বৌদ্ধ ধর্ম বা, দর্শন বলতে কর্মসাধনের এবং আধ্যাত্মিক উন্নতিলাভের এমন পথকে বুঝায় যার মাধ্যমে প্রকৃতির সত্য উন্মোচিত হয়। এই ধর্মের আচারগুলোর মধ্যে আছে ধ্যান যার মাধ্যমে সচেতনতা, দয়া এবং জ্ঞানের অগ্রগতি ঘটে।
ইতিহাসবিদদের মতে ২৫০০ বছর আগে সিদ্ধার্থ গৌতমের প্রচারিত একটি ধর্ম হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্ম। পূর্ব এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে বৌদ্ধ দর্শন বিভিন্নভাবে মানুষকে প্রভাবিত করেছে।
বৌদ্ধ ধর্মে ঈশ্বরঃ এই ধর্মে অন্যন্য একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোর মতো ঈশ্বরের ধারণা নেই(অর্থাৎ, ঈশ্বরকেন্দ্রীক নয়)। এর বদলে আছে নিয়মের ধারণা। কতগুলো নিয়মের অধীনে সারা বিশ্ব পরিচালিত হয়। এই ধর্মকে অনেকে শুধু দর্শন হিসেবে উপস্থাপন করতে চান, আবার অনেকে বলেন এটি অজ্ঞেয়বাদী ধর্ম।
বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তকঃ গৌতম বুদ্ধ যিনি অনেকবার পারমী পূর্ণ করে এসেছেন। সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধত্ব লাভ করেন। তিনিই এই ধর্মের প্রবর্তক
ধর্মের দর্শন
পশ্চিমা ধারণা অনুযায়ী এটিকে অনেক সময় ‘Religion’ হিসেবে দেখা হয় না, কারণ বৌদ্ধরা কোন নির্দিষ্ট ঈশ্বরের উপাসন করে না। এটি একটি দর্শন যা, যেকোন দেশের, যেকোন সময়ের যেকোন জাতির মানুষ গ্রহণ করতে পারে।
বৌদ্ধদের আচার-আচরণ এবং বিশ্বাসকে যেহেতু ‘Buddhism’ নামে ডাকা হয় সেহেতু চলুন এদের কিছু বৈশিষ্ট্য দেখে নেই-
- কোন পরম সত্ত্বার অস্তিত্ব এই ধর্মে নেই, তার বদলে আত্মিক প্রশান্তি এবং আলোকিত জীবনলাভই এই ধর্মের মৌলিক শিক্ষা। একটি নির্দিষ্ট আধ্যাত্মিক স্তরে পৌছানোকে বলা হয় নির্বাণ লাভ।
- ‘বুদ্ধ’ অর্থ আলোকিত। তিনি কোন ঈশ্বর, নবী বা, দেবতা নন- তবে একজন অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচিত।
- ধ্যান সত্যকে উন্মোচিত করে। তাই বৌদ্ধরা ধ্যান করে। উপরের ছবিতে ধ্যানরত বৌদ্ধমূর্তি দেখতে পাচ্ছেন
- হিন্দু ধর্মের(এখান থেকে হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে জানুন) মত এই ধর্মেও কর্ম এবং পুনর্জন্মের বিশ্বাস রয়েছে
- বৌদ্ধ ভিক্ষু ও সন্ন্যাসীরা বিশেষ আচার পালন করেন, একে বলা হয় কৌমার্যব্রত
- উপাসনালয় বা, বাড়িতে তারা উপাসনা করে থাকেন
- চারটি আর্য্য সত্য (দুঃখ- বাংলাপিডিয়া)
- দুঃখ আছে
- দুঃখের কারণ আছে
- দুঃখের শেষ আছে
- দুঃখ থেকে মুক্তিলাভের উপায় আছে
গৌতম বুদ্ধের মতে জগত দুঃখময়। আমাদের কামনা-বাসনা যত বাড়বে দুঃখ তত বাড়বে। অজ্ঞানতার হাত থেকে মুক্তি পেলেই দুঃখ থেকে নির্বাণ লাভ সম্ভব। এছাড়াও বৌদ্ধ ধর্মে অষ্টাঙ্গিক মার্গ এবং ত্রিশরণ মন্ত্র রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে পঞ্চশীল নীতি
অষ্টাঙ্গিক মার্গঃ
- সম্যক দৃষ্টি
- সম্যক সংকল্প
- সম্যক বাক্য
- সম্যক আচরণ
- সম্যক জীবিকা
- সম্যক প্রচেষ্টা
- সম্যক স্মৃতি
- সম্যক সমাধি
ত্রিশরণ মন্ত্র
- বুদ্ধং স্মরণং গচ্ছামি- পবিত্রতা ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ (বুদ্ধত্ব লাভ)
- ধর্মং স্মরণং গচ্ছামি- সত্য লাভ ও আধ্যাত্মিকতার বিকাশ
- সঙ্ঘং স্মরণং গচ্ছামি- পূর্ণ জ্ঞানের সাধনা যেখানে সম্যকভাবে করা যায়
পঞ্চশীল নীতি
এই নীতিগুলো সাধারণ মানুষদের জন্য, এছাড়া ভিক্ষু ও সন্নাসীদের জন্য আলাদা নীতি রয়েছে। চলুন পঞ্চশীল নীতিগুলো দেখে নেই-
- পঞ্চ ইন্দ্রীয়বিশিষ্ট প্রাণী হত্যা না করা
- পড়ে থাকা বস্তু না নেয়া
- অবৈধ কামাচার না করা
- মিথ্যা কথা না বলা
- মদ, গাঁজা সেবন না করা
বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের নাম কি?
বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ হচ্ছে ত্রিপিটক এবং সূত্র। এছাড়াও মৃতদের বই নামে তিব্বতে এক প্রকার বই পাওয়া যায়। ২০০০ এর বেশী সূত্র রয়েছে যেগুলো বৌদ্ধরা সবাই অনুসরণ না করলেও বিশেষ ধরণের বৌদ্ধরা অনুসরণ করে। ত্রিপিটকের তিনটি ভাগ রয়েছে- বিনয় পিটক, সূত্র পিটক এবং অভিধর্ম পিটক।
ধর্মীয় উৎসবঃ বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হিসেবে বৌদ্ধ পূর্ণিমা পালিত হয়।
কর্ম এবং পুনর্জন্মঃ কর্ম অনুযায়ী পুনর্জন্মের ধারণা বৌদ্ধ ধর্মে রয়েছে। গৌতম বুদ্ধ অনেকবার পুনর্জন্ম লাভ করেছিলেন এবং অবশেষে নির্বাণ লাভ করেন। গৌতম বুদ্ধ জাতিস্মরও ছিলেন, তার পূর্বজন্মের কথাগুলো তিনি মনে করতে পেরেছেন এবং ভক্তদের সেগুলো বলেও গেছেন।
জনসংখ্যার ভিত্তিতে এই ধর্ম পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম ধর্ম। আগেও বলেছি- দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পূর্ব এশিয়ায় বৌদ্ধ দর্শনের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।
বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের পার্থক্য
বৌদ্ধ ধর্ম | জৈন ধর্ম |
গৌতম বুদ্ধের জীবন ও শিক্ষাকেন্দ্রীক | মহাবীরের জীবন ও শিক্ষাকেন্দ্রীক, প্রথম প্রচারকের পরিচয় পাওয়া যায় না |
সব কিছুরই আত্মা আছে এই মতবাদে বিশ্বাস করে না | কাঠ, পানি সব কিছুরই আত্মা আছে |
প্রাণীহত্যা মহাপাপ, উপায় না থাকলে করা যাবে। | উপায় না থাকলেও প্রাণীহত্যা করা যাবে না |
শুধু গৌতম বুদ্ধই এই ধর্মের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব | চব্বিশজন তীর্থঙ্কর জৈন ধর্মের কেন্দ্রীয় চরিত্র |
ঈশ্বরের অস্তিত্ব সন্ধানের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাণলাভ, জগত নিয়মাধীন | সব কিছুর মাঝেই ঈশ্বর আছেন, সৃষ্ট বস্তু বা, বস্তুকণাই সম্মিলিতভাবে ঈশ্বর। |
কিছু প্রশ্নের উত্তর
পাঠকদের আগ্রহের ভিত্তিতে আরো কিছু প্রশ্নের উত্তর যোগ করছি। আশা করছি আপনাদের প্রশ্নের উত্তর এখানে পাবেন-
গৌতম বুদ্ধ কি নবী ছিলেন?
ইসলাম ধর্মমতে আল্লাহ পৃথিবীর সব জাতির কাছে তার বার্তা এবং বার্তাবাহক পাঠিয়েছেন। সেই হিসেবে বুদ্ধের জাতির কাছেও আল্লাহ বার্তাবাহক পাঠিয়েছেন। যারা আল্লাহর বার্তা মানুষের কাছে পৌছে দেয় তারাই ইসলাম ধর্মে নবী হিসেবে বিবেচিত হোন। যেমনঃ ঈসা, মূসা, ইব্রাহিম ইত্যাদি।
কোরআনে বুদ্ধের নামের কোন উল্লেখ নেই, তাই নিশ্চিতভাবে বলা যায় না যে তিনি নবী ছিলেন, একইসাথে ছিলেন না সেটাও বলা যায় না। মুসলিমদের মধ্যে কেউ যদি গৌতম বুদ্ধকে নবী বলে মনে করেন, এটি একান্তই তার ব্যক্তিগত মত।
বুদ্ধ কি হিন্দু ছিলেন?
অবশ্যই ছিলেন। নেপালের লুম্বিনী গ্রামের রাজপুত্র ছিলে সিদ্ধার্থ গৌতম। তিনি জন্মেছিলেন একটি হিন্দু পরিবারে। তাকে হিন্দু বলা যাবে কি না সেটি নির্ভর করছে আপনি হিন্দু ধর্মকে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করছেন তার উপর। যদি মনে করেন, আত্মার নিত্যতা স্বীকার করতে হবে, বেদকে স্বতপ্রমাণিত মনে করতে হবে, তাহলে গৌতম বুদ্ধ হিন্দু ছিলেন না।
আরো পড়ুন-
তথ্যসূত্রঃ
Buddhism – Britanica
Buddhism- History.com
What is Buddhism- The Buddhist Centre