোন সৎ কাজ না। ভাই, বিশ্বাস করেন ব্লগারেরা ইসলাম প্রচারও করে। ব্লগ ডায়েরির মতো একটা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম যা সবাই পড়তে পারে, একার পড়ার জন্য না। এখানে ইসলামের বিরুদ্ধেও লেখা যায়, পক্ষেও লেখা যায়।

যদি বেহেশতে যেতে চান তাহলে কুরআন অনুসরণ করুন,

যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎ কর্ম সম্পাদন করে, তাদের অভ্যর্থনার জন্য আছে জান্নাতুল ফেরদৌস” ~সূরা আল কাহাফ, আয়াত ১০৭

রাসুলুল্লাহ(সাঃ) ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত পেয়েছিলেন, প্রথম যুদ্ধ করেছিলেন ৫৩ বছর বয়সে(১৩ বছর পর)। এবং সেখানে কোন ব্যক্তিগত ক্ষোভ ছিল না। কারো প্রতি গালাগালি বা, ইসলাম অমান্য করাও যুদ্ধের কারণ ছিল না। চুক্তিভঙ্গ, দেশছাড়া করা, ১৩ বছর ধরে মুসলিমদের উপর নির্যাতন করা এগুলোই ছিল কারণ।

আপনিও কি সেই নবীর আদর্শ অনুসরণ করেন যিনি অনেক অত্যাচার সহ্য করেও কাউকে আঘাত করেননি।  ৫৩ বছর বয়স পর্যন্ত যুদ্ধও করেননি। দুইবার নিজের ঘর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন তারপরেও আক্রমণাত্মক হন নি।

নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা

অতীশ দীপঙ্কর পাল আমলের একজন বিখ্যাত পন্ডিত এবং বৌদ্ধ ভিক্ষু ছিলেন। মুন্সিগঞ্জে অবস্থিত তার বাসস্থান এখনো নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা নামে পরিচিত। তিনি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। প্রসঙ্গত বলে রাখি, বৌদ্ধ ধর্ম কিন্তু নাস্তিক ধর্ম নয়। এই ধর্মে সৃষ্টিকর্তার ধারণা আব্রাহামিক ধর্মগুলোর মতো না।

তিনি পালি ও তিব্বতি ভাষায় অনেকগুলো বই লিখেছেন। অতীশ দীপঙ্কর তিব্বতে দীর্ঘকাল ধর্মপ্রচার করেছিলেন। বিবিসি বাংলার জরিপ অনুযায়ী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালিদের তালিকায় তার অবস্থান ১৮ নম্বরে। তিনি যেখানে গিয়েছেন সেখানে কৃষিকাজে উৎসাহ দিয়েছেন এবং পীড়িতদের সেবা করেছেন। পূর্ব এশিয়ায় বৌদ্ধ ধর্ম প্রসারে তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।

 

আরো পড়ুন-


Screenshot 3
বিজ্ঞাপনঃ বই কিনুন, বই পড়ুন

0

প্রবন্ধ লেখক

Author: প্রবন্ধ লেখক

বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ লেখার চেষ্টা করছি

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

যে রহস্যময় জলাশয়ে নামলেই যে কোনো প্রাণী পাথর হয়ে যায়।

পৃথিবীতে এমন একটি রহস্যময় জলাশয় রয়েছে যেখানে নামলেই যে কোনো প্রাণী পাথর হয়ে যায়। এটি কোন সাইন্স ফিকশন মুভির গল্প
ঘূর্ণিঝড়ের নামের তালিকা

২০২৩ সালের ঘূর্ণিঝড়ের নামের তালিকা

আমরা আইলা, নার্গিস, রোয়ানু ইত্যাদি ঝড়ের নামের সাথে পরিচিত। নতুন আরেকটি ঘূর্ণিঝড় এসেছিল যার নাম ফণি- এটির নামকরণ বাংলাদেশের করা।

বই বিপণন ব্যবস্থা বিষয়ক ভাবনা

একটি সুস্থ,সুন্দর জাতি গঠনের জন্য পড়া আবশ্যক।বর্তমানে পাঠক বইয়ের প্রতি ঝুঁকছে।ফলে বইয়ের ব্যবসাও জনপ্রিয় হয়ে এসেছে।কয়েক বছর আগেও বই প্রকাশনাকে

প্রবন্ধ লেখার ১০ টি অপরিহার্য নিয়ম

কোনো একটি বিশেষ ভাব বা তত্ত্বকে ভাষার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলাই হচ্ছে প্রবন্ধ। প্রবন্ধের মাধ্যমে কোনো বিষয়ের উপর বুদ্ধিভিত্তিক আলোচনা করা

Leave a Reply