আল-উস্তায ইমাম আব্দুল্লাহ বিন ইয়া’কূব বিন হারিস বিন খালীল আল হারেসী রহ.

0

আল-উস্তায ইমাম আব্দুল্লাহ বিন ইয়া’কূব বিন হারিস বিন খালীল আল হারেসী রহ.

 

📗 সংক্ষিপ্ত পরিচয়

 

হাফিয যাহাবী রহ. তাঁর কালজয়ী গ্ৰন্থ সিয়ারু আ’লামিন নুবালা’য় তাঁর পরিচয় এভাবেই দিয়েছেন-

 

الأستاذ الشَّيْخُ الإمامُ الفَقِيه العلّامة المُحَدِّث، عالِمُ ما وراء النَّهْر، أبُو مُحَمَّدٍ الأُسْتاذ عَبْدُ اللهِ بنُ مُحَمَّدِ بنِ يَعْقُوبَ بنِ الحارِثِ بنِ خَلِيلٍ الحارِثِيُّ البُخارِيُّ الكَلاَباذِيُّ الحَنَفِيُّ، المَشْهُورُ بِعَبْدِ اللهِ الأُسْتاذِ. مَوْلِدُهُ فِي سَنَةِ ثَمانٍ وخَمْسِينَ ومائَتَيْنِ.

 

আশ-শায়খ, আল-ইমাম, আল-ফক্বীহ, আল-আল্লামাহ, আল-মুহাদ্দিস, মাওয়ারান্নাহর (শহর) এর আলিম, আবূ মুহাম্মাদ আল-উস্তায আব্দুল্লাহ বিন ইয়া’কূব বিন হারিস বিন খালীল আল হারেসী আল-বুখারী আল-কালাবাযী আল-হানাফী। তিনি উস্তায আব্দুল্লাহ নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ। তিনি ২৫৮ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন।

 

حدَّث عَنْ عُبَيْدِ اللهِ بنِ واصل، وعَبْد الصَّمَدِ بنِ الفَضْلِ، وحمْدانَ بنِ ذِي النُّونَ، وأبِي مَعْشَر حَمْدُوَيْه بنِ خَطّاب، ومُحَمَّدِ بنِ اللَّيْثِ السَّرَخْسِيّ، وعِمْران بن فرينام، وأبِي الموجَّه مُحَمَّدِ بنِ عَمْرٍو المَرْوَزِيِّ، والفَضْل بن مُحَمَّدٍ الشَّعْرانِيِّ، ومُحَمَّدِ بنِ عَلِيٍّ الصّائِغ، وأبِي همّام مُحَمَّدِ بنِ خَلَفٍ النَّسَفِيِّ، ومُوسى بنِ هارون الحمّال، وأحمد بن الضوء، وجماعة.

 

তিনি হাদীস বর্ণনা করেছেন ‘উবায়দুল্লাহ বিন ওয়াসিল, আব্দুস সামাদ বিন ফজল, হামদান বিন যিন-নূন, আবূ মা’শার বিন খাত্তাব, মুহাম্মদ বিন লায়স আস সারাখসী, ইমরান বিন ফারীনাম, আবুল মুওয়াজ্জাহ মুহাম্মাদ বিন আমর আল-মারওয়াজী, ফজল বিন মুহাম্মাদ আশ-শা’রানী, মুহাম্মাদ বিন আলী আস-সায়েগ, আবূ হুমাম, মূসা বিন হারূন, আহমদ বিন দ্বাও’সহ একটি জামা’আত থেকে।

 

وعنه: أبو الطيّب عَبْدُ اللهِ بنُ مُحَمَّدٍ، ومُحَمَّدُ بنُ الحَسَنِ بنِ مَنصُور النَّيْسابُورِيّ، وأحْمَدُ بنُ مُحَمَّدِ بنِ يَعْقُوبَ الفارِسِيُّ، وأبُو عَبْدِ اللهِ بنُ مَندَة، وآخَرُونَ.

 

তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন আবূ ত্বায়্যিব আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ, মুহাম্মাদ বিন হাসান বিন মানসূর আন-নায়সাবূরী, আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন ইয়া’কূব আল-ফারেসী, আবূ আব্দুল্লাহ বিন মানদাহ প্রমূখ।

 

وحَدَّثَ عَنْهُ مِنَ المَشايِخ: أبُو العَبّاسِ بنُ عُقْدَة، وكانَ ابْنُ مَندَة يحسن القَوْلَ فِيهِ.

 

মাশায়েখদের মধ্যে তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন আবুল আব্বাস বিন ‘উকদাহ। আর ইবনে মানদাহ তাঁর ব্যাপারে ভালো ভালো (প্রশংসামূলক) কথা বলতেন।

 

[সিয়ারু আ’লামিন নুবালা: ১৫/৪২৪]

 

📗 আপত্তি ও জবাব

 

📒 ইমাম আবূ জুর’আহ

 

আপত্তি: ইমাম আবূ জুর’আহ তাঁকে য’ঈফ বলেছেন।

 

জবাব: এই আবূ জুর’আহ প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আবূ যুরআহ রাজী নন, বরং তিনি হচ্ছেন আবু যুরআহ আহমদ বিন হুসাইন (মৃত্যু: ৩৯০)। এই আবূ যুরআহকে ছোট আবূ যুরআহ বলা হয়। তিনি উল্লিখিত রাবী উস্তায হারেসীর ছাত্র। উস্তায হারেসী থেকে তিনি হাদীস শ্রবণ করেছেন। [সিয়ার: ১৭/৪৬]

 

তাছাড়া তিনি জারাহ-তা’দীলের ইমামও ছিলেন না; হামজাহ সাহমী ছাড়া তাঁর থেকে কেউ জারাহ-তা’দীল বিষয়ে জিজ্ঞেস করেননি। তদুপরি উস্তাযের য’ঈফ হওয়ার পক্ষে তিনি কোনো কারণও দেখাতে পারেননি যে, ঠিক কোন কারণে তিনি য’ঈফ!

 

কাজেই উস্তায সম্পর্কে তাঁর এ বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য। কারণ, জারাহ-তা’দীলের সুপ্রসিদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য ইমাম নয় এমন ব্যক্তির ‘মুবহাম জারাহ’ গ্রহণযোগ্য নয়।

 

📒 ইবনুল জাউযী

 

আপত্তি: ইবনুল জাউযী উস্তায হারেসীকে হাদীস জালে অভিযুক্ত করেছেন।

 

জবাব: তিনি নিজ থেকে কোনো ধরনের অভিযোগই করেননি। বরং তিনি ‘আবু সা’ঈদ রাওয়াস’ নামক এক মাজহূল (অজ্ঞাত) ব্যক্তির বক্তব্য নকল করেছেন মাত্র। তিনি বলেন-

قالَ أبُو سعيد الرواس كانَ يتهم بِوَضْع الحَدِيث

আবু সা’ঈদ রাওয়াস বলেছেন, তাঁর ব্যাপারে হাদীস জালের অভিযোগ করা হয়েছে।

 

দেখুন তাঁরই রচিত [আয-যুআফা: ২/১৪১ এবং লিসানুল মীযান, তারীখুল ইসলাম]

 

আর নিজের কিতাবে কারো বক্তব্য নকল করা মানেই তা লেখকের নিজের বক্তব্য হয়ে যায় না।

 

উল্লেখ্য: উস্তায হারেসীর মৃত্যু ৩৪০ হিজরী আর ইবনুল জাউযীর মৃত্যু ৫৯৭। উভয়ের মৃত্যুর দূরত্ব ২৫৭ বছর। ইবনুল জাউযীর কাছে রাওয়াস নামক অজ্ঞাত লোকের বক্তব্য ছাড়া আর কোনো দলীল নেই।

 

প্রাসঙ্গিক: ইবনুল জাওযীর ব্যাপারে আহলে হাদিস ওলামাদের মন্তব্য হচ্ছে,

 

ابن الجوزي الذي لم يكن أقل منه تعصبًا وحدة لمذهب الحنابلة

 

ইবনুল জাওযী হাম্বলী হিসেবে খতীবে বাগদাদীর চেয়ে কম গোঁড়াপন্থী ছিলেন না। [আহলে হাদীস ফোরাম আর্কাইভ: ১৩/৬৩, ৪৫/৪৩৬]

 

আর হাদীস শাস্ত্রে অধিক গোঁড়াপন্থী কারো কথা অন্য মাযহাবীদের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হয় না।

 

📗 আবু সা’ঈদ রাওয়াস (যার থেকে ইবনুল জাউযী এ কথা নিয়েছেন)

 

আপত্তি: আবু সা’ঈদ রাওয়াস বলেছেন,

 

كانَ يتهم بِوَضْع الحَدِيث

 

তাঁর ব্যাপারে হাদীস জালের অভিযোগ করা হয়েছে। [আয-যুআফা —ইবনুল জাওযী: ২/১৪১]

 

জবাব: আবু সা’ঈদ রাওয়াস, তিনি সম্পূর্ণ মাজহুল বা অজ্ঞাত লোক। তার সম্পর্কে ইতিহাস আজও কোনো হদিস পায়নি, তিনি আসলে কে? তার অবস্থানই বা কী? আর দ্বীনের ক্ষেত্রে কোনো অজ্ঞাত লোকের কথা ধর্তব্য নয়।

 

তাছাড়া, হারেসীকে যদি সত্যিই হাদিস জালে অভিযুক্ত করা হতো তাহলে বড় বড় ইমামগণও বিষয়টি জানতেন এবং নিজেদের কিতাবেও উল্লেখ করতেন। অথচ এই অজ্ঞাত আবু সাঈদ রাওয়াস ব্যতীত কেউই হারেসী সম্পর্কে হাদীস জালের অভিযোগ তোলেনি। এত বড় একটি সত্য কি অজ্ঞাত আবু সাঈদ ব্যতীত আর কেউই জানতে পারেনি?

 

📗 অন্যদের অভিযোগ

 

জবাব —১: এরপর যারাই তাঁর ব্যাপারে হাদীস জাল করার অভিযোগ করেছেন, সবাই এই অজ্ঞাত ব্যক্তির কথা থেকেই ধার করে বলেছেন। এর বাইরে কোনো ইমামের বক্তব্য দেখাতে পারবে না কেউ।

 

জবাব —২: হাদীস জালের এই অভিযোগ ‘মাজহুল সীগা’য় বর্ণিত হয়েছে। এই অভিযোগ কে বা কারা করেছে, আদৌ এর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। মূলত এই অভিযোগের কোন ভিত্তিই নেই।

 

যদি তিনি সত্যিই হাদিস জাল করে থাকবেন, তাহলে রিজাল শাস্ত্রের কিতাবাদীতে ইমামগণের নামসহ বিষয়টি উল্লেখ থাকতো। অবশ্যই কোনো না কোনো একজন নির্দিষ্ট ইমাম তো সুস্পষ্টভাব বলতেন যে হারেসী হাদীস জাল করেছে। অথচ নির্দিষ্টভাবে কোনো ইমামের নাম উল্লেখ করতে পারেনি কেউই; কেবল গড়পড়তা বলা হচ্ছে, তার ব্যাপারে হাদিস জালের অভিযোগ করা হয়েছে।

 

কিন্তু অভিযোগ করলোটা কে? তার/তাদের পরিচয়টা কী? তারা গ্রহণযোগ্য নাকি নিজেরাই অগ্রহণযোগ্য! সব কিছুই অজ্ঞাত। একে তো রাবি নিজেই অজ্ঞাত, অন্যদিকে হাদিস জালের অভিযোগ কে করেছে সেটাও অজ্ঞাত। অতএব, এমন অজ্ঞাত অভিযোগের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই।

 

মোটকথা: নির্দিষ্ট কোনো ইমাম তাঁকে হাদীস জালের অভিযোগ করেছে এমন কোনো উক্তি দেখানো যাবে না। আর ইবনুল জাওযীর মতো ব্যক্তি তাঁর ব্যাপারে হাদীস জালের অভিযোগ নিচ্ছেন কোনো মাজহূল/অজ্ঞাত ব্যক্তি থেকে! বুঝুন তাহলে, তাঁর ব্যাপারে জারাহের কত অভাব ছিল যে শেষমেষ একজন অজ্ঞাত ব্যক্তি থেকে তাঁর জারাহ নেওয়া হচ্ছে।

 

📗 খতীবে বাগদাদী

 

তিনি তাঁর ব্যাপারে আশ্চর্যজনক ঘটনা বর্ণনার অভিযোগ করেছে।

 

জবাব —১: কোন আশ্চর্যজনক ঘটনা, সেটার উল্লেখ করা হয়নি। আর আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে থাকলে তার বর্ণনা করতে সমস্যা কোথায়?

 

জবাব —২: খতীবে বাগদাদীর জারাহ গ্রহণযোগ্য নয়।

 

তাঁর ব্যাপারে আহলে হাদীস ওলামাদের মন্তব্য

 

فالخطيب البغدادي كان شافعيًا متعصبًا على الأحناف والحنابلة. وقد رد عليه ابن الجوزي الذي لم يكن أقل منه تعصبًا وحدة وغيره. قال الحافظ السَّلفي ابن عبد الهادي الحنبلي (ت٩٠٩هـ) في «تنوير الصحيفة»: «لا تَغتَرّ بكلام الخطيب، فإن عنده العصبية الزائدة على جماعةٍ من العلماء كأبي حنيفة وأحمد وبعضِ أصحابه. وتحاملَ عليهم بكل وجه. وكثير من الأقوال التي نقلها الخطيب في ذم أبي حنيفة لا تصح. وصنَّف فيه بعضُهم «السهم المصيب في كَبِد الخطيب»

 

খতিবে বাগদাদী অত্যন্ত গোঁড়াপন্থী/কট্টর শাফে’ঈ ছিলেন। তিনি হানাফী এবং হাম্বলীদের প্রতি প্রচুর বিদ্বেষ পোষণ করতেন। আর ইমাম ইবনুল জাওযী প্রমূখ এসবের প্রতিবাদও করেছেন —যদিও ইবনুল জাওযী নিজেও হাম্বলী হিসেবে তাঁর চেয়ে কম গোঁড়াপন্থী ছিলেন না। হাফেয সালাফি ইবনে আব্দুল হাদী আল হাম্বলী (৯০৯ হি.) ‘তানভীরুস সহীফাহ’ নামক গ্রন্থে বলেন, খতীবে বাগদাদীর (এসব আজগুবি) কথাবার্তায় ধোঁকা খাওয়া উচিত নয়, কারণ তাঁর মধ্যে অধিক পরিমাণে স্বদলপ্রীতি ছিলো। এবং উলামাদের এক জামাতের উপর তার বিশেষ হিংসা/শত্রুতা ছিলো। যেমন: ইমাম আবু হানীফা, আহমদ বিন হাম্বল এবং কিছু কিছু হাম্বলী উলামায়ে কেরামের প্রতি। সর্ব ক্ষেত্রেই তিনি তাদের বিরোধিতা করতেন।

 

আর খতীবে বাগদাদী ইমাম আবু হানীফার নিন্দায় এমন অসংখ্য কথাবার্তা নকল বর্ণনা করেছেন যেগুলো আদৌ সহীহ নয়। তাঁর এসব গোঁড়ামী নিয়ে ওলামাগণ গ্রন্থও রচনা করেছেন। (তেমনি একটি গ্রন্থের বাংলা নাম হচ্ছে) “খতীবের কলিজায় অব্যর্থ তীরের আঘাত”। [আহলে হাদীস ফোরাম আর্কাইভ: ১৩/৬৩, ৪৫/৪৩৬]

 

📗 ইমাম বায়হাকির অভিযোগ [সবচেয়ে শক্তিশালী অভিযোগ]

 

তিনি উস্তায হারেসী বর্ণিত একটি হাদীস – مَن كانَ لَهُ إمامٌ فَقِراءَةُ الإمامِ لَهُ قِراءَة – উল্লেখ করে বলেছেন- فَإنَّهُ كَذّاب، لا يُحْتَجُّ بِهِ।

 

হারেসী মিথ্যুক; তাঁর কথার দ্বারা দলীল দেওয়া যাবে না! [খিলাফিয়াত: ২/৪৮২]

 

তিনি নিজের পক্ষে দলীল দিয়েছেন-

 

أبُو عَبْدِ اللَّهِ الحافِظُ، قالَ: سَمِعْتُ أبا أحْمَدَ الحافِظَ يَقُولُ: كانَ عَبْدُ اللَّهِ الأُسْتاذُ يَنْسِجُ الحَدِيثَ

 

আবূ আহমদ হাকিম আন-নায়সাবূরী (৪০৫) বলেছেন- উস্তায আব্দুল্লাহ হারেসী হাদীস বুনন (তৈরি/জাল) করতেন। [খিলাফিয়াত: ২/৪৮২]

 

📗বায়হাকীর ভ্রান্তি ও জবাব

 

ইমাম আবূ আহমদ হাকিম আন-নায়সাবূরী (৪০৫) কখনোই এমন কথা বলেননি। আমরা এখন দেখবো, তিনি আসলে কী বলেছিলেন?

 

ইমাম হাকিম রহ. বলেছিলেন—

 

أبا أحْمَدَ الحافِظُ يَقُولُ: كانَ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ يَعْقُوبَ الأُسْتاذُ يُثَبِّجُ الحَدِيثَ

 

উস্তায আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন ইয়া’কুব হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে ‘তাছবীজ’ করতেন। [কিরাআত খালফাল ইমাম: ১/১৭৮]

 

অর্থাৎ, ইমাম হাকিম মূলত তাঁর ব্যাপারে يثبج (তাছবীজ) শব্দ ব্যবহার করেছেন। মানে হারেসী হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে ‘তাছবীজ’ করতেন। অথচ ইমাম বায়হাকী يثبج (তাছবীজ)-কে ينسج (জাল) বানিয়ে ফেলেছে —যা মারাত্মক পর্যায়ের ইলমী খিয়ানত। কারণ, হাদিস শাস্ত্রে এ দুটি শব্দ (يثبج ও ينسج) এর আলাদা আলাদা অর্থ এবং দুটি শব্দই আলাদা আলাদা পরিভাষার অন্তর্ভুক্ত।

 

📗 তাছবীজ কী?

 

হাদীস শাস্ত্রের সাথে সম্পর্ক রাখে এমন সবাই জেনে থাকবেন যে- يثبج الحديث বা ‘তাছবীজ’ পরিভাষাটি হাদীস জালকারীর জন্য ব্যবহার করা হয় না। আর মুহাদ্দিসগণও يثبج الحديث দ্বারা হাদীস জালকারী বোঝান না।

 

বরং হাদিস শাস্ত্র ‘তাছবীজ’ এর অর্থ হচ্ছে, لا يأتي به على وجهه তথা হাদিসকে বর্ণনাকারীর বলা হুবুহু শব্দে ব্যক্ত না করে নিজের ভাষায় ব্যক্ত করা। [তারীখুল কাবীর: ১/৩৫৯ এর ৫ নং টীকা দ্রষ্টব্য। আল-কাশিফ —যাহাবী: ১/১৬৩]

 

অভিধানেও ‘তাছবীজ’ অর্থ লেখা হয়েছে, الكلام لم يأتِ به على وجهِه অর্থাৎ কথাকে কথকের বলা হুবুহু শব্দে ব্যক্ত না করে নিজের ভাষায় ব্যক্ত করা। [মাকায়ীসুল লুগাহ: সংশ্লিষ্ট শব্দ দ্রষ্টব্য]

 

📗 ‘তাছবীজ’ সম্পর্কে আহলে হাদীস ওলামায়ে কেরামের মন্তব্য

 

ومعنى’يثبج’: لا يأتي به على وجهه / يُثبِّج الحديث، معناه: لا يأتي به على وجهه

 

অর্থাৎ, (يثبج الحديث) বা ‘তাছবীজ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে, বর্ণনাকারীর বলা (হুবুহু) শব্দে ব্যক্ত না করা। [আহলে হাদীস ফোরাম আর্কাইভ: ৫০/৬৭]

 

আর এই বিষয়টি স্বাভাবিক, কারণ আমরা যখন কোনো কিছু শুনি, পরে কিন্তু হুবহু ঐ শব্দে ব্যক্ত পারি না বরং নিজস্ব ভাষায় ব্যক্ত করে থাকি। এটাতো সাধারণ ক্ষেত্রে বলা হয়েছে। হাদিসের ক্ষেত্রেও ইমামগণ এমনটি করতেন। এমনকি কোনো কোনো শহরের সকলেই হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে ‘তাছবীজ’ করতেন। যেমন—

 

আহমদ বিন হাম্বল আব্দুর রাজ্জাক থেকে বর্ণনা করেন, মা’মার বলেন, আমি সানআ’র এমন কাউকেই দেখেনি —যে হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে ‘তাছবীজ’ করে না, কেবল খাল্লাদ বিন ইবরাহীম ছাড়া। অর্থাৎ খাল্লাদ বিন ইবরাহীম ছাড়া সানআ’র সকলেই হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে ‘তাছবীজ’ করে। [তারীখুল কাবীর: ৩/১৮৭, তারীখে ইবনে আবী খায়সামাহ: ১১৭৯]

 

এটি যদি স্বাভাবিক না হবে, তাহলে সবাই কেন এ কাজটি করতো?

 

অতএব, উস্তায হারেসীও হয়তো স্বাভাবিকভাবেই এমনটা করতেন, যেমনটা অন্যরাও করতো। এজন্যই তাঁর ক্ষেত্রে হাদীস জালকারী না বলে বরং يثبج الديث বলা হয়েছে অর্থাৎ তিনি হাদিসের মূল শব্দ রেখে নিজস্ব ভাষায় তা ব্যক্ত করতেন।

 

📗 এই শব্দটি কখনোই জাল করা অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে না

 

কারণ, (يثبج الحديث) শব্দের অর্থ যদি হাদীস জাল করা হয় তাহলে মহান ইমাম ওয়াকীও হাদীস জালকারী!

 

আহমদ বিন হাম্বল বলেন, وكِيع رجل يثبج الحَدِيث — ওয়াকী তো এমন লোক যে হাদীস ‘তাছবীজ’ (জাল) করেন। [আল-ইলাল: ১/৩৭১]

 

‘তাছবীজ’ শব্দের অর্থ যদি হাদীস জাল করা ধরা হয় তাহলে ‘সানআ’ শহরের একজন ব্যতীত সবাই হাদীস জালকারী ছিলেন।

 

قال أحمد بن حنبل، عن عبد الرزاق قال: قال معمر ما رأيت أحدًا بصنعاء إلا وهو يثبج الحديث إلا خلاد بن عبد الرحمن.

আহমদ বিন হাম্বল আব্দুর রাজ্জাক থেকে বর্ণনা করেন, মা’মার বলেন, খাল্লাদ বিন ইবরাহীম ছাড়া সানআ শহরের সকলেই হাদীস ‘তাছবীজ’ (জাল) করে। [তারীখুল কাবীর: ৩/১৮৭, তারীখে ইবনে আবী খায়সামাহ: ১১৭৯]

 

কিন্তু আসলেই কি তাই? সব্বাই হাদিস কি জাল করতেন! সব্বাই মিথ্যুক? কই কেউ তো তাদেরকে মিথ্যুক বলে না! একজনই কেবল মিথ্যুক হলেন! আল্লাহর ফানাহ!

 

একই দোষে সবাই দোষী

কাঠগড়ায় কেবল উস্তায হারেসী

 

📗

 

তাছাড়া يثبج الحديث এই একই শব্দটা ইমাম বুখারী ইসমাইল ইবনে শারুস এর জন্যও ব্যবহার করেছেন। [দেখুন, তারীখুল কাবীর: ১/৩৫৯] আহমাদ বিন হাম্বল ইমাম ওয়াকির জন্য ব্যবহার করেছেন, মা’মার পুরো সানআবাসীর জন্যেও একই শব্দ ব্যবহার করেছেন —যেমনটা মাত্র উল্লেখ করলাম। অথচ হাদীস শাস্ত্রে তাঁদের কাউকেই হাদিস জালকারী বলা হয় না। বরং ইমামগণের নিকট তাঁরা সকলেই সিকাহ/গ্রহণযোগ্য। তাহলে কেবল উস্তায হারেসী কেনো হাদিস জালকারী বা মিথ্যুক হবেন?

 

হবেন, কারণ তিনি যে হানাফী!

 

📗

 

যাইহোক, আফসোস তো তখনই লাগে, যখন ইমাম বায়হাকির মত ব্যক্তি يثبج الحديث -কে ينسج الحديث বানিয়ে দেয়। এবং নিজের ভুলের উপর ভিত্তি করেই কাউকে হাদীস জালকারী ও মিথ্যুক সাব্যস্ত করে।

 

তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, তিনি তাঁর অন্য গ্ৰন্থে সঠিক শব্দটাই লিখেছেন-

 

قالَ: لَنا أبُو عَبْدِ اللَّهِ: فَسَمِعْتُ أبا أحْمَدَ الحافِظُ يَقُولُ: كانَ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ يَعْقُوبَ الأُسْتاذُ يُثَبِّجُ الحَدِيثَ

 

উস্তায আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন ইয়া’কুব হাদীস বর্ণনায় ‘তাছবীজ’ করতেন।

 

দেখুন, কিরাআত খালফাল ইমাম: ১/১৭৮ —লেখক: ইমাম বায়হাকি। অথচ সেই তিনিই অন্য কিতাবে গিয়ে বিষয়টা গুলিয়ে ফেলেছেন!

 

📗

 

আর একটা বিষয় লক্ষ্য করুন, ইমাম হাকিম উস্তায হারেসীর জন্য يضع الحديث (হাদীস জালকারী) শব্দটি ব্যবহার করেননি; বরং يثبج الحديث (তাছবীজ) শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এর থেকে বোঝা যায়, তাঁর দৃষ্টিতে তিনি হাদীস জালকারী ছিলেন না। তাঁকে যদি ইমাম হাকিম হাদিস জালকারী বলতে চাইতেন তাহলে يثبج ‘তাছবীজ’ বলার প্রয়োজন হতো না বরং সরাসরি يضع (জাল) শব্দই ব্যবহার করতেন। কারণ, হাদিস জালকারী বোঝাতে সাধারণত يضع শব্দটাই ব্যবহার করা হয়।

 

📗তাছবীজ (يثبج الحديث) ও জাল (يضع الحديث) এর মধ্যে পার্থক্য

 

‘তাছবীজ’ তথা يثبج الحديث এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতে গেলে প্রায় ছয় হাজার শব্দের তিনটি বড় বড় পোস্ট লিখতে হবে। কিন্তু বিষয়টি বাহুল্য মনে হচ্ছে। তবে খুশির ব্যাপার হচ্ছে, হুবুহু এই বিষয়টি নিয়েই আহলে হাদিস ফোরাম আর্কাইভে অসাধারণ একটি প্রবন্ধ রয়েছে। আগ্রহীগণ পড়ে নিতে পারেন। প্রবন্ধটি মনোযোগ দিয়ে পড়লে আশা করা যায় চোখের পর্দা থেকে ধুলোবালি অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যাবে। আল্লাহ সহায় হোন।

 

[দ্বিতীয় পর্ব দেরীতে হলেও আসতে পারে ইন-শা-আল্লাহ]

 

লুবাব হাসান সাফওয়ান


Screenshot 3
বিজ্ঞাপনঃ বই কিনুন, বই পড়ুন

0

লুবাব হাসান সাফ‌ওয়ান

Author: লুবাব হাসান সাফ‌ওয়ান

লুবাব হাসান সাফ‌ওয়ান। ঠিকানা: নোয়াখালী। কর্ম: ছাত্র। পড়াশোনা: আল-ইফতা ওয়াল হাদীস [চলমান] প্রতিষ্ঠান: মাদরাসাতু ফায়দ্বিল 'উলূম নোয়াখালী।

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

কবিতা আল কোরআনের প্রতীক আফছানা খানম অথৈ

আল কোরআনের প্রতীক আফছানা খানম অথৈ মা আমেনার গর্ভেতে জন্ম নিলো এক মহামানবের, নাম হলো তার মুহাম্মদ রাসুল আসলো ভবের

ফোরাত নদীতে স্বর্নের পাহাড় আফছানা খানম অথৈ

ফোরাত নদীতে স্বর্নের পাহাড় আফছানা খানম অথৈ ইমাম মাহাদী (আ:) আগমনের পূর্বে ফোরাত নদীর তীরে স্বর্নের পাহাড় ভেসে উঠা কেয়ামতের

কবিতা দাজ্জাল আফছানা খানম অথৈ

দাজ্জাল আফছানা খানম অথৈ কেয়ামতের পূর্বে দাজ্জাল আসবে নিজেকে খোদা বলে দাবি করবে, কাফের মুনাফিক যাবে তার দলে ঈমানদার মুমিন

গল্প হযরত মুহাম্মদ (সা:) জীবনের গল্প আফছানা খানম অথৈ

জন্ম:হযরত মুহাম্মদ (সা:) বর্তমান সৌদি আরবে অবস্থিত মক্কা নগরীর কুরাইশ গোত্রে বনি হাশিম বংশে ৫৭০ খৃষ্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন।তার পিতার

Leave a Reply