তাকদীর অর্থ কী
তাকদীর শব্দটি আরবী। এর শাব্দিক অর্থ হলো, নিয়তি, কপাল, নির্ধারিত ভাগ্য। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যত কিছু ঘটেছে এবং ঘটবে সবকিছু আল্লাহ তা’আলার জ্ঞান দ্বারা সুনির্ধারিত। এক্ষেত্রে কারো বিন্দুমাত্র কর্তৃত্ব নেই। এই বিশ্বাসকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করাকেই ইসলামের দৃষ্টিতে ‘তাকদিরের প্রতি বিশ্বাস’ বলা হয়।
তাকদীর সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে
فَأَنْجَيْنَاهُ وَأَهْلَهُ إِلَّا امْرَأَتَهُ قَدَّرْنَاهَا مِنَ الْغَابِرِينَ
বাংলা অনুবাদঃ অতঃপর তাঁকে ও তাঁর পরিবারবর্গকে উদ্ধার করলাম তাঁর স্ত্রী ছাড়া। কেননা, তার জন্যে ধ্বংসপ্রাপ্তদের ভাগ্যই নির্ধারিত করেছিলাম। (সূরাঃ নমল, আয়াতঃ ৫৭)
তাকদীর সম্পর্কে হাদিসে এসেছে
আসমান-যমীন সৃষ্টির ৫০ হাজার বৎসর পূর্বে আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টজীবের তাকদীরসমূহ লিখে রেখেছেন। [সহীহ মুসলিম]
অন্যত্র আরও বর্ণিত হয়
প্রত্যেক জিনিসই তাকদির অনুযায়ী সংঘটিত হয়ে থাকে। এমনকি অক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তাও।’ (মুসলিম, রিয়াদুস সলিহিন. পৃষ্ঠা ২৮২)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে আরো ইরশাদ করেন-
জনৈক সাহাবি আরজ করেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমরা যে ঝাড়ফুঁক করে থাকি, চিকিৎসায় ওষুধ ব্যবহার করে থাকি কিংবা আত্মরক্ষার জন্য যেসব উপায় অবলম্বন করে থাকি, তা কি তাকদিরের কোনো কিছুকে পরিবর্তন করতে পারে? প্রত্যুত্তরে রাসুল (সা.) বলেন, তোমাদের এসব চেষ্টাও তাকদিরের অন্তর্ভুক্ত। (বায়হাকি)
অন্য হাদিসে তিনি সাহাবীদের উপদেশ দেন
তোমার জন্য কল্যাণকর কাজের প্রতি যত্নবান হও, আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা কর, আর অপারগতা প্রকাশ করিও না। আর তুমি যদি কোনো কষ্টের সম্মুখীন হও তবে এইরূপ বলিও না যে আমি যদি এ কাজ করতাম তাহলে এই হত; বরং বলো যে, ‘এটা আল্লাহর নির্ধারণ (তাকদীর), আর তিনি যা চেয়েছেন তাই করেছেন’। কারণ, ‘যদি’ কথাটি শয়তানের কর্ম খুলে দেয়।
অন্যত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন-
যদি সমগ্র উম্মত তোমার উপকার করার জন্য একত্রিত হয়ে যায়, তবে ততটুকুই উপকার করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তোমার (তাকদীরে) লিখে রেখেছেন। আর তারা যদি তোমার ক্ষতি করার জন্য একত্রিত হয়ে যায়, তবে ততটুকুই ক্ষতি করতে পারবে যতটুকু আল্লাহ তোমার (তাকদীরে) লিখে রেখেছেন। কলমসমূহ উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং খাতাসমূহ (তাকদীরের লিপি) শুকিয়ে গেছে। [তিরমিযী: ২৫১৬]
এক হাদীসে এসেছে
আলী (রা.) থেকে বর্নিত। তিনি বলেন- একদা আমরা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সঙ্গে বসা ছিলাম। তখন তার সঙ্গে ছিল একটি লাঠি। যা দিয়ে তিনি মাটি খুড়ছিলেন। তিনি তখন বললেন, তোমাদের মাঝে এমন কোন ব্যাক্তি নেই যার ঠিকানা জাহান্নামে বা জান্নাতে লিপিবদ্ধ করা হয়নি। লোকদের ভিতর থেকে এক ব্যাক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমরা কি তা হলে (এর উপর) নির্ভর করব না? তিনি বললেনঃ না, বরং আমল কর। কেননা, প্রত্যেকের জন্য আমল সহজ করা হয়েছে। [বুখারী: ৬২৫২]
এ ব্যাপারে আরও একটি হাদিস এসেছে
হিব্বান ইবনু মূসা (রহঃ) আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি (একদা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নিকট উপবিষ্ট ছিলেন। এমন সময় আনসার গোত্রের একটি লোক এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমরা তো বাঁদীদের সাথে মিলিত হই অথচ মালকে মুহাব্বাত করি। সুতরাং ’আযল’ করা সম্পর্কে আপনার অভিমত কি? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমরা কি এ কাজ কর? তোমাদের জন্য এটা করা আর না করা উভয়ই সমান। কেননা, যে কোন জীবন যা পয়দা হওয়াকে আল্লাহ তাআলা লিখে দিয়েছেন তা পয়দা হবেই। [বুখারী:৬১৫০]
তাকদীরের প্রতি ঈমান রাখা
আলী (রা.) থেকে আরো বর্ণিত আছে, মহানবী (সা.) বলেন, কোনো বান্দাই মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না চারটি বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করে। তা হলো—১. এ সাক্ষ্য দেওয়া যে আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং আমি তাঁর প্রেরিত রাসুল। ২. মৃত্যুতে বিশ্বাস করা, ৩. মৃত্যুর পর পুনরুত্থানে বিশ্বাস করা, ৪. তাকদিরে বিশ্বাস করা। [বায়হাকি]
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী হওয়া তাকদিরের বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল। ফলে যে ব্যক্তি ঈমান আনে, কিন্তু তাকদিরে অবিশ্বাস করল, সে প্রকৃতপক্ষে একত্ববাদকেই অস্বীকার করল। [তাবলীগে দ্বীন]
তাকদীর অবিশ্বাসীদের জন্য হুঁশিয়ারি
তাকদীরে অবিশ্বাসকারীদেরকে রাসুলুল্লাহ (সা.) লানত করেছেন। তিনি বলেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, যদি কেউ আমার নির্ধারিত তাকদিরের ওপর সন্তুষ্ট না থাকে এবং বিপদাপদে ধৈর্যধারণ না করে, তাহলে সে যেন আমি ছাড়া অন্য কাউকে রব বানিয়ে নিল। (বায়হাকি)
তাকদীর কত প্রকার ও কী কী
তাকদীর প্রধানত দুই প্রকার ১. তাকদিরে মুবরাম ২. তাকদিরে মুয়াল্লাক।
তাকদীরে মুবরাম:
তাকদীরে মুবরামর অর্থ হচ্ছে অপরিবর্তনীয় ভাগ্যলিপি- যা কখনোই পরিবর্তিত হবে না। যেমন: জন্ম মৃত্যু ইত্যাদি।
তাকদীরে মুয়াল্লাক:
তাকদীরে মুয়াল্লাক অর্থ হচ্ছে, ঝুলন্ত ভাগ্যলিপি। অর্থাৎ কিছু কিছু ব্যাপার আছে যা মানুষের কর্ম ও তাকবীরে দ্বারা পরিবর্তন হলেও হতে পারে বা যে ব্যাপারটি মানুষ আল্লাহর কাছে দোয়া কান্নাকাটির দ্বারা পরিবর্তন করতে পারে। মূলত এটাকেই তাকদীরে মুয়াল্লাক বলে। যেমন অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষের জীবনে সুখ শান্তি এসব মানুষের কর্মের উপরেই নির্ভরশীল। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন-
وَمَا أَصَابَكُم مِّن مُّصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُو عَن كَثِيرٍ
অনুবাদ: তোমাদের উপর যেসব বিপদ-আপদ পতিত হয়, তা তোমাদের কর্মেরই ফল এবং তিনি তোমাদের অনেক গোনাহ ক্ষমা করে দেন। [সূরাহ শূরা: ৩০]
অন্যত্র তিনি আরো ইরশাদ করেন
ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ لِيُذِيقَهُم بَعْضَ الَّذِي عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ
অনুবাদ: স্থলে ও জলে মানুষের কৃতকর্মের দরুন বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে। [সূরা রূম: ৪১]
তিনি আরো ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ কোনো ব্যক্তিকে তার সামর্থ্যের বাইরে দায়িত্ব দেন না। সে যা অর্জন করে, তা-ই তার জন্য এবং সে যা কামাই করে তা তারই ওপর বর্তাবে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৮৬)
এ ব্যাপারে হাদিসে এসেছে
সালমান (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, দোয়া আল্লাহর ফয়সালাকে পরিবর্তন করাতে পারে। আর নেক আমল বয়সকে বৃদ্ধি করাতে পারে। (তিরমিজি, হাদিস নম্বর : ২১৩৯)
তাকদীর বিষয়ে অহেতুক আলোচনার প্রতি নিন্দা
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকদীর প্রসঙ্গে বিতর্ক করতে নিষেধ করেছেন। যেমন—হজরত ইয়াহইয়া ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবি মুলাইকা তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি একদা হজরত আয়েশা (রা.)-এর দরবারে যান। তিনি তাঁকে তাকদির প্রসঙ্গে কিছু জিজ্ঞাসা করেন, তখন হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি তাকদিরের বিষয়ে কথা বলে, কিয়ামতের ময়দানে এ কারণে সে জিজ্ঞাসিত হবে। আর যে এ বিষয়ে আলোচনা করবে না, তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে না। (সুনানে ইবনে মাজাহ: ৮৪)
অন্য একটি হাদিসে এসেছে
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার রাসুল (সা.) আমাদের কাছে এলেন, আমরা তখন তাকদির প্রসঙ্গে আলোচনা করছিলাম। তখন রাসুল (সা.) প্রচণ্ড রেগে গেলেন। রাগে তাঁর চেহারা আনারের মতো রক্তিম বর্ণ হয়ে গেল। তিনি বলেন, তোমরা কি এসব করতে আদিষ্ট হয়েছ? নাকি আমি এসবের জন্য প্রেরিত হয়েছি? এর আগের লোকজন এ বিষয়ে আলোচনা করে ধ্বংস হয়েছে, আমি তোমাদের দৃঢ়তার সঙ্গে বলছি, তোমরা এ বিষয়ে বিবাদে লিপ্ত হয়ো না। (তিরমিজি: ২১৩৩)
তাকদীর ও তাদবীর
জনৈক সাহাবি আরজ করেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমরা যে ঝাড়ফুঁক করে থাকি, চিকিৎসায় ওষুধ ব্যবহার করে থাকি কিংবা আত্মরক্ষার জন্য যেসব উপায় অবলম্বন করে থাকি, তা কি তাকদিরের কোনো কিছুকে পরিবর্তন করতে পারে? প্রত্যুত্তরে রাসুল (সা.) বলেন, তোমাদের এসব চেষ্টাও তাকদিরের অন্তর্ভুক্ত। (বায়হাকি)
তাকদীর নিয়ে উক্তি
- কথায় আছে, “ভাগ্যের লিখন না যায় খন্ডন”।
- আরো একটি কথা প্রচলিত আছে “যাহা আছে নসিবে আপনি আপনি আসিবে”!
- একজন উর্দু কবি বলেন “আমি আমার রব থেকে নৈরাশ হই না, কারণ দোয়ার দ্বারা তাকদীর পরিবর্তন হয়”।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তাকদিরের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রাখার তৌফিক দান করুন। আমীন।
.
.
লিখনে: লুবাব হাসান সাফওয়ান
ইসলামী আকিদার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করেছেন। অসাধারণ হয়েছে। ধন্যবাদ ভাইয়া ❤️।
ইসলামের পরিভাষায় ভালো মতামত দিয়েছেন কবি