মধ্য রমজানে বিকট আওয়াজের হাদীস কি আসলেই জাল?

1
মধ্য রমজানে আকাশ থেকে বিকট আওয়াজ আসা সংক্রান্ত আলোচনা

 

ফেসবুকের অনেকেই নিম্নোক্ত হাদীসটি—

 

“মধ্য রমজানে আকাশ হতে বিকট শব্দ শোনা যাবে যাতে করে ৭০ হাজার লোক অজ্ঞান হয়ে যাবে, ৭০ হাজার লোক বধির হয়ে যাবে, আর ৭০ হাজার লোক অন্ধ হয়ে যাবে। লোকেরা জিজ্ঞেস করলেন হে নবী সাঃ কারা এই আযাব হতে রক্ষা পাবে….”

 

উল্লেখ করে এর সনদ বিশ্লেষণ করেছেন এবং সনদের ভিত্তিতে হাদীসটিকে জাল বলে প্রমাণিত করেছেন। এবং সাথে বিভিন্ন ইমামের বক্তব্যও সংযোজিত করছেন।

 

দুঃখজনক হলেও সত্য বিভিন্ন ইমামের যে সমস্ত বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে সেগুলো একই বিষয়ে ভিন্ন একটি হাদিস সম্পর্কে ছিলো। এই হাদীস সম্পর্কে নয়। অথচ কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই করা ছাড়াই সবাই এ হাদীসটির সাথে বক্তব্যগুলো জুড়ে দিচ্ছে। যেমন হাফেজ যাহাবী ও ইমাম আবু হাকিমের বক্তব্য— ইমামগণ হাদীসটিকে মাসলামার কারণে জ’ঈফ বলেছেন; অথচ এই হাদীসের সনদে মাসলামা নামে কোনো রাবীই নেই।

 

যারা হাদিসটিকে প্রচার করেছেন, তারাও যাচাই-বাছাই ছাড়াই প্রচার করেছেন। আর যারা হাদিসটিকে জাল বলে প্রচার করেছেন তারাও যাচাই-বাছাই ছাড়াই ভুলভাল প্রচার করে চলেছেন। তাহলে উভয়ের মাঝে পার্থক্য কী থাকলো?

 

কিন্তু আমরা তাহকীক করে দেখলাম, উপরোক্ত হাদীসের কেবল একটি সনদ নয় বরং একাধিক সনদ রয়েছে। এমন কিছু সনদও আছে যে সনদে কোনো মিথ্যাবাদী/জালকারী রাবী নেই। হাঁ, দুয়েকজন রাবী আছেন অজ্ঞাত। কিন্তু কথা হল, কোনো রাবী অজ্ঞাত হওয়া মানেই হাদীসটি সম্পূর্ণ জাল হয়ে যাবে ব্যাপারটা এমন নয়। কারণ, হাজার হাজার রাবির মধ্যে সবাই অন্যদের মতো পরিচিত হবেন এটা অসম্ভব। পৃথিবীতে এমন বহু সত্যবাদী লোক আছে যাদের মৃত্যুর ১০০ বছর পর তাদেরকে কেউই চিনবে না; তাদের কথা কোথাও লেখাও থাকবে না। তো তার মানে কি তাদের বলা কথাগুলো সবই মিথ্যা হয়ে যাবে?

 

হাদীসটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ও শুদ্ধ সনদে দেওয়া হল-

 

حَدَّثَنا عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ عُثْمانَ الزّاهِدُ، حَدَّثَنا أحْمَدُ بْنُ ثابِتٍ التَّغْلِبِيُّ، حَدَّثَنا أبُو عُثْمانَ الأعْناقِيُّ، حَدَّثَنا نَصْرُ بْنُ مَرْزُوقٍ، حَدَّثَنا عَلِيُّ بْنُ مَعْبَدٍ، حَدَّثَنا خالِدُ بْنُ سَلّامٍ، عَنْ يَحْيى الدُّهْنِيِّ، عَنْ أبِي المُهاجِرِ، عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ مُحَمَّدٍ -[٩٧٠]-، عَنْ عَبْدةَ بْنِ أبِي لُبابَةَ، عَنِ ابْنِ الدَّيْلَمِيِّ، قالَ: قالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ: «يَكُونُ فِي رَمَضانَ صَوْتٌ» قالُوا: يا رَسُولَ اللَّهِ فِي أوَّلِهِ أوْ فِي وسَطِهِ أوْ فِي آخِرِهِ؟ قالَ: «لا، بَلْ فِي النِّصْفِ مِن شَهْرِ رَمَضانَ إذا كانَتْ لَيْلَةُ النِّصْفِ لَيْلَةُ جُمُعَةٍ يَكُونُ صَوْتٌ مِنَ السَّماءِ يُصْعَقُ لَهُ سَبْعُونَ ألْفًا يَتِيهُ سَبْعُونَ ألْفًا ويَعْمى سَبْعُونَ ألْفًا ويُصَمُّ سَبْعُونَ ألْفًا ويُخْرَسُ فِيهِ سَبْعُونَ ألْفًا ويَنْفَتِقُ فِيهِ سَبْعُونَ ألْفَ عَذْراءَ» قالُوا: فَمَنِ السّالِمُ يا رَسُولَ اللَّهِ؟ قالَ: «مَن لَزِمَ بَيْتَهُ وتَعَوَّذَ بِالسُّجُودِ وجَهَرَ بِالتَّكْبِيرِ» قالَ: «ومَعَهُ صَوْتٌ آخَرُ فالصُّوتُ -[٩٧١]- الأوَّلُ صَوْتُ جِبْرِيلَ، والصَّوْتُ الثّانِي صَوْتُ الشَّيْطانِ، فالصُّوتُ فِي رَمَضانَ، والمَعْمَعَةُ فِي شَوّالٍ، وتَمْيِيزُ القَبائِلِ فِي ذِي القَعْدَةِ، ويُغارُ عَلى الحاجِّ فِي ذِي الحِجَّةِ والمُحَرَّمِ، وأمّا المُحَرَّمُ أوَّلُهُ بَلاءٌ وآخِرُهُ فَرَجٌ عَلى أُمَّتِي، راحِلَةٌ فِي ذَلِكَ الزَّمانِ يَنْجُو عَلَيْها المُؤْمِنُ خَيْرٌ مِن دَسْكَرَةٍ تَغُلُّ مِائَةَ ألْفٍ» .

 

“কোনো এক রমজানে একটি আওয়াজ আসবে। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন- হে আল্লাহর রাসূল! রমজানের শুরুতে? নাকি মাঝামাঝি সময়ে? নাকি শেষ দিকে?

 

নবী করীম সা.বললেন- না, বরং রমজানের মাঝামাঝি সময়ে। ঠিক মধ্য রমজানের রাতে। শুক্রবার রাতে আকাশ থেকে একটি শব্দ আসবে। সেই শব্দের প্রচণ্ডতায় সত্তর হাজার মানুষ সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলবে আর সত্তর হাজার বধির হয়ে যাবে। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার উম্মতের মধ্যে কারা সেদিন নিরাপদ থাকবে?

 

নবী করীম (সা.) বললেন, যারা নিজ নিজ ঘরে অবস্থানরত থাকবে, সিজদায় লুটিয়ে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করবে এবং উচ্চ শব্দে আল্লাহু আকবর বলবে। পরে আরও একটি শব্দ আসবে। প্রথম শব্দটি হবে জিবরাঈলের, দ্বিতীয়টি হবে শয়তানের।

শব্দটি আসবে রমজানে। ঘোরতর যুদ্ধ সংঘটিত হবে শাওয়ালে। আরবের গোত্রগুলো বিদ্রোহ করবে জুলকাদাহ মাসে, জিলহজ ও মুহাররম মাসে হাজীদের ওপর আক্রমণ করা হবে। আর মুহাররমের শুরুটা আমার উম্মতের ওপর বিপদসংকুল হবে, আর শেষটা হবে শান্তিপূর্ণ। সেদিন মুসলমানগণ যে বাহনে চড়ে মুক্তি লাভ করবে, সেটি তার কাছে এক লাখ মূল্যের বিনোদন সামগ্রীতে পরিপূর্ণ ঘরের চেয়েও বেশি উত্তম বলে বিবেচিত হবে। [আস-সুনানুল ওয়ারিদাহ ফিল-ফিতান: ৫/৯৬৯]

 

পর্যালোচনা: যদিও আলবানী সাহেব হাদীসটিকে বিভিন্ন ঠুনকো (মাজহূল) অজুহাতে জ’ঈফ ইত্যাদি বলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু তিনি হাদিসটিকে সরাসরি জাল বলার সাহস করেননি।

 

উপরোল্লিখিত সনদ সম্পর্কে আলবানীর বক্তব্য হচ্ছে,

 

إسناد لا تقوم به حجة؛ خالد بن سلام مجهول، لم يرو عنه غير

 

এটি এমন সনদ যার দ্বারা দলিল সাব্যস্ত হয় না। খালেদ বিন সাল্লাম মাজহূল, তার থেকে কেউ হাদীস বর্ণনা করেনি। [সিলসিলা যঈফাহ: ৬১৭৯]

 

প্রথমত: আমরা বলবো, এটি কোনো হালাল-হারাম কিংবা বিধি-বিধান সম্পর্কিত হাদীস নয় যে, এর দ্বারা দলিল সাব্যস্ত করতে হবে বা দলীল সাব্যস্ত হয় না বিধায় হাদীসটিকে ছুঁড়ে ফেলতে হবে। মূলত এ হাদীস দ্বারা তো কেউ হুকুম-আহকাম সাব্যস্ত করেও না।

 

যেহেতু এটি কেয়ামতের লক্ষণ বা ফিতনা সম্পর্কিত হাদিস; সেহেতু এ হাদিসের ভিত্তিতে সতর্ক হয়ে যেতে দোষ কী? ফেতনা থেকে রক্ষা/সতর্কতা অবলম্বনের জন্যও কি সহীহ, সরীহ, মুতাওয়াতির পর্যায়ের হাদীস লাগবে নাকি?

 

দ্বিতীয়তঃ হাদীসটির ওপর উল্লেখিত অভিযোগ করা হয়েছে খালিদ বিন সাল্লাম মাজহূল হওয়ার ভিত্তিতে। আলবানীর অভিযোগ, খালিদ মাজহূল, তার থেকে কেউ হাদীস বর্ণনা করেনি।

 

অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, তাঁর থেকে আরো একাধিক সিকাহ রাবী হাদীস বর্ণনা করেছেন। এমনকি আহমদ বিন হাম্বলের পুত্র আব্দুল্লাহ বিন আহমদও তার সূত্রে একটি হাদিস উল্লেখ করেছেন। দেখুন আব্দুল্লাহ বিন আহমদ কৃত— আল-জামি’ ফিল ইলাল: ৫৯৮। তার সূত্রে আবু নু’আইম ইস্পাহানীও একটি বর্ণনা এনেছেন। দেখুন তৎকৃত— হিলয়াতুল আউলিয়া: ৫৪৪১। আর আবু নু’আইম ইস্পাহানি তো কেবল তাঁর নাম উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হননি বরং তাঁর উপাধি/নসবও উল্লেখ করেছেন। এর থেকে বোঝা যায়, খালিদ একেবারেই অজ্ঞাত রাবী নন।

 

আর অজ্ঞাত হলেও এমন ধরনের হাদিসের ক্ষেত্রে কিছু যায় আসে না। যেমনটা আমরা উপরেও বলে এসেছি। কারণ, অজ্ঞাত মানেই তিনি মিথ্যা বলেছেন— এমন নয়। মূলত অজ্ঞাত ব্যক্তিদের হাদীস গ্রহণ করা হয় না ভুলবশত শরীয়তে এমন কোনো বিধিনিষেধ ঢুকে যাবে যা শরীয়তে ছিলোই না —এই ভয়ে। কিন্তু এ হাদিসের ক্ষেত্রে এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ হুকুম আহকাম নেই। এ হাদীসে কেবল কেয়ামতের লক্ষণ বর্ণনা করা হয়েছে, যাতে করে মানুষ সতর্ক হতে পারে।

 

অতএব সতর্কতামূলক হাদীসটি নির্দ্বিধায় গ্রহণ করা যেতে পারে। কথায় আছে বাইচান্সের লাইসেন্স নেই।

 

এ হাদীসের আরো একটি সনদ আছে, যার সম্পর্কে আলবানী বলেন, মাকতূ, মাওকূফ। [সিলসিলা যঈফাহ: ৬১৭৯]

 

মজার ব্যাপার হচ্ছে, আলবানী সাহেব এই সনদটিকেও জাল বলার সাহস করতে পারেননি। যেখানে আলবানীর মত কঠোর ব্যক্তি হাদিসটিকে জাল বলতে পারছে না সেখানে….। বুঝতেই তো পারছেন।

 

অনেকের মনের খুঁতখুতানি এখনো যাবে না। তাদের উদ্দেশ্যে বলি, আপনাকে তো কেউ এ হাদীসের ওপর আমল করতে বলছে না। আপনি কেবল সতর্ক হয়ে যান, আমল বাড়িয়ে দিন। সত্য হলেও তো হতে পারে, মিথ্যা হলেও ক্ষতি নেই।

 

তাছাড়া হাদিসের বাচনভঙ্গি থেকেও বোঝা যায়, হাদিসটি একেবারেই মিথ্যা নয়। কোনো মুসলমান রাসূলের নামে অকারণে এত বড় সাজানো গোছানো মিথ্যা কথা বানাবে না। যদি মিথ্যা কথা বর্ণনা করাই উদ্দেশ্য থাকতো, তাহলে সাহাবায়ে কেরাম কর্তৃক আল্লাহর রাসূলকে জিজ্ঞেস করার বিষয়— অর্থাৎ হে আল্লাহ রাসুল, আওয়াজটা কি রমজানের শুরুতে হবে না শেষে হবে না মধ্যভাগ্য হবে— এ বিষয়গুলো থাকত না।

 

যাইহোক, হাদিসটি সম্পূর্ণ সহীহ তা-ও আমরা বলবো না। তবে সামগ্রিক দৃষ্টিতে হাদীসটি একেবারেই অমূলক নয়। সর্বোপরি এটা মনে রাখবেন, উক্ত সনদে কোনো মিথ্যুক কিংবা দুর্বল রাবী নেই; বরং সকল রাবীই সিকাহ। আর রাবী মাজহূল হওয়ার যে অভিযোগ করা হয়েছে তার জবাব আমরা দিয়েছি।

 

লুবাব হাসান সাফওয়ান

 


আরো পড়ুন-


Screenshot 3
বিজ্ঞাপনঃ বই কিনুন, বই পড়ুন

1

লুবাব হাসান সাফ‌ওয়ান

Author: লুবাব হাসান সাফ‌ওয়ান

লুবাব হাসান সাফ‌ওয়ান। ঠিকানা: নোয়াখালী। কর্ম: ছাত্র। পড়াশোনা: আল-ইফতা ওয়াল হাদীস [চলমান] প্রতিষ্ঠান: মাদরাসাতু ফায়দ্বিল 'উলূম নোয়াখালী।

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

কবিতা আল কোরআনের প্রতীক আফছানা খানম অথৈ

আল কোরআনের প্রতীক আফছানা খানম অথৈ মা আমেনার গর্ভেতে জন্ম নিলো এক মহামানবের, নাম হলো তার মুহাম্মদ রাসুল আসলো ভবের

ফোরাত নদীতে স্বর্নের পাহাড় আফছানা খানম অথৈ

ফোরাত নদীতে স্বর্নের পাহাড় আফছানা খানম অথৈ ইমাম মাহাদী (আ:) আগমনের পূর্বে ফোরাত নদীর তীরে স্বর্নের পাহাড় ভেসে উঠা কেয়ামতের

কবিতা দাজ্জাল আফছানা খানম অথৈ

দাজ্জাল আফছানা খানম অথৈ কেয়ামতের পূর্বে দাজ্জাল আসবে নিজেকে খোদা বলে দাবি করবে, কাফের মুনাফিক যাবে তার দলে ঈমানদার মুমিন

গল্প হযরত মুহাম্মদ (সা:) জীবনের গল্প আফছানা খানম অথৈ

জন্ম:হযরত মুহাম্মদ (সা:) বর্তমান সৌদি আরবে অবস্থিত মক্কা নগরীর কুরাইশ গোত্রে বনি হাশিম বংশে ৫৭০ খৃষ্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন।তার পিতার

Leave a Reply