স্বদেশী আন্দোলনের ব্যর্থতা বাংলার স্বাধীনতাকামী দেশপ্রেমী যুব সমাজকে সশস্ত্র বিপ্লবের পথে ঠেলে দেয়।সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করার যে গোপন তৎপরতার সূত্রপাত ঘটে, তাকেই বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন বলা হয়ে থাকে। এই আন্দোলন ধীরে ধীরে বিভিন্ন জায়গায় অতর্কিত বোমা হামলা,উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মচারী হত্যা, গেরিলা পদ্ধতিতে খন্ডযুদ্ধ ইত্যাদি ঘটনার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ্যে চলে আসতে থাকে।
১৯১১ সাল থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত এই সংগ্রাম জোরদার হলেও এর আগেই সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। ১৯০৮ সালে ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা করার জন্য ক্ষুদিরামের বোমা হামলার মধ্যে দিয়ে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন আত্মপ্রকাশ করে। এই আন্দোলন মূলত শেষ হয় ১৯৩০ সালে। তবে এর পারে ও বিচ্ছিন্নভাবে সশস্ত্র আক্রমণের ঘটনা ঘটে।
১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের আগেই বাংলার প্রথম পর্যায়ের সশস্ত্র আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। প্রথম পর্যায়ের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ,বারীন্দ্র ঘোষ,ভূকেন্দ্র নাথ দত্ত প্রমুখ।
পুলিন বিহারী দাস ছিলেন ঢাকার অনুশীলন সমিতির প্রধান সংগঠক।এরা বোমা তৈরি থেকে শুরু করে সব ধরনের অস্ত্র সংগ্রহসহ বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন।সশস্ত্র আক্রমণ হত্যা ইত্যাদি কর্মসূচির মাধ্যমে এরা সরকারকে ব্যাতিব্যস্ত করে রাখেন। অপরদিকে লেফটেন্যান্ট গভর্নর ফুলারকে হত্যার চেষ্টা করা হয়।
ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যার চেষ্টায় নিয়োজিত প্রফুল্ল চাকি আত্মহত্যা করেন এবং ধরা পড়ার পর ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়।এছাড়াও মানিকতলা বোমা হামলাসহ নানা অভিযোগে বেশ কয়েকজন বিপ্লবীকে ঐ সময় ফাঁসি দেওয়া হয়।বেশ কয়েকজন বিপ্লবীকে কারাবন্দী ও দ্বীপান্তরে পাঠানো হয়।
এই সমস্ত চরম দমননীতির কারনে প্রথম পর্যায়ে সশস্ত্র বিপ্লব স্তিমিত হয়ে যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ে বিপ্লবী আন্দোলন শুরু হয় ১৯২২ সালে। এই আন্দোলন কোলকাতাকেন্দ্রিক হলেও ছড়িয়ে পড়ে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন এলাকায়।এই সময় বিপ্লবীরা আবার হত্যা, বোমা হামলা, ডাকাতি ইত্যাদি কর্যক্রম শুরু করেন। এই উদ্দেশ্যে কোলকাতায় গোপনে বোমার কারখানা স্থাপন করা হয়। এর মধ্যে কোলকাতা ও পূর্ব বাংলার যশোর, খুলনায় অনেক সশস্ত্র ডাকাতির ঘটনা ঘটে।
১৯১২ সালের শেষের দিকে দিল্লিতে বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর পরিকল্পনায় লর্ড হার্ডিংকে হত্যার জন্য বোমা হামলা চালানো হয়।হার্ডিং বেঁচে যান।কিন্তু, বিপ্লবী রাসবিহারী বসুকে ধরার জন্য ইংরেজ সরকার এক লক্ষ টাকার পুরষ্কারের ঘোষণা করে।
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সুযোগে বাংলার অনেক বিপ্লবী বিদেশ থেকে গোপনে অস্ত্র সংগ্রহের মতো দুঃসাহসী চেষ্টা ও করেছেন।এদের উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ শক্তির সাথে লড়াই করে দেশ স্বাধীন করা। এঁরা প্রথম বাঘা যতীন (যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়) ডা. যদুগোপাল মুখোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য প্রমুখ। এঁরা প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে ইংরেজ শক্তির প্রতিপক্ষ জার্মানি থেকে অস্ত্র সাহায্যের আশ্বাস পান।
তবে সরকার গোপনে এ খবর জানতে পেরে কৌশলে বাঘা যতীন সহ তার সঙ্গীদের গ্রেফতারের ব্যবস্হা করে। গ্রেফতারের সময় পুলিশের সঙ্গে বন্ধুক যুদ্ধে চিত্তপ্রিয় নামের এক বিপ্লবী শহিদ হন।বাঘা যতীন তিন বিপ্লবী সহ আহত অবস্থায় বন্দী হন।বন্দী থাকাকালে তার মৃত্যু হয়।বন্দী অপর দুই বিপ্লবীর ফাঁসি হয়,আর একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
মৃত্যু দন্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, নির্মম অত্যাচার ও বিপ্লবীদের পথভ্রষ্ট করতে পারে নি।ইংরেজ সরকারের অধীনে চাকরিরত দেশি এবং বিদেশি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের হত্যার পরিকল্পন অব্যাহত থাকে।পুলিশের সঙ্গে খন্ডযুদ্ধ, চোরাগোপ্তা হামলা,বোমাবাজি ক্রমাগত চলতে থাকে।
১৯১৬ সালের ৩০শে জানুয়ারি ভবানীপুরে হত্যা করা হয় পুলিশের ডেপুটি সুপার বসন্ত চট্টোপাধ্যায়কে।এভাবে হত্যা, খন্ডযুদ্ধের সংখ্যা বেড়ে গেলে সরকার প্রতিরক্ষা আইনে বহু লোককে গ্রেফতার করে।
১৯২২ সালে গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলন প্রতাহারের সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার ও পুলিশি নির্যাতন বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি বৃদ্ধি পায় বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ড।
বিপ্লবীরা অত্যাচারী পুলিশ সদস্যদের হত্যার আহ্বান জানিয়ে ‘লালবাংলা’ শীর্ষক প্রচার পত্র প্রকাশ করেন।
১৯২৪ সালে গোপীনাথ সাহা নামে একজন বিপ্লবী কোলকাতার পুলিশ কমিশনারকে হত্যা করতে গিয়ে ভুল করে অপর একজন ইংরেজকে হত্যা করে।এই হত্যাকান্ডের জন্য গোপীনাথকে ফাঁসি দেওয়া হয়।আলিপুর জোনের সুপার বন্দী বিপ্লবীদের পরিদর্শন করতে গেলে প্রমোদ চৌধুরী নামের একজন বিপ্লবীর রডের আঘাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
১৯২৪ সালের অক্টোবর মাসে ইংরেজ সরকার বেঙ্গল অর্ডিন্যান্স জারী করে। এইটি বলে অনেক বিপ্লবী কারারুদ্ধ হলে বিপ্লবী কার্যক্রম কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসে।
মহাত্মা গান্ধী ১৯৩০ সালে শুরু করেন আইন অমান্য আন্দোলন। এই আন্দোলনের সাথে সাথে বাংলায় বিপ্লবী কর্মকাণ্ড আবার বৃদ্ধি পায়। উল্লেখ ভাবে, সে সময় বিপ্লবী আন্দোলন বাংলায় বেশি শক্তিশালী ছিল এবং বাঙালিরা ইংরেজ প্রশাসনকে ব্যতিব্যস্ত রেখেছে।বাঙালি তরুণরা মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে বারবার সশস্ত্র আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
এমন একজন দুঃসাহসী বিপ্লবী ছিলেন চট্টগ্রামের মাস্টারদা,যার আসল নাম সূর্য সেন(১৮৯৪-১৯৩৪)।কলেজ জীবনে তিনি বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসেন।স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর তিনি উমাতারা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।এর মধ্যেই তিনি মাস্টারদা নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন।এসময় তিনি অম্বিকা চক্রবর্তী,অনুরূপ সেন,নগেন সেনের সহায়তায় একটি বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলেন।তার সংগঠন এবং তিনি নিজে একের পর এক সশস্ত্র কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করা হয়ে বারবার গ্রেফতার হলেও প্রমাণের অভাবে মুক্তি পেয়ে যান।
চট্টগ্রামকে ব্রিটিশ শাসন মুক্ত করার জন্য গঠন করেন চট্টগ্রাম বিপ্লবী বাহিনী। পরে এই আত্মঘাতী বাহিনীর নাম হয় “চিটাগাং রিপাবলিকান আর্মি “। এই বাহিনী একের পর এক সরকারি প্রতিষ্ঠান গুলো দখল করতে থাকে।
শেষ পর্যন্ত সরকারি অস্ত্রাগার লুন্ঠন করে। ” স্বাধীন চিটাগাং সরকার “-এর ঘোষণা দেওয়া হয় এবং একই সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এই যুদ্ধ ছিল অসম শক্তির যুদ্ধ। সূর্য সেনের বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে ইংরেজ সরকার বিশাল বাহিনী নিয়োগ করে।
চূড়ান্ত যুদ্ধ সংঘটিত হয় জালালাবাদ পাহাড়ে।গোলাবারুদ ফুরিয়ে গেলে বিপ্লবীরা পিছু হটতে বাধ্য হন।অনেক তরুণ বিপ্লবী এই খন্ডযুদ্ধ এবং অনান্য অভিযানে নিহত হন।বিপ্লবীরা গ্রামের কৃষকদের বাড়িতে বাড়িতে আশ্রয় নেন।
১৯৩৩সালে সূর্য সেন গ্রেফতার হন।১৯৩৪সালে সংক্ষিপ্ত ট্রাইবুনালের বিচারে তাকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়।চরম নির্যাতনের পর ১২ই জানুয়ারি তাকে ফাঁসি দিয়ে তার মৃত্যু দেহ বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
সূর্য সেনের বিপ্লবী বাহিনীতে নারী যোদ্ধা ও ছিলেন।তার মধ্যে উল্লেখ ছিলেন কল্পনা দত্ত ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। অসাধারণ মেধাবী ছাত্রী ছিল প্রীতিলতা।১৯০০সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন ও ডিসটিঙ্কশন নিয়ে বি.এ.পাশ করেন।ইতোমধ্যে তিনি বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে পড়েন ও সূর্য সেনের দলের সঙ্গে যুক্ত হন।
সাহসী নারী প্রীতিলতাকে তার যোগ্যতার জন্য চট্টগ্রাম ” পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব “আক্রমণের নেতৃত্ব দেওয়া হয়।সফল অভিযান শেষে তিনি তার সঙ্গী বিপ্লবীদের নিরাপদে স্থান ত্যাগ করতে সহায়তা করে। কিন্তু ধরা পড়ার আগে বিষপানে তিনি আত্মহত্যা করেন।প্রীতিলতা বাংলার সমস্ত বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে কিংবদন্তি হয়ে আছেন।
চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের পাশাপাশি কোলকাতায় যুগান্তর দলও যথেষ্ট সক্রিয় ছিল।
১৯৩০ সালে ডালহৌসি স্কোয়ারে চার্লস টেগার্টকে হত্যার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।ওই বছর ডিসেম্বরে এক অভিযানে নিহত হন কোলকাতা রাইটার্স বিল্ডিংয়ে কারা বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেল সিম্পসন। এর আগে বিনয় বসুর হাতে নিহত হন অত্যাচারী পুলিশ অফিসার লোম্যান।এই বিপ্লবী অভিযানের সঙ্গে জড়িত বিনয় প বাদল আত্নহত্যা করেন ও দীনেশের ফাঁসি হয়।ঐ বছরই বাংলার গভর্নর জ্যাকসনকে হত্যার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।এই প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িত বীনা দাসের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।
১৯৩১-১৯৩৩সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে মেদিনীপুরে পরপর তিনজন ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট বিপ্লবীদের হাতে নিহত হন।
বিপ্লবীদের ব্যপক তৎপরতা কমে গেলেও চট্টগ্রামে তারা এরপরও একের পর এক অভিযান চালিয়েছে।
১৯৩৪ সালের ৭ই জানুয়ারি চট্টগ্রামের পল্টন ময়দানে ইংরেজদের ক্রিকেট খেলার আয়োজনে সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে সক্ষম হয়।ঐদিনও দু’জন বিপ্লবী নিহত হন এবং দু’জন ধরা পড়লে তাদের পড়ে হত্যা করা হয়।
আরো পড়ুন-
- উপাত্ত কাকে বলে?
- অনলাইনে কেনাকাটার অসুবিধা
- যমজ মৌলিক সংখ্যা কাকে বলে
- জীবিকা কাকে বলে?
- বাংলা ছোট গল্প লেখা