হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

3

“মুহাম্মদ” (সা.) হচ্ছেন দুনিয়া এবং আখিরাতের একমাত্র মুক্তির দূত। মহান সৃষ্টিকর্তা “আল্লাহ” সুবহানা তা আলার পরই যার স্থান, তিনি হচ্ছেন হযরত মুহাম্মদ (সা.)।  ইসলামকে মানতে হলে অবশ্যই রাসুল (সা.) কে জানতে এবং মানতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) কে জানা এবং মানা ছাড়া ইসলাম পরিপূর্ণ নয়। হযরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে বলতে গেলে কখনোই তা সম্পূর্ণ করা যাবে না। তারপরও আজ আমরা হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ জানার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

সূচিপত্র

হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জন্ম

হযরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মের শুরু থেকেই নবী কিংবা রাসুল হিসাবে পৃথিবীর মানুষের কাছে জন্ম নেননি। তিনি রাসুল হিসাবে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করেছেন তাঁর চল্লিশ বছর বয়সে। যেকারণে তাঁর  জন্মের তারিখ সম্পর্কে সঠিক তথ্য পরবর্তীতে পাওয়াটা খুবই দুষ্কর হয়ে পড়ে। এমনকি তাঁর জীবদ্দশায়ও তাঁর জন্মদিন সম্পর্কে জানা গেলেও প্রয়োজন না থাকার কারণে জন্মতারিখ কিংবা জন্মবার্ষিকী সম্পর্কে কোনো তথ্যই রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর সাহাবীদের জানাননি। 

তাঁর ওফাতের পরবর্তীতে বিভিন্ন সত্যানুসন্ধানী ইতিহাসবিদ তাঁর জন্ম তারিখ ও সাল বের করার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। তাঁদের সেই প্রচেষ্টার ফসল স্বরূপ আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.) এর জন্ম সম্পর্কে  বেশ কয়েকটি তারিখ দেখতে পাই। তবে তারিখ নিয়ে মতভেদ থাকলেও তাঁর জন্মদিন সম্পর্কে কোনো মতভেদ নেই। 

ইবনে কাসীর (রহ.) এর কিতাব আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/২৮২ খন্ডে বলা হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) রবিউল আউয়াল মাসের কোনো এক সোমবার জন্ম নিয়েছেন তা সকল নির্ভরযোগ্য ইতিহাস রচয়িতা উলামায়ে কেরাম একমত।

আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.) এর প্রখ্যাত জীবনী গ্রন্থ আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/২৮২ খন্ড কিতাব থেকে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর জন্মের যতগুলো তারিখ দেখতে পাই তা উল্লেখ করছি। 

রবিউল আউয়াল এর দুই তারিখ

‘ইবনে সাআদ তার শিক্ষক ওয়াকেদি এর সূত্রে জানিয়েছেন যে, “আবু মাশার আল-মাদানী বলতেন, রবিউল আউয়াল মাসের দুই তারিখ সোমবার রাসুল  (সা.) জন্ম গ্রহণ করেছেন।” (তবাকাতে ইবনে সাআদ ১/৪৭)

রবিউল আউয়াল এর আট তারিখ

অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম একমত যে, হস্তি বাহিনী যে বছর মক্কায় হামলা করেছিল,  সেই বছরেরই রবিউল আউয়াল মাসে রাসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম হয়।

ইবনে কাছীর (রহ.) তাঁর আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/২৮৩ কিতাবে বর্ণনা করেছেন, “ইমামুল মাগাযী ইবনে ইসহাক বলেছেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম (আবরাহা কতৃক)  হস্তি বাহিনীর (আক্রমণের)  বছর হয়েছিল। এটাই সকলের নিকট প্রসিদ্ধ অভিমত। একইসাথে ইবরাহীম বিন মুনযির (রহ.) বলেন, “রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম হস্তি বাহিনীর বছর হওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের উলামাদের নিকট কোনো সন্দেহ নেই।”

একই তথ্য আল্লামা যারকাশী (রহ.)-ও “শরহে যারকাশী আলাল মাওয়াহেব” এর মধ্যে আট তারিখের মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। (শরহে যারকাশী আলাল মাওয়াহেব ১/২৪৬) এছাড়াও “সুবুলুল হুদা ওয়ার রশাদ ফী সীরাতি খাইরিল ইবাদ ১/৩৩৫” কিতাবেও রবিউল আউয়ালের ৮ তারিখকে প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। যা আল মাওয়াহেবুল লাদুনিয়্যাহ ১/৮৫ কিতাবেও পাওয়া যায়।

রবিউল আউয়াল এর দশ তারিখ

দশ তারিখের দলিলের সূত্রেও ওয়াকেদী রয়েছেন। তাই দশ তারিখের দলিলটিও মাতরুক বিবেচিত হবে। (তবাকাতুল কুবরা ১/৪৭)

রবিউল আউয়াল এর বার তারিখ

ইবনে কাসীর (রহ.) এর আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/২৮৩ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, “ইবনে ইসহাক (রহ.) ১২ তারিখের মতটিকে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। আর ইবনে আবী শাইবা তার ‘মুসান্নাফ’ গ্রন্থে আফফান ইবনে মুসলিম এর সূত্রে সাঈদ ইবনে মীনা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, জাবের (রা.) ও ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হস্তি বাহিনীর মক্কায় আক্রমণের বছরের রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ সোমবার জন্ম গ্রহণ করেন। একইসাথে রবিউল আউয়াল মাসেই তাঁকে নবুওয়াত দেয়া হয় এবং এ মাসে তাঁর “মেরাজ” হয়। শুধু তাইনয় এ মাসেই তিনি হিজরত করেন এবং এ মাসেই তিনি ইন্তিকাল করেন।

উপরের উল্লিখিত তারিখ ছাড়াও রবিউল আউয়াল এর সতের তারিখ, রমজান মাসের বার তারিখও কোনো কোনো ইতিহাসবিদ তাদের কিতাবে বর্ণনা করেছেন। মোটকথা, রবিউল আউয়াল মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে সোমবার হয় নয় তারিখ। এসব কারণে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম খ্রিষ্টীয় ৫৭১ সালের ২০শে এপ্রিল হয়েছিল। (সীরাতুন নবী ১/১১৭)

এছাড়াও ঐতিহাসিক তাবারি, ইবনে খালদুন, ইবনে হিশাম, আমীর আলীসহ অধিকাংশের মতে, হযরত মুহাম্মদ (সা.) ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে ২৯ আগস্ট, মােতাবেক ১২ রবিউল আউয়াল সােমবার জন্মগ্রহণ করেন। মোটকথা রাসুল (সা.) জন্মতারিখ নিয়ে গবেষকদের যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। শুধুমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন রাসুলুল্লাহ (সা.) কত তারিখ জন্ম নিয়েছেন। আর এটা একারণেই রহস্যাবৃত যে, তাঁর জন্ম হওয়াটাই হচ্ছেন দুনিয়া এবং আখিরাতের কল্যাণ, তাঁর জন্ম তারিখটা নয়। তাই প্রত্যেক মুমিমের উচিত তাঁর জন্ম তারিখে মনোনিবেশ না করে তাঁর কর্মের দিকে মনোযোগ দেওয়া। তাহলেই আমাদের উম্মতদের কল্যাণ। 

হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর পুরো নাম

বিশ্বের মহামানব মুহাম্মদ (সা.) দুনিয়ায় আসার আগেই তাঁর মা আমিনা স্বপ্নে দেখেন, যে শিশু তার উদর বেয়ে ভূমিষ্ঠ হবে, তাঁর নাম হবে মুহাম্মদ। এর অর্থ সর্বজন প্রশংসিত। বিশ্বনবি দুনিয়ায় পদার্পণ করার পর, মা আমিনা তার সন্তানের দাদা আবদুল মুত্তালিবকে স্বপ্নের পুরো বৃত্তান্ত খুলে জানান। দাদা আবদুল মুত্তালিব সেই অনুযায়ী শিশুটির নাম রাখেন ‘মুহাম্মদ’। একই সঙ্গে তিনি দোয়া  করলেন, “হে আল্লাহ! আমাদের এই সন্তানকে আমরা সকল হিংসুকের অনিষ্ট থেকে আপনার আশ্রয়ে সমর্পণ করছি।” এরপর দাদা নাতিকে কোলে নিয়ে পবিত্র কাবা শরিফের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন এবং আল্লাহর শোকর আদায় করলেন। (ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা-১৫৮)

মুহাম্মাদের সাঃ এর অন্যান্য নাম সমূহ

রাসুলুল্লাহ (সা.) এর নাম “মুহাম্মদ” ছাড়াও আরো অনেক নামে তিনি পরিচিত। বিভিন্ন বর্ণনা মতে তাঁর ৮৮ টি সাধারণত পরিচিত নাম পাওয়া যায়। এছাড়াও তাঁর অসংখ্য নাম পাওয়া যায় যা মূলত কুরআন ও হাদিসের বর্ণনানুযায়ী। একইসাথে কুরআনে বিভিন্ন উপাধির মাধ্যমে মধ্যম পুরুষ হিসাবে মুহাম্মদ (সা.) কে সম্বোধন করা হয়েছে। যেমন নবী, বার্তাবাহক, আল্লাহর দাস (আবদ) ইত্যাদি। পবিত্র কুরআনে “মুহাম্মদ” অর্থ “প্রশংসনীয়” এই শব্দটি চারবার এসেছে। কুরআনের ৪৭ নম্বর সূরার নামও নামকরণ করা হয়েছে “মুহাম্মদ।”

বিশ্বনবির বিভিন্ন উপাধি সমূহ 

মুহাম্মদ (সা.) কে অসংখ্য উপাধিতে ভূষিত করা হয়। যেমন, খতমে নবুয়ত, নবি, নবিদের নবি, রাসুল, প্রিয়, আল্লাহর প্রিয়তম, মনোনীত বা নিযুক্ত অকৃত্রিম, বিশ্বস্ত, সৎ, ন্যায়পরায়ণ, সত্যবাদী, সদয়, সহানুভূতিশীল, স্নেহময়, আদর্শ (ব্যবহার, সদগুণ, পুণ্য), বিশ্বস্ত, নিখুঁত, মানবজাতির সেরা, বিশ্ববাসীর প্রতি করুণা, আল-মুবাশ্বির অর্থ সুসংবাদ বাহক, আন-নাধির অর্থ  সতর্ককারী,আল-মুধাক্কির অর্থ অনুস্মারক, আদ-দাঈ অর্থ (আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী, বশির অর্থ ঘোষক, আন-নূর অর্থ আলোর ব্যক্তিত্ব, আল-মিসবাহ অর্থ বাতি/ লণ্ঠন বা আলোর বাহক কিংবা ভোর। আস-সিরাজ আল-মুনির অর্থ আলোকিত বাতি, চির-উজ্জ্বল, চির-আলোকিত, দ্যুতিময় ইত্যাদি। নিয়ামত উল্লাহ অর্থ আল্লাহর অনুগ্রহ। আল-উম্মি অর্থ দুনিয়াবী শিক্ষায় অশিক্ষিত এবং নিরক্ষর, অর্থাৎ: আন-নবিয়্যু আল-উম্মি অর্থাৎ দুনিয়াবী শিক্ষা পদ্ধতিতে অশিক্ষিত ও নিরক্ষর নবি। কিন্তু ইহকাল পরকালের শিক্ষায় ঐশ্বরিক শিক্ষায় শিক্ষিত। যার শিক্ষক হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ। আল-আকিব অর্থ শেষ (নবি), আল-মুতাওয়াক্কিল অর্থ যে (আল্লাহর উপর) তাঁর ভরসা রাখে), কুথাম অর্থ নিখুঁত চরিত্রের অধিকারী। আল-মাহি অর্থ  অপসারণকারী (অবিশ্বাসের), আল-হানিফ অর্থ  আদি ধর্মের অন্যতম, নাবিয়্যু আত-তওবা অর্থ অনুতাপের নবী, আল-মুয়াজ্জাজ অর্থ শক্তিশালী একজন, এক অভেদ্য করা, আল-মুওয়াক্কার অর্থ বিস্ময়ে অনুষ্ঠিত, আল-ফাতিহ অর্থ উন্মোচনকারী, আল-হাশির অর্থ বিচার দিবসে একত্রিতকারী (প্রথম পুনরুত্থান করা হবে), আল-শাফি অর্থ  মধ্যস্থতাকারী, করিম অর্থ মহৎ এবং উদার, শহীদ অর্থ একজন সাক্ষী, আল-মুশাফফা অর্থ  যার সুপারিশ মঞ্জুর করা হবে, আল-মোস্তফা অর্থ মনোনীত অর্থ  আবদুল্লাহ, আল্লাহর বান্দা, আখির অর্থ ‘চূড়ান্ত অর্থাৎ চূড়ান্ত নবি কিংবা  সর্বশেষ রাসুল।

সুন্নাতে রাসুল (সাঃ) ও আধুনিক বিজ্ঞান- হাকিম মুহাম্মদ তারেক মাহমুদ চুগতাই
সুন্নাতে রাসুল (সাঃ) ও আধুনিক বিজ্ঞান- হাকিম মুহাম্মদ তারেক মাহমুদ চুগতাই

 

হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর বংশ তালিকা

পৃথিবীতে আল্লাহ প্রথম মানুষ সৃষ্টি করেন হযরত হযরত আদম (আ.) কে এবং তার পরই মা হাওয়া (আ.)। এই দুইজন মানুষের মাধ্যমেই পৃথিবীতে শুরু হয় মানুষের বংশবিস্তার। এদেরই বংশপরস্পরায় হযরত মুহাম্মদ (সা.) পৃথিবীতে এসেছিলেন। এটা কখনোই সম্ভব নয় যে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর বংশ তালিকা নির্ভুলভাবে প্রকাশ করা। কেননা এই বিষয়টি রাসুলুল্লাহ জীবদ্দশায় কখনোই প্রয়োজন মনে করেননি। তারপরও ইতিহাসবিদগণ চেষ্টা করেছেন একটা তালিকা প্রস্তুত করার। যেখানে ভুল ত্রুটি থাকাটা অসম্ভব নয়। বাকিটুকু আল্লাহই ভালো জানেন। 

আমরা যদি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর বংশ তালিকা দেখার চেষ্টা করি, তাহলে তা তিনটি ভাগে দেখতে হবে। যার তৃতীয় ভাগে রয়েছেন হযরত আদম (আ) থেকে হযরত ইবরাহীম (আ) পর্যন্ত বংশধারা। দ্বিতীয় ভাগে রয়েছেন  হযরত ইবরাহীম (আ.) থেকে আদনান পর্যন্ত। সর্বশেষ প্রথম অংশে রয়েছেন  আদনান হতে হযরত মুহাম্মদ (সা) পর্যন্ত। আমরা প্রতিটি বংশপরস্পরার তালিকা নিম্নে পেশ করছি।

তৃতীয় অংশ (পৃথিবীর শুরু থেকে) 

হযরত আদম (আ) থেকে তাঁর পুত্র শীশ (আ), তার পুত্র আনুশা থেকে তার পুত্র কায়নান, তার পুত্র মাহলায়েল থেকে তার পুত্র ইয়াদ, তার পুত্র আখনুখ/ইদরিস (আ.) থেকে তাঁর পুত্র মাতুশালাখ, তার পুত্র লামেক থেকে তার পুত্র নূহ (আ.), তাঁর পুত্র সাম থেকে তার পুত্র আরফাখশাদ, তার পুত্র শালেখ থেকে তার পুত্র আবের, তার পুত্র ফালেজ থেকে তার পুত্র রাউ, তার পুত্র ছারুদা (সারুগ) থেকে তার পুত্র নাহুব, তার পুত্র তারাহ (আযর) থেকে তার পুত্র ইবরাহীম (আ)। 

দ্বিতীয় অংশ 

দ্বিতীয় অংশের বংশের তালিকার ব্যাপারে সিরাত লেখকগণের মাঝে কিছু মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ এই তালিকা সমর্থন করেছেন। আবার কেউ কেউ ভিন্নমতও পোষন করেছেন। আবার কিছু কিছু সিরাত বিশারদ বিরোধিতাও করেছেন। তারপরও ইতিহাস থেকে আমরা যতটুকু পেয়েছি তা নিম্মরুপ।

হযরত ইবরাহিম (আ.) থেকে তাঁর পুত্র ইসমাঈল, তাঁর পুত্র কায়দার থেকে তার পুত্র আরাম, তার পুত্র আওযা থেকে তার পুত্র মাযি,  তার পুত্র সুমাই থেকে তার পুত্র জারাহ, তার পুত্র নাহেছ থেকে তার পুত্র মাকছার, তার পুত্র আইহাম থেকে তার পুত্র আফনাদ, তার পুত্র আইশার থেকে তার পুত্র যায়শান, তার পুত্র আই থেকে তার পুত্র আরউই,  তার পুত্র ইয়ালহান থেকে তার পুত্র ইয়াহাজান, তার পুত্র ইয়াসরেবী থেকে তার পুত্র সুনবর, তার পুত্র হামদান থেকে তার পুত্র আদদায়া, তার পুত্র ওবায়েদ থেকে তার পুত্র আবকার,  তার পুত্র আয়েয থেকে তার পুত্র মাখি, তার পুত্র নাহেশ থেকে তার পুত্র জাহেম, তার পুত্র তারেখ থেকে তার পুত্র ইয়াদলাফ,  তার পুত্র বালদাস থেকে তার পুত্র হাজা, তার পুত্র নাশেদ থেকে তার পুত্র আওয়াম, তার পুত্র উবাই থেকে তার পুত্র কামোয়াল, তার পুত্র পোজ থেকে তার পুত্র আওছ,  তার পুত্র ছালামান থেকে তার পুত্র হামিছা, তার পুত্র আওফ থেকে তার পুত্র আদনান।

প্রথম অংশ

প্রথম অংশের তালিকা সম্বন্ধে সকল সিরাত রচয়িতা ও বিশেষজ্ঞগন একমত যে,  এই অংশে কোনো ভুল নেই। এটা আদনান থেকে হযরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত মোটামুটি নির্ভুল। 

১২২ খ্রিস্টপূর্ব আদনান থেকে তার পুত্র মায়া’দ ৮৯ খ্রিস্টপূর্ব, তার পুত্র ৫৬ খ্রিস্টপূর্ব নাযার থেকে তার পুত্র মোদার ২৩ খ্রিস্টপূর্ব, তার পুত্র ১০ খ্রিষ্টাব্দে ইলিয়াস থেকে তার পুত্র মাদরেকা (আমের) ৪৩ খ্রিষ্টাব্দ, তার পুত্র ৭৬ খ্রিষ্টাব্দে খোযায়মা থেকে তার পুত্র কেনানা ১০৯ খ্রিষ্টাব্দ, তার পুত্র ১৪২খ্রিষ্টাব্দে নযর কায়েস থেকে তার পুত্র মালেক ১৭৫ খ্রিষ্টাব্দ, তার পুত্র ফাহার ২০৮ খ্রিষ্টাব্দে (কোরায়েশ উপাধি এবং তাঁর নামে কোরায়েশ গোত্র), তার পুত্র গালেব ২৪১ খ্রিষ্টাব্দে থেকে তার পুত্র লোয়াই ২৭৪ খ্রিষ্টাব্দে, তার পুত্র ৩০৭ খ্রিষ্টাব্দে কা’ব থেকে তার পুত্র ৩৪০ খ্রিষ্টাব্দে মাররা, তার পুত্র ৩৭৩ খ্রিষ্টাব্দে কেলাব থেকে তার পুত্র ৪০৬ খ্রিষ্টাব্দে কুসাই (যায়েদ), তার পুত্র ৪৩৯ খ্রিষ্টাব্দে আবদ মাননাফ (মুগীরা) থেকে তার পুত্র ৪৬৪ খ্রিষ্টাব্দে হাশেম (আমর), তার পুত্র ৪৯৭ খ্রিষ্টাব্দে আবদুল মোত্তালেব (শায়বা) থেকে তার পুত্র ৫৪৫ খ্রিষ্টাব্দে আবদুল্লাহ এবং তার পুত্র ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে হচ্ছেন মোহাম্মদ (সা.)

হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

বিশ্ব শান্তির দূত হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনী লিখতে গেলে কলমের কালি শুকিয়ে যাবে, তবে তাঁর কীর্তিমান জীবনের কথা শেষ হবেনা তারপরও আমরা খুবই সংক্ষিপ্তভাবে তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ গুলো উল্লেখ করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

মহানবী (সা.) এর জীবন দুই ভাগে বিভক্ত। তাঁর নবুওয়াত প্রাপ্তির জীবন এবং নবুওয়াত পূর্ববর্তী জীবন সম্পূর্ণ আলাদা। তাই আমরা তাঁর জীবনকে এখানে দুই ভাগে বিভক্ত করে উল্লেখ করার চেষ্টা করছি।

নবুওয়াত পূর্ববর্তী জীবন

নবুওয়তের পূর্বে হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর  গুরুত্বপূর্ণ চল্লিশটি বছর অতিবাহিত করেছেন। এই অংশে আমরা তাঁর জন্ম, শৈশব, তাঁর লালন পালন, মা, দাদা মৃত্যুসহ খাদিজা (রা.) এর বিয়ে সম্বন্ধেও আলোচনা করব।

জন্মগ্রহণ

আমরা আগেই জেনে অধিকাংশ ঐতিহাসিক ও উলামায়ে কেরামের মতে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে ১২ রবিউল আউয়াল সােমবার হযরত মুহাম্মদ (সা.) পৃথিবীতে আগমন করে। 

বংশ

আমরা ইতিমধ্যে হযরত আদম আ. থেকে হযরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত বংশধারা দেখেছি। যেখানে হযরত মুহাম্মদ (সা.) হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর পুত্র ইসমাঈল (আ.)-এর বংশধর। যার বিস্তৃত শাখার মাধ্যমে মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশােদ্ভূত হাশেমী গোত্রে মহানবী (সা.) জন্মগ্রহণ করেন।

নামকরণ

রাসুলুল্লাহ (সা.) এর মা আমিনা স্বপ্ন যোগে আদিষ্ট হয়ে তাঁর নাম রাখেন “মুহাম্মদ।” 

হালিমার তত্ত্বাবধান

হযরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মের কিছুদিন পরই  আরবের প্রথানুযায়ী তাঁকে লালন পালনের জন্য সাদ গােত্রীয় বিবি হালিমার তত্ত্বাবধানে অর্পণ করা হয়। এই হালিমা (রা.) তাঁকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত তার গৃহে লালিত পালিত করেন।

বক্ষ বিদীর্ণের ঘটনা

হালিমার তত্ত্বাবধানে থাকা অবস্থায় শিশু মুহাম্মদের বক্ষ বিদীর্ণের ঘটনা ঘটে। যাকে আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষায় ওপেন হার্ট সার্জারি বলা হয়। যখন দুজন ফেরেশতা তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ করেছিলেন তখন তাঁর বয়স ছিলো চার। পর্যায়ক্রমে চার বার তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ করে তাঁর আত্মার পরিশুদ্ধি করা হয়। 

মায়ের মৃত্যু

মুহাম্মদ (সা.) দুধ মা হালিমা থেকে ফিরে আসেন ছয় বছর বয়সে। তখন তাঁর  মা আমেনার পূর্ব ইচ্ছানুযায়ী এ বছরই তার পিতার সাক্ষাত ও স্বামীর কবর যিয়ারত করার জন্য শিশু পুত্রকে নিয়ে মদিনায় গেলেন। মদিনা থেকে ফেরার সময় মক্কার অদূরে আবওয়া নামক স্থানে এসে তিনি জ্বরে আক্রান্ত হন। এবং সেখানেই ৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। পরিশেষে  বিশ্বস্ত আয়া উম্মে আয়মন অসহায় শিশু মুহাম্মদকে নিয়ে মক্কায় এসে তাঁর দাদা আবদুল মুত্তালিবের কাছে তাঁকে পৌঁছে দেন।

দাদা আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যু

মায়ের মৃত্যুর পর দাদা আব্দুল মোত্তালিব রাসুলুল্লাহ (সা.) এর দায়িত্ব  বুঝে নেন। কিন্তু বিধির বিধানের কারণে দুই বছর পর তাঁর দাদাও ৫৭৯ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। এভাবে হযরত মুহাম্মদ (সা.) খুব ছোট বয়সেই মাতাপিতা ও পিতামহের স্নেহ হতে বঞ্চিত হলেন।

চাচা আবু তালেবের দায়িত্ব গ্রহণ 

প্রিয় দাদা আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যুর পর তাঁর চাচা আবু তালেব নিজে মুহাম্মদের লালন পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আবু তালেব তাকে তার সাধ্যমত আদর যত্নে প্রতিপালন করার চেষ্টা করেন। কিন্তু চাচার আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকার কারণে বালক মুহাম্মদ (সা.) কেও  কঠোর পরিশ্রম করতে হতাে। 

আল আমিন উপাধি লাভ

ছোটবেলা থেকেই মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন কর্মনিষ্ঠ, সত্যবাদি, সৎ,  সততা, আমানতদারি, বিশ্বস্ততা, বিনম্র স্বভাবের। এইসব কারণে তৎকালীন  সমাজের সকলেই তাকে ভালােবাসত। শুধু তাইনয় তাঁর অমায়িক গুণাবলীর কারণে তাকে তারা আল আমিন উপাধিতে ভূষিত করা হয়  (৫৭৯-৫৮০ খ্রিঃ)।

সিরিয়া যাত্রা  ও পাদ্রীর  ভবিষ্যদ্বাণী

ঐতিহাসিক আমীর আলীর মতে, ৫৮২ খ্রিস্টাব্দে ১২ বছর বয়সে রাসুল (সা.) যখন চাচা আবু তালেবের সাথে বাণিজ্য উপলক্ষে সিরিয়া যাত্রা করেন। তখন তাঁকে এক খ্রিস্টান পাদ্রী দেখতে পায়। এবং তাঁর সম্পর্কে ভবিষ্যৎ বাণী করেন তিনি হবেন শেষ নবি। একইসাথে আবু তালেবকে তার প্রতি লক্ষ্য রাখতে উপদেশ দেন।

হিলফুল ফুযুল

তৎকালীন আরবের অন্ধকার যুগে আরবের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ছিলো আর্তপীড়িত, নির্যাতিত, ব্যথিত অত্যাচারিত। এইসব অত্যাচারিত গোষ্ঠীকে রক্ষা ও আরবে শান্তি স্থাপন করার জন্য কয়েকজন যুবক মিলে ৫৯০ খ্রিস্টাব্দে ‘হিলফুল ফুযুল’ নামে একটি শান্তি সংগঠন গড়ে তােলেন। এ সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল, নিঃস্ব, অসহায় ও দুর্গতদের সেবা করা। অত্যাচারিতকে সাহায্য করা ও অত্যাচারীকে বাধা দেয়া। শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা। গােত্রে গােত্রে সম্প্রীতি স্থাপনের চেষ্টা করা। বিদেশী বণিকদের ধনসম্পদের নিরাপত্তা বিধানের চেষ্টা করা ইত্যাদি।

প্রথম বিবাহ

যুবক বয়সে ২৫ বছরেই মুহাম্মদ (সা.) প্রথম বিবাহ করেন খাদিজা (রা.) কে। যখন তিনি বিবাহ করেন তখন খাদিজা (রা.) এর বয়স ছিলো ৪০। 

হাজরে আসওয়াদ স্থাপন

পবিত্র কাবা শরীফের সংস্কারের সময় হাজারে আসওয়াদ নামক পাথর স্থাপন নিয়ে ব্যাপক বিরােধ দেখা দিলে মহানবী (সা.)-কে সালিস মানা হয়। তিনি এ সময় অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে নিজ হাতেই পাথরটি যথাস্থানে স্থাপন করে দেন। 

হেরার নির্জনতা

তিনি তৎকালীন সময়ের বিভিন্ন অরাজকতা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ইত্যাদির বিরুদ্ধে আপ্রাণ চেষ্টা করার পরও কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। তাঁর চারিদিকে এইসব স্বার্থবাদী চিন্তা চেতনার মাঝে তিনি বেঁচে থাকার মানে খুঁজতে চাইতেন। তাঁর মন সবসময়ই সত্যের দিকে আহবান করতো। তিনি পৃথিবীর এইসব জরাজীর্ণতা ভুলে কোনো একজন ইশ্বরের চিন্তা করতেন। এইসব চিন্তা ভাবনা তাঁকে নির্জন হতে বাধ্য করে। ফলে হেরা গুহার নির্জনতা হয়ে উঠে তাঁর কাছে খুবই প্রিয়।

নবুয়ত লাভ ও দাওয়াতী কার্যক্রম 

মুহাম্মদ (সা.) চাঁদের হিসাব অনুযায়ী ৪০ বছর ৬ মাস ১২ দিন বয়সে রমযান মাসের ২৭ তারিখ সােমবার রাতে হেরা গুহায় ৬১০ খ্রিস্টাব্দে নবুয়ত লাভ করেন। 

নবুয়ত পরবর্তী জীবন 

হঠাৎই নবুওয়াত প্রাপ্তির পর রাসুলুল্লাহ (সা.) জীবনে একটা পরিবর্তন চলে আসে। এই নবুওয়াত লাভের পর তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা গুলো হলাে-

গােপনে দাওয়াতী কাজ

আল্লাহর আদেশ পাওয়ার পর প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি তাঁর পরিচিত শুভাকাঙ্ক্ষী  বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনদের নিকট তিন বছর ধরে গােপনে দাওয়াত প্রচার করতে থাকেন। সাফা পর্বতে আরকাম মাখযুমীর গৃহ ছিল ইসলাম প্রচারের গোপন স্থান ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এ সময় প্রায় ৪০ জন লােক ইসলাম গ্রহণ করেন।

প্রকাশ্যে দাওয়াতী কাজ

নবুওয়াত লাভের তিন বছর পর যখনই তিনি আদিষ্ট হয়েছে যে, আপনি আপনার নিকটাত্মীয়দের সতর্ক করে দিন” এবং “আপনাকে যে বিষয়ে আদেশ করা হয়েছে তা সুস্পষ্টভাবে সর্বসাধারণকে জানিয়ে দিন এবং এ ব্যাপারে মুশরিকদের পরােয়া করবেন না।” তখন থেকেই তিনি প্রকাশ্যে ইসলামের দাওআত দেওয়া শুরু করেন।

মক্কায় বিরোধীতার সম্মুখীন 

ইসলামের দাওআতের শুরু থেকেই রাসুলুল্লাহ (সা.) বিভিন্ন বাঁধার সম্মুখীন হতে থাকেন। বিশেষকরে তাঁর বংশ কুরাইশ থেকে তিনি ব্যাপক বাঁধা বিপত্তির মুখে পড়েন। এমনকি তারা ইসলাম গ্রহণকারীদের ওপর এবং মুহাম্মদ (সা.) এর উপরও অমানুষিক নির্যাতন শুরু করে।

আবিসিনিয়ায় হিজরত

দিনদিন কুরাইশদের অত্যাচার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে তাদের হাত থেকে রক্ষা পেতে হিজরতের সিদ্ধান্ত আসে।  রাসুলুল্লাহর  নির্দেশে নবুওয়তের পঞ্চম বছরের সপ্তম মাসে ৬১৫ সালে হযরত ওসমান (রা.) এর নেতৃত্বে পনেরোজন এবং দ্বিতীয়বার ৬১৬ সালে আঠারোজন মহিলাসহ মোট একশতজন মুসলমান আবিসিনিয়ার রাজা নাজ্জাসীর কাছে আশ্রয় নেন।

গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ইসলাম গ্রহণ

এইসময় ইসলামের ইতিহাসে যে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটে তা হলো উমর ইবনুল খাত্তাবের ইসলাম গ্রহণ। রাসুলুল্লাহ (সা.) সবসময় চাইতেন যেন আবু জেহেল ও উমরের মধ্যে যেকোন একজন অন্তত ইসলাম গ্রহণ করে। এই সময়ে হযরত উমর এবং হামজা (রা.) ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমানদের শক্তি আরও বৃদ্ধি করে। 

রাসুলুল্লাহকে একঘরে করা  

ইসলাম প্রচারের ৬ষ্ঠ বৎসরে হযরত হামজা ও ওমর (রা.) ইমান আনার পর, মুসলমানরা প্রকাশ্যে দাওআত দিতে শুরু করে। মুসলমানদের এই স্পর্ধা দেখে তৎকালীন কুরাইশ নেতারা তাদের একঘরে করার সিদ্ধান্ত নেয়। যারফলে কুরাইশরাসহ সকল জনগণ মুসলমানদের সাথে কথাবার্তা, ক্রয়-বিক্রয় ও বৈঠক সম্পর্ক স্থাপন ইত্যাদি সকল প্রকার মেলামেশা বন্ধ করে দেয়। 

রাসুলুল্লাহ (সা.) নব্য মুসলমানদের নিয়ে  ‘শিয়াবে আবু তালেব’ নামক নির্জন পার্বত্য উপত্যকায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। এতে করে খুব শীঘ্রই তাদের খাদ্যসামগ্রীর অভাব অনটন দেখা দিল। তিন বৎসর পর্যন্ত এই অবস্থা চলতে লাগল। এই সময়ে মুসলিমরা নানান কষ্টের সম্মুখীন হন। একসময় কুরাইশরা তাদের এ বর্জননীতি ত্যাগ করলে হাশেম ও মুত্তালিব গােত্রদ্বয়ের লােকজন নিজ নিজ ঘরে ফিরে আসলেন।

আমুল হুযন বা শােকের বছর

মুহাম্মদ (সা.) তাঁর দ্বীন প্রচারের প্রথম দিন থেকেই খাদিজা (রা.) ছিলেন তাঁর সুখ দুঃখের সঙ্গী। তিনি ছিলেন রাসুলুল্লাহর সকল বিপদ আপদে সান্ত্বনাদানকারী, পরামর্শদাতা ও সাহায্যকারী। আর পিতৃতুল্য আবু তালেব ছিলেন তার শৈশবের আশ্রয়স্থল, যৌবনের অভিভাবক, সাহায্যকারী ও পরবর্তী জীবনের সকল কাজের একনিষ্ঠ সমর্থক। তিনি নিজে ইমান না আনলেও মুহাম্মদকে সর্বাবস্থায় সার্বিকভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে গেছেন।

এই অবস্থায় নবুওয়তের দশম বছর ৬২০ খ্রিস্টাব্দে এই দুজন মহান ব্যক্তির মৃত্যুতে রাসুল (সা.) শােকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন এবং নিজেকে খুবই অসহায় ভাবতে লাগলেন। এজন্য এ বছরটি আমুল হুন বা শােকবর্ষ নামে পরিচিত। 

তায়েফে দাওআত

নিজ পিতৃভূমিতে ইসলাম প্রচার করতে না পেরে নবুওয়তের দশম বছর মুহাম্মদ (সা.) ইসলাম প্রচারের জন্য তায়েফ যাত্রা করেন। কিন্তু তাঁর সেই যাত্রা শুভ হয়না। সেখানে তিনি ব্যাপক বর্বরতম নির্যাতনের স্বীকার হন। এমনকি তাঁকে রক্তাক্ত হয়ে ফিরে আসতে হয়। 

মিরাজে গমন

নবুয়তের দশম বর্ষে রজব মাসে আল্লাহর বিশেষ আমন্ত্রণে মুহাম্মদ (সা.) মিরাজে গমন করেন। এ সময় তিনি জান্নাত ও জাহান্নাম দর্শন, আল্লাহর সাক্ষাৎলাভসহ পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ইত্যাদির নির্দেশপ্রাপ্ত হন।

আকাবার শপথ

মদিনাবাসীরা হজ্জের মৌসুমে হজ্ব করতে আসলে তাঁদের নিকট রাসুলুল্লাহ (সা.) দ্বীন প্রচার করতেন। তারই ধারাবাহিকতায় ৬২১ ও ৬২২ সালে হজ্জের মৌসুমে তারা রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তারা সংখ্যায় ছিলেন যথাক্রমে ১২ ও ৭৫ জন। এইসব মদিনাবাসী আকাবা উপত্যকায় রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ইসলাম গ্রহণ করেন। একইসাথে তারা রাসুল (সা.) কে তাদের দেশে হিজরত করার আমন্ত্রণ জানান। ইসলামের ইতিহাসে একে বায়তুল আকাবা বলা হয়। এই শপথ দু’বার অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে এটাকে আকাবার প্রথম ও দ্বিতীয় শপথ বলে উল্লেখ করা হয়। ইসলাম প্রচারে এই শপথের ভূমিকা ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 

মদিনায় হিজরত

শেষপর্যন্ত মক্কাবাসীর অত্যাচার সইতে না পেরে রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য হন। তিনি ৬২২ সালে ২ জুলাই  মদিনায় হিজরত করেন।

মদিনার জীবন

রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় আসার সাথে সাথেই তাঁর সকল গুণাবলী দ্বারা সবাইকে আকৃষ্ট করতে লাগলেন। ফলে দ্রুতই সবাই রাসুল (সা.) কে মেনে নিয়ে তাকে সাহায্য সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসলেন। 

স্বাধীন রাষ্ট্র ও সংবিধান প্রণয়ন

রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় আসার সাথে সাথেই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করলেন একজন মধ্যস্থতাকারী এবং শাসক হিসেবে। তখন সেখানে বিবদমান দুটি মূল পক্ষ ছিল। যার নাম ছিলো আওস ও খাযরাজ। তিনি তার দায়িত্ব সুচারুরুপে পালন করেছিলেন। মদিনার সকল বিবাদমান গোত্রকে নিয়ে ঐতিহাসিক মদিনা সনদ স্বাক্ষর করেন। যা পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম সংবিধান হিসেবে পরিচিত।

এই সনদের মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যে সকল রক্তারক্তি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এমনকি এর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতির গোড়াপত্তন করা হয়। একইসাথে সকল গোত্রের মধ্যে জবাবদিহিতার সংস্কৃতি তৈরি করা হয়। আওস এবং খাযরাজ উভয় গোত্রই ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এছাড়াও প্রধানত তিনটি ইহুদি গোত্র ছিলো (বনু কাইনুকা, বনু কুরাইজা এবং বনু নাদির)। এগুলোসহ মোট আটটি গোত্রকে এই সনদের আওতায় আনা হয়েছিল। এই সনদের মাধ্যমে মদিনা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হন তার প্রধান শাসনকর্তা।

মক্কার সাথে যুদ্ধ

মদিনায় হিজরতের সাথে সাথেই বিপুল পরিমাণ মানুষ ধীরে ধীরে ইসলামে প্রবেশ করতে থাকে। যা মক্কাবাসীদের জন্য ভয়ের কারণ হিসাবে দেখা দেয়। একারণে মক্কার সাথে মদিনার সম্পর্ক দিন দিন খারাপ হতে থাকে। এদিকে রাসুলুল্লাহ (সা.) চাইছিলেন শান্তি। তাই তিনি মদিনার আশেপাশের সকল গোত্রের সাথে সন্ধি চুক্তি স্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

ওদিকে মক্কার কুরাইশরা হিজরতকারী  সকল মুসলিমদের সম্পত্তি ক্রোক করে ফেলে। এই অবস্থায় ৬২৪ সালে মুহাম্মাদ (সা.) ৩০০ সৈন্যের একটি সেনাদলকে মক্কার একটি বাণিজ্যিক কাফেলাকে বাঁধা দেয়ার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। কারণ কাফেলাটি বাণিজ্যের নাম করে অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করছিল। শেষপর্যন্ত কাফেলাটি সফলভাবে তাদের রক্ষা করে। কিন্তু মুসলমানদের এই স্পর্ধার জন্য তারা যুদ্ধের ডাক দেয়। 

মুসলমানদের আত্মরক্ষামূলক এই যুদ্ধে সৈন্য সংখ্যার দিক দিয়ে কুরাইশদের এক তৃতীয়াংশ হওয়ার পরও বিজয় লাভ করে। এই যুদ্ধ বদর যুদ্ধ নামে পরিচিত যা ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মার্চ তারিখে সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধ আল্লাহ সরাসরি মুসলিমদের সহায়তা করে। 

এরপর ৬২৫ সালের ২৩ মার্চে উহুদ যুদ্ধ সংঘটিতে হয়। যে যুদ্ধে শুরুর দিকে মুসলিমরা পরাজিত হলেও যুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে মদিনায় প্রবেশ করে।  কুরাইশরা বিজয়ী হওয়া সত্ত্বেও চূড়ান্ত মুহূর্তের নীতিগত দূর্বলতার কারণে পরাজিত হয়। ৬২৭ সালে আবু সুফিয়ান কুরাইশদের আরেকটি দল নিয়ে মদিনা আক্রমণ করে। কিন্তু এই যুদ্ধে যা  খন্দকের যুদ্ধ নামে পরিচিত কুরাইশরা   মুসলিমদের কাছে পরাজিত হয়। এই যুদ্ধের পর পরই মুসলিমরা আরবে একটি প্রভাবশালী শক্তিতে পরিণত হয়। ফলে আশেপাশের প্রায় সকল গোত্রের উপরই মুসলিমরা প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়।

ইহুদিদের সাথে সম্পর্ক

মদিনায় রাসুলুল্লাহ (সা.) হিজরতের পর থেকেই ইহুদিরা নানাভাবে তাঁর বিরোধিতা করার চেষ্টা করে। তারা কোনোমতেই একজন অ-ইহুদিকে শেষ নবি হিসাবে মেনে নিতে পারে না। এজন্য তারা কখনোই ইসলামের আদর্শকে মেনে নেয়নি। এমনকি সুযোগ পেলেই তারা ইসলামের বিরুদ্ধে লেগে যেতো। একারণে  মুহাম্মাদ (সা.) প্রতিটি যুদ্ধের পরে একটি করে ইহুদী গোত্রের উপর আক্রমণ করে তাদের দুর্বল করে দিতো। বদর ও উহুদের যুদ্ধের পর বনু কাইনুকা ও বনু নাদির গোত্রকে সপরিবারে মদিনা থেকে বিতাড়িত হয়। আর খন্দক যুদ্ধের পর সকল ইহুদিকে মদিনা থেকে বিতাড়ন করা হয়। 

হুদাইবিয়ার সন্ধি

রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনোই যুদ্ধ দ্বারা শান্তি স্থাপন করতে চাননি। সবসময়ই তিনি যুদ্ধ প্রতিহত করে গেছেন। তেমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো হুদাইবিয়ার সন্ধি। হজ্জের মৌসুমে রাসুলুল্লাহ (সা.) হিজরি সনের শাওয়াল মাসে হজ্জ্বের উদ্দেশ্যে মদিনার পথে যাত্রা করেন। তাঁর সাথে সাহাবা ছিলেন  ১৪০০ জন। কিন্তু কুরাইশরা সুযোগ বুঝে তাদের হজ্জ্ব করতে বাঁধা দেয়। ফলে মুসলমানরা  মক্কার উপকণ্ঠে হুদাইবিয়া নামক স্থানে ঘাঁটি স্থাপন করে। 

এখানে কুরাইশদের সাথে মুসলিমদের একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা ইতিহাসে হুদাইবিয়ার সন্ধি নামে সুপরিচিত। এই সন্ধি মতে মুসলমানরা সে বছর হজ্জ্ব করা ছাড়াই মদিনায় প্রত্যাবর্তন করে। এখানে বিশেষ উল্লেখযোগ্য যে এই সন্ধি চুক্তির অধিকাংশ শর্তই মুসলিমদের বিরুদ্ধে গিয়েছিল। তারপরও বিশেষ কারণে  মুহাম্মাদ (সা.) এই চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন।

রাষ্ট্রনায়কদের ইসলামের দাওআত

রাসুলুল্লাহ (সা.) বিশ্বের সকল মানুষের নবি হিসাবে প্রেরণ হয়েছেন। তাই তিনি ধীরে ধীরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসলামের দাওআত পৌঁছানোর নিমিত্তে দূত ও চিঠি পাঠাতে লাগলেন। 

ঐসময় পৃথিবীর প্রধান রাজশক্তিগুলো ছিল ইউরোপের রোম সাম্রাজ্য, এশিয়ার পারস্য সাম্রাজ্য এবং আফ্রিকার হাবশা সাম্রাজ্য। এছাড়াও মিশরের ‘আযীয মুকাউকিস, ইয়ামামার সর্দার এবং সিরিয়ার গাসসানী শাসনকর্তাও বেশ প্রতাপশালী ছিল। তাই ষষ্ঠ হিজরীর জিলহজ্জ মাসের শেষদিকে রাসুলুল্লাহ (সা.) একইদিনে এদেঁর কাছে ইসলামের দাওআতপত্রসহ ছয়জন দূত প্রেরণ করেন।

মক্কা বিজয় 

হুদাইবিয়ার সন্ধি ছিলো দশ বছরের। কিন্তু এই সন্ধি মাত্র দুই বছরেই ভেঙ্গে যায়। এর কারণ ছিলো চুক্তিভঙ্গ।  খুযাআহ গোত্র ছিল মুসলমানদের বন্ধু। অপরদিকে তাদের শত্রু বকর গোত্র ছিল কুরাইশদের বন্ধু। একরাতে বকর গোত্র খুযাআদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়। কুরাইশরা এই আক্রমণে অন্যায়ভাবে বকর গোত্রকে অস্ত্রসহ বিভিন্নভাবে সহয়োগিতা করে। এই ঘটনার পর মুহাম্মাদ (সা.) কুরাইশদের কাছে তিনটি শর্তসহ পত্র পাঠান।  এবং তিনটি শর্তের যে কোনো একটি মেনে নিতে বলেন। শর্ত গুলো হলো, 

ক) কুরাইশরা খুজাআ গোত্রের নিহত পরিবারকে রক্তপণ পরিশোধ করবে।

খ) অথবা তারা বকর গোত্রের সাথে তাদের মৈত্রীচুক্তি বাতিল ঘোষণা করবে।

গ) অথবা এ ঘোষণা দিবে যে, হুদায়বিয়ার সন্ধি বাতিল হয়েছে এবং আমরা কুরাইশরা যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত।

কুরাইশরা জানালো যে, তারা তৃতীয় শর্তটি অর্থাৎ যুদ্ধই করবে। কিন্তু পরবর্তীতে কুরাইশরা বুঝতে পারলো তারা ভুল করছে। কেননা ইতিমধ্যে মুসলমান তাদের শক্তি সমর্থ দিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। তাই তাদের সাথে  যুদ্ধ করা কুরাইশদের জন্য এই মুহূর্তে উচিত হবে না। তাই তারা আবু সুফয়ানকে সন্ধি নবায়নের করার জন্য দূত হিসেবে মদিনায় প্রেরণ করলো। কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সা.) আবু সুফিয়ানের এই সন্ধি নবায়ন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। এবং মক্কা আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করলেন।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৬৩০ সালে মুহাম্মাদ (সা.) দশ হাজার সাহাবীর বিশাল বাহিনী নিয়ে মক্কাভিমুখে রওয়ানা দিলেন। ঐদিন ছিল হিজরির অষ্টম বছর রমজান মাসের দশ তারিখ। মোটামুটি কোনো বাঁধা প্রতিরোধ ছাড়াই মুহাম্মাদ (সা.) বিজয়ীবেশে মক্কায়  প্রবেশ করলেন। এবং প্রবেশ করেই তিনি মক্কাবাসীর জন্য সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা করলেন।

মক্কা প্রবেশের সাথে সাথেই মুহাম্মাদ (সা.) সর্বপ্রথম কাবাঘরে প্রবেশ করেন এবং সেখানকার সকল মূর্তি ধ্বংস করেন। মুসলমানদের শান শওকত দেখে এবং মুহাম্মাদ (সা.) এর ক্ষমাগুণে মুগ্ধ হয়ে অধিকাংশ মক্কাবাসীই ইসলাম গ্রহণ করে।

মৃত্যু

বিদায় হজ্জ্ব থেকে ফেরার পর ১১ হিজরির সফর মাসে মুহাম্মদ (সা.) জ্বরে আক্রান্ত হন। জ্বরের অসুস্থতা নিয়েও তিনি এগারো দিন নামাজের ইমামতি করেন। অসুস্থতা তীব্র হওয়ার পর তিনি সকল স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে আয়েশা (রা.) এর কামরায় অবস্থান করতে থাকেন। তখন তাঁর কাছে সাত আট দিনারের মতো ছিল, মৃত্যুর একদিন পূর্বে তিনি এগুলোও দান করে দেন। এটা ছিলো সেই অসুস্থতা যা খাইবারের এক ইহুদি নারীর বিষ মেশানো খাবার খাওয়ার ফলে হয়েছিল। 

অবশেষে ১১ হিজরী সালের রবিউল আউয়াল মাসের সোমবার তিনি মৃত্যবরণ করেন। এ সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। তাঁর কাফন এবং গোসল করান হযরত আলী (রা.)।  আয়েশা (রা.) এর ঘরের যে কক্ষটির যে জায়গায় রাসুলুল্লাহ সা. মৃত্যুবরণ করেন, জানাযার পর তাঁকে সেখানেই কবরস্থ করা হয়।

হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী গ্রন্থ

  • সিরাত ইবনে ইসহাক, আল্লামা ইবনে ইসহাক (রহ.)
  • সিরাতে ইবনে হিশাম, আবু মুহাম্মদ আব্দুল মালেক ইবনে হিশাম ইবনে আইয়ুব
  • আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, আবুল ফিদা ইবনে কাসির (রহ.)
  • আর-রাহিকুল মাখতুম, আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী
  • সিরাতে মোস্তফা, আল্লামা ইদরিস কান্ধলভী (রহ.) 
  • নবীয়ে রহমত, আলেম সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) 
  • বিশ্বনবি, কবি গোলাম মোস্তফা
  • তোমার স্মরণে হে রাসুল, মাওলানা আবদুল মাজেদ দরিয়াবাদী 
  • বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনী, শাইখুল হাদিস আল্লামা বশির উদ্দিন
  • সীরাতে খাতামুন্নাবীঈন, মোহাম্মদ আফতাব উদ্দীন, 
  • সীরাতে খাতিমুল আম্বিয়া (সা.), হযরত মাও মুহা. মুফতি শফী 
  • সীরাতে মুস্তফা. আল্লামা ইদ্রীস কান্দলভী (রহ.)
  • হযরত মুহাম্মদ সা- আমাদের বিপ্লবের নকশা, মুহাম্মদ যাইনুল আবেদীন
  •  সীরাতে রসূলে পাক (সঃ), মাও মো. আখতার ফারুক
  • মানবতার প্রতীক হযরত মুহাম্মদ (স), আনু মাহমুদ
  • সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হযরত মুহাম্মদ (স), মোঃ আব্দুল করিম খান
  • বিশ্বশান্তি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার হযরত  মুহাম্মদ. মাওঃ রুহুল আমীন
  • বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা) মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত, শফিউল ইসলাম
  • বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনী. অধ্যাপক মাওলানা সিরাজউদ্দীন
  • শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় হযরত মুহাম্মদ (সা.), হযরত মাও: মুফতী শফী (র.),
  • বিজ্ঞানীর বিজ্ঞানী মহাজ্ঞানী হযরত মুহাম্মদ. মোস্তাক আহমাদ
  • আল-কোরানের আলোকে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স), মাও. মমতাজ উদ্দিন আহম্মেদ
  • বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)এর জীবনী. ড. এনামুল হক
  • মুহাম্মদ (স), তওফিকুল হাকীম মিশরী. 
  • সীরাতে খাতিল আম্বিয়া. মুফতী মুহাম্মদ শফি রাহ
  • সহজ বাংলা সীরাতে খাতেমুল আম্বিয়া. মুফতী মীযানুর রহমান কাসেমী,
  • সীরাতে মুস্তফা (স), ইমাম নব্বী (রহঃ)
  • সীরাতে রাসূলে আকরাম : বিশ্ব নবীর জীবনী. মুফতী মীযানুর রহমান কাসেমী
  • সীরাতে ইবনে হিশাম, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার
  • সীরাত এলবাম, আহমদ বদরুদ্দীন খান
  • মহানবীর সীরাত কোষ, খান মোসলেহ উদ্দীন আহমদ
  • সীরাত রসূলূল্লাহ (সা:), ইবনে ইসহাক,  শহীদ আখন্দ
  • সীরাত বিশ্বকোষ,  ইসলামিক ফাউন্ডেশন
  • সীরাতুন্নবী (স), ড. মোঃ ইব্রাহীম খলিল
  • বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনী , আল্লামা শিবলী নোমানী (রহ.)
  • মুহাম্মদ : মহানবীর (স:) জীবনী, ক্যারেন আর্মস্ট্রং
  • বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) জীবনী, সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)
  • বিশ্বনবীর হযরত মুহাম্মদ (স.) জীবনী, মাওলানা আহমদ সৈয়দ কাওছার
  • বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) জীবনী, মাওলানা মুহাম্মদ ইদরীস কান্দলভী
  • হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনী, শেখ মোহাম্মদ ইসমাইল
  • হযরত মুহাম্মদ (সা.) জীবনী , আবদুর রউফ মাহমুদ
  • হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর জীবনী, রশিদ আহমেদ
  • বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) এর জীবনী, আলহাজ্জ মাওলানা ফজলুর রহমান
  • সুলতান আবদুল হামিদ, ড. আলী মুহাম্মদ সাল্লাবী
  • বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর জীবনী, অধ্যাপক মাওলানা মুনছুর আহমেদ
  • বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) এর জীবনী, মাওলানা আব্দুর রহীম
  • বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনী, মাওলানা ফজলুল করীম আনওয়ারী
  • বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) এর জীবনী, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ
  • বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনী,  মাওঃ শামছুল হুদা
  • বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) এর জীবনী , মাওলানা রেজাউল করীম কাশ্মীরী
  • বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) এর জীবনী, প্রফেসর ড. এবিএম সিদ্দিকুর রহমান
  • বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) এর জীবনী, মাওলানা আহমদ ছৈয়দ কাওছার
  • মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লাম, মার্টিন লিংস

হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর মৃত্যু তারিখ

ইসলামে বার্ষিকী কোনো দিবস নেই। অর্থাৎ জন্মদিন বা জন্মবার্ষিকী কিংবা মৃত্যুবার্ষিকী ইত্যাদির সংস্কৃতি ইসলামের অন্তর্ভূক্ত নয়। যেকারণে নবি রাসুল থেকে শুরু করে সাহাবী তাবেয়ী তবেতাবেয়ী পর্যন্ত কারোরই জন্মদিন কিংবা মৃত্যুদিনের সঠিক হিসাব রাখা হয়নি এবং হতোনা। 

আমরা অনেকেই জানি না, আরবি হিজরি ক্যালেন্ডার রাসুলুল্লাহর জীবদ্দশায় প্রচলিত ছিলো না। এই হিজরি ক্যালেন্ডার চালু করেন উমর (রা.) তাঁর শাসনামলে। যারফলে আরব দেশে আরবি মাস চালু থাকলেও আরবি সন কিংবা তারিখের কোনো প্রচলন ছিলো না।

উপরোক্ত বিভিন্ন কারণে আমাদের রাসুলুল্লাহ (সা.) এর মৃত্যুদিনের তারিখ নিয়েও যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। কিছু ইতিহাসবিদের মতে রবিউল আউয়াল এর বার তারিখ সোমবার, কারো কারো মতে রবিউল আউয়াল মাসের দুই তারিখ সোমবার আর কারো মতে রবিউল আউয়াল মাসের এক তারিখ সোমবার রাসুল (সা.) ইন্তেকাল করেন। 

প্রত্যেকেই নিজেদের দাবির পক্ষে  পথে প্রমাণ পেশ করেছেন। অনেক সীরাত প্রণেতা  বার ও দুই তারিখকে বিশুদ্ধ মনে করেনি অনেক গুলো যুক্তির বিচারে। বিশ্বে রবিউল আউয়ালের ১২ তারিখকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। তবে কেউই রাসুলুল্লাহ (সা.) এর মৃত্যুদিবস পালন করে না। যাইহোক রাসুল (সা.) এর ওফাতের ব্যাপারে যেসব বিষয়ে ইতিহাসবিদগণ একমত হয়েছেন তা নিন্মরূপ, 

ক) রাসুল (সা.) ১১ হিজরিতে মৃত্যুবরণ করেন।

খ) তিনি রবিউল আউয়াল মাসেই মৃত্যুবরণ করেন

গ) তাঁর মৃত্যুর দিন হচ্ছে সোমবার

উপরোক্ত এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে সার্বিক সবকিছু বিবেচনা করলে রবিউল আউয়াল মাসের এক তারিখই সোমবার পড়ে। বিভিন্ন হিসাব মতে ২ এবং ১২ তারিখ সোমবার পড়ে না। বাকিটুকু আল্লাহই ভালো জানেন। এই বিষয়ে বিস্তারিত রয়েছে সীরাতুন নবী ২/৪৭৭ এবং তাফসীরে তবারী ৬/৯৬ গ্রন্থে। 

প্রশ্নোত্তর

হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর স্ত্রীদের নাম কি?

রাসুল (সা.) প্রথম বিয়ে করেন খাদিজা (রা.) কে। যখন রাসুলের বয়স ছিলো ২৫ এবং তাঁর স্ত্রীর বয়স ছিলো ৪০। তাঁর মৃত্যুর পরই রাসুল (সা.) পরবর্তী বিয়ে গুলো করেন। যে বিয়ে সবগুলোর পেছনে ঐতিহাসিক রাজনৈতিক এবং কৌশলগত বিভিন্ন কারণ  ছিলো। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সবগুলো স্ত্রীই ছিলো বিধবা কিংবা স্বামী পরিত্যক্তা। শুধুমাত্র মা আয়িশা সিদ্দিকা ছিলেন একমাত্র কুমারী স্ত্রী। হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর পুরো জীবনে ১৩ জন মহিলাকে বিয়ে করেন। নিচে তাদের নাম দেওয়া হলো। 

  • খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ। যাকে রাসুল (সা.) বিয়ে করেন ৫৯৫ সালে। এবং তাঁর মৃত্যু হয় ৬১৯ সালে।  (৫৯৫–৬১৯)
  • সাওদা বিনতে জামআ। যার সাথে রাসুল (সা.) এর বিয়ে হয় ৬১৯ সালে।  
  • আয়িশা সিদ্দিকা। যিনি ছিলেন হযরত আবু বকর (রা.) এর কন্যা। তিনি ছিলেন  রাসুলের  একমাত্র কুমারী স্ত্রী ছিলেন। তার সাথে রাসুলের বিয়ে হয়   ৬১৯ সালে।
  • হাফসা বিনতে উমর। যিনি ছিলেন হযরত উমর (রা.) এর কন্যা। তাঁর সাথে রাসুলের বিয়ে হয়  ৬২৪।
  • জয়নব বিনতে খুযায়মা। যার সাথে রাসুলের বিয়ে  ৬২৫ সালে।
  • উম্মে সালামা হিন্দ বিনতু আবি উমাইয়া। তাঁর সাথে রাসুলের বিয়ে  ৬২৯ সালে। 
  • জয়নব বিনতে জাহশ। যার সাথে  ৬২৭ সালে রাসুলের বিয়ে হয়।
  • জুওয়াইরিয়া বিনতে আল-হারিস। যার সাথে বিয়ে হয় ৬২৮ সালে।
  •  রামালাহ বিনতে আবি সুফিয়ান। যার সাথে বিয়ে হয়  ৬২৮ সালে।
  • রায়হানা বিনতে জায়েদ। যার সাথে বিয়ে ৬২৯ সালে।
  • সাফিয়া বিনতে হুওয়াই। যার সাথে বিয়ে হয় ৬২৯ সালে।
  • মায়মুনা বিনতে আল-হারিস। যার সাথে বিয়ে হয়  ৬৩০ সালে।
  • মারিয়া আল-কিবতিয়া। যার সাথে বিয়ে হয়  ৬৩০ সাথে। 

হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর মাতার নাম কি?

হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর মাতার নাম হচ্ছে আমিনাহ বিনতে ওয়াহাব। যার মৃত্যু ৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে। যার পিতার নাম ওয়াহাব ইবনে আবদ মান্নাফ (বনু জহরা) এবং মাতার নাম বাররাহ বিনতে আবদুল উজ্জা (বনু ‘আব্দ আল-দার)। যার স্বামীর নাম আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব। 

তিনি কেমন খাবার পছন্দ করতেন?

রাসুল (সা.) ছিলেন খুবই পরিমিত খাদ্য গ্রহনকারী। তিনি কখনোই খাবার অপচয় করতেন না। তবে রাসুল (সা.) বেশ কিছু খাবার খেতে পছন্দ করতেন এবং আহারের সময় বেশ কিছু নিয়ম মেনে চলতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) ডান হাতে খাবার খেতেন এবং ডান হাতে খাওয়ার নির্দেশ দিতেন, সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৩৭৭৬। একইসাথে তিনি খাবার খাওয়ার আগে বিসমিল্লাহ বলে শুরু করতেন,  সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৩৭৬৭। শুধু তাইনয় রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনও খাদ্যের দোষ বর্ণনা করতেন না। রুচি হলে তিনি খেতেন, আর রুচি না হলে বাদ দিতেন,  সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৩৭৬৩। নিচে আমরা তাঁর পছন্দের কিছু খাবারের তালিকা পেশ করছি। 

খেজুর 

মুহাম্মদ (সা.) এর পছন্দের তালিকায় প্রথমে যে খাবারটি রয়েছে, সেটি হলো খেজুর। তিনি প্রায়শই খেজুর খেতেন। (আবু দাউদ – ৩৮৩০, ৩৮৩১) বুসর আস-সুলামীর দুই পুত্রের সূত্র থেকে বর্ণিত, তারা উভয়ে বলেন, একদা রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের বাড়িতে প্রবেশ করলেন। আমরা তাঁকে পনীর ও খেজুর খেতে দিলাম। তিনি পনীর ও খেজুর খুব পছন্দ করতেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৩৮৩৭)

লাউ 

রাসুলুল্লাহ (সা.) এর পছন্দের তালিকায় আরেকটি খাবার হচ্ছে লাউ। যা তিনি খুবই আগ্রহ নিয়ে খেয়েছেন বলে হাদিসে বর্ণিত।(শামায়েলে তিরমিজি : ২৬২)

মিষ্টান্ন ও মধু

রাসুল (সা.) এর সবচেয়ে বেশী পছন্দের খাবার হচ্ছে মধু এবং মিষ্টি জাতীয় খাবার। হজরত মা আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুল (সা.) মিষ্টান্ন ও মধু পছন্দ করতেন”,  (বুখারি : ৫১১৫; মুসলিম : ২৬৯৫)। বুখারি শরিফের ৫৩৫৯ নং হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মধু হলো উত্তম ওষুধ।” একদা রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সামনে মাখন ও খেজুর পেশ করা হলে তিনি তা খেলেন।  তিনি মাখন পছন্দ করতেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৩৩৩৪)

কিশমিশ

রাসুল (সা.) আঙ্গুরের তৈরি কিশমিশ পছন্দ করতেন। মুসলিম শরিফের হাদিসে এসেছে ‘রাসুল (সা.) এর জন্য কিশমিশ ভিজিয়ে রাখা হতো এবং তিনি সেগুলো পান করতেন।’ 

সারিদ

রাসুলুল্লাহ (সা.) সারিদ খেতে পছন্দ করতেন। আবু দাউদ, তিরমিজি, বুলুগুল মারাম হাদিস গ্রন্থে একটি হাদিস এসেছে, যেখানে রাসুল (সা.) এর সামনে পেয়ালায় করে সারিদ বা সুরুয়াতে ভিজানো রুটি আনা হলে রাসুল (সা.) বললেন – তোমরা চতুর্দিক থেকে খাও, মধ্য থেকে খেওনা – কেননা বারকাত মধ্যেই অবর্তীণ হয়।” (আবু দাউদ ৩৭৭২, তিরমিযি ১৮০৫, ইবনু মাজাহ ৩২৭৭, দারিমী ২০৪৫, বুলুগুল মারাম, হাদিস নং ১০৫০)

তরমুজ

হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) তাজা খেজুর দিয়ে তরমুজ খেতেন। তিনি বলতেন, “এর ঠান্ডা ওটার গরম কমাবে এবং এর গরম ওটার ঠান্ডা কমিয়ে দিবে।”  (আবু দাউদ হাদিস : ৩৮৩৬, বুখারি :  ৫১৩৪, তিরমিজি : ১৮৪৪)

দুধ ও মাখন

হযরত মুহাম্মদ (সা.) দুধ ও মাখন পছন্দ করতেন। বুখারি হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী মিরাজের রাতে জিবরাইল (আ.) রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সামনে শরাব ও দুধের আলাদা দুটি পাত্র রাখেন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.)  দুধের পাত্রটি নির্বাচন করেন। তখন জিবরাইল (আ.) বললেন, ‘আপনি প্রকৃত ও স্বভাবজাত জিনিস নির্বাচন করেছেন, বুখারি : ৮২,  সুনানে ইবনে মাজাহ : ৩৩৩৪। 

খাসির পায়া

হজরত মা আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমরা ছোট খাসির পায়া রান্না করতাম। রাসুল (সা.) কুরবানির ১৫ দিন পরও সেগুলো খেতেন।’

জলপাই

রাসুলুল্লাহ (সা.) জলপাই খাওয়া পছন্দ করতেন। যাইদ ইবনু আসলাম (রহ.) হতে তার পিতা থেকে বর্ণিত, উমার ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন তোমরা (যাইতুনের) তেল খাও এবং তা শরীরে মালিশ কর। কেননা এটা বারকাত ও প্রাচুর্যময় গাছের তেল। সহিহ, ইবনু মা-জাহ (১৩১৯), জামে’ আত-তিরমিজি, হাদিস নং ১৮৫১

পনির

রাসুলুল্লাহ (সা.) পনির পছন্দ করতেন। ইবনু ‘উমার (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, তাবুকের ময়দানে নবি (সা.) এর নিকট পনীরের একটি টিকা আনা হলে তিনি ছুরি নিয়ে ডাকলেন এবং বিসমিল্লাহ বলে তা টুকরা টুকরা করলেন, সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৩৮১৯। 

মোরগ

রাসুল (সা.) মোরগের মাংস খুবই পছন্দ করতেন। যাহ্‌দাম আল-জারমী (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমি আবু মুসা (রা.)-এর সামনে গেলাম। তিনি তখন মুরগীর গোশত খাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, আমার সামনে এগিয়ে এসো এবং খাবারে অংশগ্রহণ কর। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আমি মুরগীর গোশত খেতে দেখেছি। সহিহ, ইরওয়া (২৪৯৯), আত-তিরমিজি, হাদিস নং ১৮২৬ ১৮২৭। 

সিরকা

রাসুল (সা.) সিরকা পছন্দ করতেন। কোনো একদিন রাসুল (সা.) সাহাবী জাবের (রা.) পরিবারে সালন চাইলে তারা তাঁকে সিরকা দিলেন। তিনি সিরকা খেয়ে বলেন, “সিরকা কতই না উত্তম সালন।” এরপর থেকে জাবের (রা.) সিরকা পছন্দ করতে লাগলেন,  (মুসলিম হাদিস  ২০৫১)। 

এছাড়াও বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে, রাসুল (সা.) মরুভূমির এক প্রকার পাখির মাংস, মাশরুম, বার্লি, গাজর, ডুমুর, আঙুর, ভিনেগার, ডালিম ইত্যাদি খেতে পছন্দ করতেন।

রাসুলুল্লাহ সাঃ কেমন জীবনযাপন করতেন?

নবী-রাসুলরা হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর। তাঁদের দেখে এবং তাঁদের দেখানো পথেই প্রতিটি মানুষকে চলতে হয়। তাই আল্লাহ তাআলা তাদেরকে উত্তম চরিত্রের অধিকারী হিসাবে প্রেরণ করেছেন। আমাদের রাসুল (সা.) ও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সূরা আল-আহজাব, আয়াত: ২১) একারণে রাসুল (সা.) সহজ সরল, সাদাসিধে জীবনযাপনের মাধ্যমে  গড়ে গেছেন এক কীর্তিমান জীবন। আমরা খুব অল্প পরিসরে তাঁর সাধারণ জীবনযাপন জানার চেষ্টা করব।

সাধারণ বসবাসের ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ (সা.) খুবই সাদামাটা থাকা পছন্দ করতেন। সাধারণতঃ তার ঘরগুলো হতো এক কামরার এবং তার সামনে থাকতো ছোট উঠান। সেই ছোট কামরার মাঝখানে থাকতো একটা রশি। সেই রশির উপর কাপড় ঝুলিয়ে দিয়ে তিনি (সা.) আলাদা করে এক পাশে তাঁর সাক্ষাৎ প্রার্থীদের সাথে কথাবার্তা বলতেন। তিনি চৌকি বা খাট বা এই জাতীয় কিছু ব্যবহার করতেন না। বরং, মাটির উপরই বিছানা পেতে শুতেই পছন্দ করতেন।

এমনকি তাঁর বিছানাপত্রও ছিল অত্যন্ত  অনাড়ম্বর। যা ছিলো চামড়া কিংবা উটের পশম দিয়ে তৈরী একটি কাপড়। মা আয়েশা সিদ্দিকার বর্ণনা মতে, তাঁদের বিছানা এতোটাই ছোট ছিলো যে, রাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) সালাত আদায় করলে তাঁকে একপাশে জড়ো হয়ে থাকতে হতো,  সহিহ বুখারি। 

খাবারদাবারের ব্যাপারেও রাসুলুল্লাহ (সা.) এর বিশেষ কোনো চাহিদা ছিলো না। খাবারের লবণ কম বেশী কিংবা স্বাদের তারতম্যের ব্যাপারেও তাঁর কোনো আপত্তি থাকতো না, সহিহ বুখারি। 

রাসুল (সা.) তাঁর ব্যক্তি জীবনে দরিদ্র অসহায় মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা করতেন।

সমাজে যে যতটুকু সম্মানের অধিকারী, তাকে সেভাবেই মূল্যায়ন করতেন। শত্রু বন্ধু যে কারোর সাথেই নম্রতাসুলভ আচরণ প্রদর্শন করতেন। এবং তাঁর সাহাবীদেরও উপদেশ দিতেন, যেত তারা তাদের আচার-ব্যবহারে অযথা রাগ ও ক্রোধ থেকে সর্বদা বিরত থাকে। তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি নম্র-বিনয়ী হয়, আল্লাহ তাকে উচ্চতর আসনে আসীন করেন। আর যে ব্যক্তি অহংকারী হয়, আল্লাহ তাকে অপদস্থ করেন”, মিশকাত। 

তাই তিনি প্রতিনিয়ত মানুষের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতেন ও সদালাপ করতেন। তাঁর মিষ্টি মধুর কথায় সবাই অভিভূত হতো। তিনি সবসময়ই চাইতেন সবাই যেন খেয়েপড়ে ভালোভাবে বেঁচে থাকে। তাই তিনি বলেছেন, ইসলামে সবচেয়ে ভালো কাজ হচ্ছে, ক্ষুধার্তকে খাওয়ানো আর পরিচিত অপরিচিত  সবাইকেই সালাম দেওয়া, বুখারি ও মুসলিম। 

রাসুল (সা.) কখনোই কাউকে কঠোর ভাষায় কিছু বলতেন না। তাঁর মধ্যে কখনোই প্রতিশোধপ্রবণতা ছিলো না। খারাপের প্রতিবাদ তিনি কখনোই খারাপ দিয়ে নয় বরং উত্তম ও ভালো ব্যবহার দিয়ে দিতেন। তাইতো তিনি বলেছেন, “উত্তম ব্যবহারও সদকা। “

তিনি নিজের প্রয়োজনে কখনোই কারোর উপর নির্ভরশীল হতেন না। রাসুল (সা.) নিজেই নিজের জুতা, কাপড় ইত্যাদি সেলাই করতেন। প্রয়োজনে দুধও দোহন করতেন। ঘরের কাজে সবাইকে সাহায্য সহযোগিতা করতেন। নিজের হাতে রুটি তৈরি করে পরিবার-পরিজনকে নিয়ে খেতেন। নিজেই বাজার থেকে বাজার সদাই করে নিয়ে আসতেন। পরিবারের যে কেউ কোনো কাজের সহায়তা চাইলে তিনি কখনোই না করতেন না।

রাসুলের পারিবারিক কার্যকলাপ  সম্পর্কে মা আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, “রাসুলুল্লাহ (সা.) বাড়িতে থাকলে পরিবারের কল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত থাকতেন। যখন সালাতের সময় হতো তখন তিনি সালাত আদায়ের জন্য উঠে যেতেন।”

রাসুলুল্লাহ (সা.) এর দীর্ঘদিনের খাদেম আনাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ছিলেন পরিবারের প্রতি বেশী স্নেহপ্রবণ। তিনি তাঁর সময়কে তিন ভাগে ভাগ করে, এক ভাগ ইবাদত বন্দেগি, এক ভাগ পরিবারকে আরেক ভাগ নিঃস্ব-দুস্থজনদের জনসেবায় ব্যয় করতেন। 

রাসুল (সা.) তাঁর সৎ স্বভাব, সৌজন্যবোধ, সময়নিষ্ঠা, সত্যনিষ্ঠা, বিনয়, নম্রতার ও পারিবারিক সুশৃঙ্খলাতা দ্বারা যে শিক্ষা দিয়ে গেছেন। তা যদি প্রতিটি মুসলমান তাদের জীবনে প্রতিফলিত করতে পারে, তাহলে তারা ইহকাল ও পরকালের সমূহ কল্যাণ লাভ করতে পারবে। তাই আসুন আমরা বিশ্বনবির আদর্শ অনুসরণ করে জীবন পরিচালনা করি এবং আল্লাহর রহমতের আশা রাখি। নিশ্চয়ই তিনি আমাদের জীবনকে কল্যাণে ভরিয়ে দিবেন ইনশাআল্লাহ।

 

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী

পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম 

আপনি আরো যা পড়তে পারেন

 


Screenshot 3
বিজ্ঞাপনঃ বই কিনুন, বই পড়ুন

3

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী

Author: সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী জন্ম চট্টগ্রামে। জীবিকার প্রয়োজনে একসময় প্রবাসী ছিলেন। প্রবাসের সেই কঠিন সময়ে লেখেলেখির হাতেখড়ি। গল্প, কবিতা, সাহিত্যের পাশাপাশি প্রবাসী বাংলা পত্রিকায়ও নিয়মিত কলাম লিখেছেন। প্রবাসের সেই চাকচিক্যের মায়া ত্যাগ করে মানুষের ভালোবাসার টানে দেশে এখন স্থায়ী বসবাস। বর্তমানে বেসরকারি চাকুরিজীবী। তাঁর ভালোলাগে বই পড়তে এবং পরিবারকে সময় দিতে।

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

কবিতা আল কোরআনের প্রতীক আফছানা খানম অথৈ

আল কোরআনের প্রতীক আফছানা খানম অথৈ মা আমেনার গর্ভেতে জন্ম নিলো এক মহামানবের, নাম হলো তার মুহাম্মদ রাসুল আসলো ভবের

ফোরাত নদীতে স্বর্নের পাহাড় আফছানা খানম অথৈ

ফোরাত নদীতে স্বর্নের পাহাড় আফছানা খানম অথৈ ইমাম মাহাদী (আ:) আগমনের পূর্বে ফোরাত নদীর তীরে স্বর্নের পাহাড় ভেসে উঠা কেয়ামতের

কবিতা দাজ্জাল আফছানা খানম অথৈ

দাজ্জাল আফছানা খানম অথৈ কেয়ামতের পূর্বে দাজ্জাল আসবে নিজেকে খোদা বলে দাবি করবে, কাফের মুনাফিক যাবে তার দলে ঈমানদার মুমিন

গল্প হযরত মুহাম্মদ (সা:) জীবনের গল্প আফছানা খানম অথৈ

জন্ম:হযরত মুহাম্মদ (সা:) বর্তমান সৌদি আরবে অবস্থিত মক্কা নগরীর কুরাইশ গোত্রে বনি হাশিম বংশে ৫৭০ খৃষ্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন।তার পিতার

4 Replies to “হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর সংক্ষিপ্ত জীবনী”

Leave a Reply