বাল্য বিয়ের কুফল
আফছানা খানম অথৈ
টুনি পঞ্চম শ্রেনিতে পড়ে। বয়স বারো কিংবা তেরো হবে।গায়ের রং ফর্সা বডি ফিটনেস ভালো। বয়স অনুপাতে তার বডি যতটুকু বাড়ার ততটুকু বেড়েছে। মোটামুটি ভালোই লাগছে তাকে।
কি বোঝেন এতটুকুন মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করেছে।
টুনির বাবা ধনকুবের, কৃপন ও লোভী স্বভাবের। পারলে মেয়েকে আজই বিয়ে দিয়ে দেয়। কারন তার ধারণা মেয়েকে পাত্রস্ত করতে পারলে বাঁচি। যেমন খাওয়া পরা, লেখাপড়ার খরচ, ইত্যাদি।
শুধু যে তার মাথায় এ ধারণা উৎপেতে বসেছে তা নয়। আর ও অনেক অনেক শিক্ষিত অবিভাবক আছেন এ ধারণার আওতাধীন। তারা মেয়দেরকে সব সময় বোঝা মনে করেন।
টুনি সবেমাত্র স্কুল থেকে ফিরল। এখন ও জামা কাপড় পাল্টাইনি।এমন সময় দু’জন মহিলা এসে তাকে একটা নাকফুল পরিয়ে দিয়ে বলল,
ভাইজান মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে।আপনার কিছু দেয়া লাগবে না। মেয়েকে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে যাবো। এবার দিনক্ষন ঠিক করেন।
খুশিতে গদগদ ধনকুবের কৃপন মিরন।তিনি আপন মনে বলেন,
বর্তমানে ছেলেদের যে পাওয়ার, নগদ টাকা পাত্রের হাতে গুনে দিতে হয় তারপর বিয়ে।
আর আমার মেয়েকে কিনা উনারা ফ্রি নিয়ে যাবে।
এ সুযোগ কখন ও হাত ছাড়া করা যাবে না। অমনি তিনি খুশিতে নাচতে নাচতে বলে উঠলেন,
শোকর আলহামদুলিল্লাহ এ বিয়েতে আমার কোন আপত্তি নেই। আগামী শক্রবার বাদ জুম্মা মসজিদে বিয়ে হবে।
এদিকে পঞ্চম শ্রেনিতে পড়া টুনির বিয়ে।
খবরটা এলাকাতে ছড়িয়ে পড়ল। ইয়্যং সচেতন যুবক মুজিব ক্ষেপে উঠে বলল,
কি পঞ্চম শ্রেনিতে পড়া মেয়ের বিয়ে! এতো বিয়ে নয় একটা মেয়ের জীবন ধ্বংস করে দেয়া। চলুন দেখি,সে তার বয়সী কয়েক জনকে নিয়ে রওয়ানা করল।
ততক্ষণে মজলিসে সবাই আসন পেতে বসল। দু’পক্ষের লোকজন উপস্থিত।মৌলবীসহ সবাই বিয়ে পড়ানোর জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। এমন সময় মুজিব তার দলবল নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলো। তারপর বলে উঠল,
মৌলবী সাহেব এ বিয়ে পড়া বন্ধ করুন।
কেন কেন?,
বাল্য বিবাহ আইনত নিষিদ্ধ তাই।
টুনির বাবা ক্ষেপে উঠে বলল,
আমার মেয়ে আমি বিয়ে দেব এতে কার কি?
মুজিব ও থেমে নেই,পাল্টা জবাব দিল,
কার কি মানে, আমরা দেশের শিক্ষিত যুবক। বাল্যবিবাহ রোধ করা আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য।আপনার মেয়ে,তাই বলে এতটুকুন মেয়ের বিয়ে!অসম্ভব, কোনমতে এ বিয়ে হতে পারে না। আপনারা সবাই চলে যান।
ধনকুবের মিরন ক্ষেপে উঠে বলে, আপনারা কেউ যাবেন না। আমার মেয়ের বিয়ে পড়িয়ে তবে যাবেন। দেখি কে কি করতে পারে?
মুজিব দেখল কড়া ধমকে ও তার টনক নড়ল না। এবার ভাবল তাকে বুঝিয়ে কিছু করা যায় কি না। তাই নরম স্বরে বলে উঠল,
চাচাজান আপনার মেয়ে আপনি বিয়ে দেবেন। এতে কার ও কিছু করার নেই। তবে তার আগে আমার কিছু কথা শোনেন। এর পর সিদ্ধান্ত নিবেন মেয়ে বিয়ে দিবেন কিনা?
বাল্য বিবাহ আইনত নিষিদ্ধ।তাছাড়া নারীর জীবনে পরিপূর্ণতা না আসতে বিয়ে হলে সে সব দিকে ফেইলর। যেমন শারীরিক ও মানসিক। শুধু বিয়ে দিলে তো হবে না। সংসার কি বুঝতে হবে তো?এ বিষয়ে এরা এখন ও অনভিজ্ঞ। এত অল্প বয়সে মা হওয়াটা ও ঝুকিপূর্ন। বাচ্চা প্রসব করা মা ও শিশু দু’জনেরি রিক্স।শুধু তাই নয় মারা যাওয়ার সম্ভাবনাটা ও খুব বেশি। এবার ভেবে দেখুন মেয়ে বিয়ে দিবেন কি না?
কথায় বলেনা মুরখ্য লোক পশুর সমান। ঠিক তাই হলো, এত যুক্তির পর ও তার টনক নড়লো না।মৌলবী সাহেবকে বিয়ে পড়ানোর নির্দেশ দিলেন।
মুজিব আর থেমে থাকল না পুলিশ কল করার সিদ্ধান্ত নিল। তখনি উপস্থিত সবাই বলে উঠল,
মুজিব তুমি এসব নিয়ে আর টেনশন করো নাতো? দেখছো না সে মেয়ে বিয়ে দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। অযথা এসব নিয়ে টানা টানি করার কি দরকার?তুমি বাড়ি ফিরে যাও।
মুরব্বীদেরকে অমান্য করা অনুচিত হবে মনে করে মুজিব আর কথা বাড়ালো না। এই সুযোগে তারা টুনির বিয়ে পড়িয়ে দিল। এভাবে সমাজের কিছু মাতাব্বর শ্রেণির লোকেরা বাল্য বিবাহের পক্ষে সাপোর্ট করে। যার জলন্ত প্রমাণ আপনারা স্বচক্ষে দেখলেন। শুধু তাই নয় অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় তারা নিজেরা বাল্য বিয়ের ঘটকালী করে এবং বিয়ে দেয়। এবার আপনারা বলুন বাল্য বিয়ের জন্য কারা দায়ী, অবিভাবক না সমাজের গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ? আর কেন বা বাল্য বিয়ের হার দিনদিন বেড়ে চলেছে?
এদিকে কি আর করা টুনি বউ সেজে শ্বশুর বাড়িতে চলে গেল। দিন যায় রাত হয়। কোনমতে কাটছে টুনির দিনকাল। টুনির উডনচন্ডী মন কিছুতেই ঘরের গন্ডিবদ্ধ সীমানায় থাকতে চাইছে না।ইচ্ছে করছে সইদের নিয়ে ছোটাছুট কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলতে।টুনি যে বউ এ ধারণা এখনও তার ভিতরে জন্মাইনি। কেনবা জন্মাবে এখনও যে তার পুতুল খেলার বয়স পার হয়নি। বাড়ির পাশ দিয়ে তার বয়সী দু’চারজন মেয়েকে যেতে দেখে সে এগিয়ে গেল।অতপর গল্পের আসর জুড়ে দিলো। সবাই এক গতিতে খিলখিল করে হেসে উঠল। তাদের হাসির শব্দে বাড়িঘর মুখরিত। শ্বাশুড়ী এগিয়ে এসে দেখল কে হাসছে। বউকে অন্য মেয়ের সঙ্গে দেখে তিনি তো রেগে একেবারে আগুন।ততক্ষনাৎ ডেকে এনে বললেন,
বউ তোমার কি কান্ডক জ্ঞান বলতে কিছু অয় নাই?নতুন বউ এভাবে বাড়ির বাইর অয়।লোকে শুনলে কি বলবে?
স্বামী সংসার শ্বাশুড়ী এসব বুঝার মত জ্ঞান এখন ও তার হয়ে উঠেনি।যতই শাসন করুক কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।কিশোরীর মন যা চায়,সে তাই করে চলেছে।কোন বাঁধাই তাকে দমিয়ে রাখতে পারছে না।কিন্তু শ্বশুর শ্বাশুড়ী মানলে তো?তাদের চোখে সে একটা বউ। তার এসব করা সাজেনা, খুব অন্যায়। কিন্তু কে শোনে কার কথা, টুনি আপন নিয়মে হেসে খেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে।এবার শ্বাশু মা আর থেমে থাকল না। টুনির বাবার কাছে খবর পাঠাল দ্রুত আসার জন্য।তিনি আর দেরী করলেন না আরলি চলে আসলেন।এরপর টুনির শ্বাশু মা তার চঞ্চলতাকে সিরিয়াস দোষ বলে বাবার কাছে অভিযোগ করলেন।মুরখ্য বাবা আর কি বলবেন, তার চোখে ও টুনি দোষী তাই খুব করে বকাঝকা করলেন।যাবার বেলায় বলে গেলেন।
টুনি ভালো অইয়া যা। ফের যদি আমার কানে এসব কথা আহে। আমি আর কোনকথা শুনুম না। কাইট্যা গাঙ্গের জলে ভাসাইয়া দুমু।
সবার এক কথা,কেউ বুঝতে চাইল না, টুনির বয়স মন ও রুচি। এর ফাঁকে কেটে গেল ক’মাস। এতটুকুন টুনি মা হতে চলেছে।এ অবস্থায় তাকে একটু সতর্ক করে চলতে হবে। কিন্তু শ্বাশু মা মানলে তো?তিনিতো সেই মান্ধাত্বা আমলের মানুষ। পুরানো ধ্যান ধারণা এখন ও তার ভিতরে বিরাজমান।তাই বউকে দিয়ে ভারী ভারী কাজ করাচ্ছেন। টুনিও এ বিষয়ে অনভিজ্ঞ তাই কিছু বলছে না।ধান সিদ্ধ করতে একটা বড় পাতিল টেনে তুলতে সে অজ্ঞান হয়ে পড়লো, সঙ্গে সঙ্গে রক্ত ক্ষরণ। ব্লাড ঝরছে অনবরত। শ্বাশু মা ভাবল বাইরে কাজ করাতে বউয়ের গাঁয়ে আগলা বাতাস লাগছে। তাই গুনিন ডেকে আনলেন। গুনিন ঝাড় ফুঁক তাবিজ কবজ, পানিপড়া, তেলপড়া এসব দিয়ে চলে গেলেন।কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। রক্তক্ষরণ আর ও বেড়ে গেল। টুনির প্রাণ যায় যায় ভাব। খুব মুমূর্ষ অবস্থা।
খবর পেয়ে বাবা মা ছুটে গেলেন।তারপর ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন।ততক্ষনে টুনির শরীর প্রায় ঠান্ডা হয়ে গেল। ডাক্তার শতচেষ্টা করে ও টুনিকে বাঁচাতে পারলো না।
ডাক্তার বলল,
বাল্য বিবাহ এবং বাচ্চা ধারণ কোনটাই তার জন্য প্রযোজ্য ছিলো না। তাছাড়া প্রেগন্যান্সির প্রথম তিন মাস ও শেষের তিন মাস ভারী কাজ ও লং পথের জার্নিং নিষেধ। এতে বাচ্চা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশী।কিন্তু আপনারা এসব কিছুই মেনে চলেননি।রোগী যখন মারা যাওয়ার অবস্থা হয়, তখন আমাদের কাছে নিয়ে আসেন। আর যখনি মারা যায়,তখন বলেন, ডাক্তার ঠিকমত ট্রিটমেন্ট করেনি তাই রোগী মারা গেছে।কিন্তু ভুল যে আপনারা করেছেন তা একবার ও বলেন না।আজ আপনাদের ভুলের কারনে টুনির মতো একজন কিশোরীর আকাল মৃত্যু হলো। সাবধান ভবিষ্যতে আর এমন ভুল করবেন না। অপরিণত বয়সে আর কোন মেয়েকে বিয়ে দেবেন না।
টুনির অকাল মৃত্যু মা বাবা দু’জনে সহ্য করতে পারলো না।কাঁন্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
তখনি মুজিব ছুটে এসে বলল,
এখন কেঁদে আর লাভ কি? তখনতো খুব করে বুঝালাম। শুনলেন তো আমার কথা। এবার বুঝলেনতো
“বাল্য বিয়ের কুফল কি”
ধনকুবের কৃপন মিরন তার ভুল বুঝতে পারলো, এবং বলল,
মুজিব আমি ঠিক বুঝবার পারছি অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেয়া ঠিক না।আমি ক্যান আর কেউ যাতে এই ভুল না করে তার জন্য সবাইকে বুঝাইয়া কমু।
মুঝিব বলল,
চাচাজান আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ দেরীতে হলেও নিজের ভুল বুঝতে পারার জন্য।সাবধান আর কখনও এমন ভুল করবেন না।
মুজিব তুমি ঠিক কথাই কইছ।এমন ভুল আর কখনো করুম না। সবাইরে বুঝাইয়া কমু।বাল্য বিয়ে ভালো না।