কথায় আছে, ‘জন্মিলে মরিতে হয়’। কিন্তু এ মৃত্যুই চূড়ান্ত নয়। মৃত্যুর পর আরো একটি অনন্ত জীবন আছে। সমস্ত প্রাণীজগৎ আবারো আল্লাহর সামনে উত্থিত হবে। সেটাই একজন মানুষের চূড়ান্ত ও আসল জীবন। অতএব বলা যায়- পুনরুত্থান হচ্ছে মৃত্যুর পর পুণরায় উত্থিত হওয়া বা জীবিত হওয়া।
ইসলাম ধর্মমতে পুনরুত্থান
ইসলাম ধর্মমতে পুনরুত্থান হলো কিয়ামতোত্তোর বিচার দিবসে সকল জীবজগৎ পুনরায় জীবিত হয়ে আল্লাহ তা’আলার সামনে দন্ডায়মান হওয়া। এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে অসংখ্য আয়াত বর্ণিত হয়েছে। যেমন-
اللهُ يَبْدَأُ الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيْدُهُ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُوْنَ
অনুবাদ: আল্লাহ প্রথমবার সৃষ্টি করেন, অতঃপর তিনি পুণরায় সৃষ্টি করবেন। এরপর তোমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে। [সূরাহ আর-রূম: ১১]
অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ আরো বলেন,
وَلَهُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ كُلٌّ لَّهُ قَانِتُوْنَ- وَهُوَ الَّذِيْ يَبْدَأُ الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيْدُهُ وَهُوَ أَهْوَنُ عَلَيْهِ وَلَهُ الْمَثَلُ الْأَعْلَى فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ-
অনুবাদ: নভোমণ্ডলে ও ভূমণ্ডলে যা কিছু আছে, সব তাঁরই। সবাই তাঁর আজ্ঞাবহ। তিনিই প্রথমবার সৃষ্টিকে অস্তিত্বে আনয়ন করেন, অতঃপর পুণর্বার তিনি সৃষ্টি করবেন। এটা তাঁর জন্য সহজ। আকাশ ও পৃথিবীতে সর্বোচ্চ মর্যাদা তাঁরই এবং তিনিই পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’ [সূরাহ আর-রূম: ২৬-২৭)।
একই বিষয়ে তিনি অন্যত্র বলেন-
مَا خَلْقُكُمْ وَلاَ بَعْثُكُمْ إِلاَّ كَنَفْسٍ وَّاحِدَةٍ إِنَّ اللهَ سَمِيْعٌ بَصِيْرٌ
অনুবাদ: তোমাদের সৃষ্টি ও পুনরুত্থান, একটি মাত্র প্রাণীর সৃষ্টি ও পুনরুত্থানের সমান বৈ নয়। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু শোনেন, সবকিছু দেখেন। সূরাহ আল-লুক্বমান: ২৮]
তিনি মানুষকে আবারো স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন
إِلَيْهِ مَرْجِعُكُمْ جَمِيْعًا وَعْدَ اللهِ حَقًّا إِنَّهُ يَبْدَأُ الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيْدُهُ لِيَجْزِيَ الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ بِالْقِسْطِ وَالَّذِيْنَ كَفَرُوْا لَهُمْ شَرَابٌ مِّنْ حَمِيْمٍ وَّعَذَابٌ أَلِيْمٌ بِمَا كَانُوْا يَكْفُرُوْنَ-
অনুবাদ: তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে তোমাদের সবাইকে, আল্লাহর ওয়াদা সত্য, তিনিই সৃষ্টি করেন প্রথমবার, আবার পুনর্বার তৈরী করবেন, তাদেরকে বদলা দেয়ার জন্য, যারা ঈমান এনেছে এবং নেক কাজ করেছে ইনসাফের সাথে। আর যারা কাফের হয়েছে, তাদের পান করতে হবে ফুটন্ত পানি এবং ভোগ করতে হবে যন্ত্রণাদায়ক আযাব, এজন্য যে তারা কুফরী করতো। [সূরাহ: ইউনুস: ৪]
পুনরুত্থান সম্পর্কে আরো এসেছে-
أَوَلَمْ يَرَوْا كَيْفَ يُبْدِئُ اللهُ الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيْدُهُ إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللهِ يَسِيْرٌ- قُلْ سِيْرُوْا فِي الْأَرْضِ فَانْظُرُوْا كَيْفَ بَدَأَ الْخَلْقَ ثُمَّ اللهُ يُنْشِئُ النَّشْأَةَ الْآخِرَةَ إِنَّ اللهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ-
অনুবাদ: তারা কি দেখে না যে, আল্লাহ কিভাবে সৃষ্টিকর্ম শুরু করেন, অতঃপর তাকে পুনরায় সৃষ্টি করবেন? এটাতো আল্লাহর জন্য সহজ। বলুন, তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং দেখো, কীভাবে তিনি সৃষ্টিকর্ম শুরু করেছেন। অতঃপর আল্লাহ পুনর্বার সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু করতে সক্ষম। [সূরাহ খল-আনকাবূত: ১৯-২০]
অন্যত্র এসেছে-
يَوْمَ يَبْعَثُهُمُ اللهُ جَمِيْعاً فَيُنَبِّئُهُمْ بِمَا عَمِلُوْا أَحْصَاهُ اللهُ وَنَسُوْهُ وَاللهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيْدٌ-
অনুবাদ: সেদিন স্মরণীয়, যেদিন আল্লাহ তাদের সকলকে পুনরুত্থিত করবেন, অতঃপর তাদেরকে জানিয়ে দিবেন যা তারা করতো। আল্লাহ তার হিসাব রেখেছেন, আর তারা তা ভুলে গেছে। আল্লাহর সামনে উপস্থিত আছে সব বস্ত্তই। [সূরাহ আল-মুজাদালাহ: ৬]
অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন+
هُوَ الَّذِيْ جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ ذَلُوْلاً فَامْشُوْا فِيْ مَنَاكِبِهَا وَكُلُوْا مِنْ رِّزْقِهِ وَإِلَيْهِ النُّشُوْرُ-
অনুবাদ: তিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে সুগম করেছেন, অতএব তোমরা তার কাঁধে বিচরণ করো এবং তাঁর দেয়া রিযিক আহার করো। আর তাঁর কাছেই (তোমাদের) পুনরুজ্জীবন। [সূরাহ আল-মুলক: ১৫]
পুনরুত্থান অস্বীকারকারীদের প্রতি আল্লাহর চ্যালেঞ্জ
পুনরুত্থান অস্বীকারকারী কাফেরদের প্রতি মহান আল্লাহ চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেন-
زَعَمَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا أَن لَّنْ يُّبْعَثُوْا قُلْ بَلَى وَرَبِّيْ لَتُبْعَثُنَّ ثُمَّ لَتُنَبَّؤُنَّ بِمَا عَمِلْتُمْ وَذَلِكَ عَلَى اللهِ يَسِيْرٌ
অনুবাদ: কাফেররা দাবী করে যে, তারা কখনও পুনরুত্থিত হবে না। বলুন, অবশ্যই হবে, আমার পালনকর্তার কসম, তোমরা নিশ্চয়ই পুনরুত্থিত হবে। অতঃপর তোমাদেরকে অবহিত করা হবে যা তোমরা করতে। এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ। [সূরাহ আত-তাগাবুন: ৭]
তাদের ভ্রান্ত ধারণা সম্পর্কে অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন-
قَالُوْا أَئِذَا كُنَّا عِظَامًا وَّرُفَاتًا أَإِنَّا لَمَبْعُوْثُوْنَ خَلْقًا جَدِيْدًا- قُل كُوْنُوْا حِجَارَةً أَوْ حَدِيْداً- أَوْ خَلْقاً مِّمَّا يَكْبُرُ فِيْ صُدُوْرِكُمْ فَسَيَقُوْلُوْنَ مَنْ يُّعِيْدُنَا قُلِ الَّذِيْ فَطَرَكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ فَسَيُنْغِضُوْنَ إِلَيْكَ رُؤُوْسَهُمْ وَيَقُوْلُوْنَ مَتَى هُوَ قُلْ عَسَى أَنْ يَّكُوْنَ قَرِيْباً- يَوْمَ يَدْعُوْكُمْ فَتَسْتَجِيْبُوْنَ بِحَمْدِهِ وَتَظُنُّوْنَ إِنْ لَّبِثْتُمْ إِلاَّ قَلِيْلاً-
অনুবাদ: তারা বলে, যখন আমরা অস্থিতে পরিণত ও চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবো, তখনও কি নতুন করে সৃজিত হয়ে উত্থিত হবো? বলুন, তোমরা পাথর হয়ে যাও কিংবা লোহা। অথবা এমন কোন বস্ত্ত, যা তোমাদের ধারণায় খুবই কঠিন, তথাপি তারা বলবে, আমাদেরকে পুনর্বার কে সৃষ্টি করবে? বলুন, যিনি তোমাদেরকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তারা আপনার সামনে মাথা নাড়বে এবং বলবে, এটা কবে হবে? বলুন, হবে সম্ভবতঃ শ্রীঘ্রই। সেদিন তিনি তোমাদেরকে আহবান করবেন। অতঃপর তোমরা তাঁর প্রশংসা করতে করতে চলে আসবে এবং তোমরা অনুধাবন করবে যে, সামান্য সময়ই (পৃথিবীতে) অবস্থান করেছিলে। [সূরাহ বানী ইসরাঈল: ৪৯-৫২]
তাদের কঠোর শপথ উড়িয়ে মহান রাব্বুল আলামীন বলেন-
وَأَقْسَمُوْا بِاللهِ جَهْدَ أَيْمَانِهِمْ لاَ يَبْعَثُ اللهُ مَنْ يَّمُوْتُ بَلَى وَعْداً عَلَيْهِ حَقًّا وَلـكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لاَ يَعْلَمُوْنَ- لِيُبَيِّنَ لَهُمُ الَّذِيْ يَخْتَلِفُوْنَ فِيْهِ وَلِيَعْلَمَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا أَنَّهُمْ كَانُوْا كَاذِبِيْنَ-
অনুবাদ: তারা আল্লাহর নামে কঠোর শপথ করে যে, যার মৃত্যু হয় আল্লাহ তাকে পুনরুজ্জীবিত করবেন না। অবশ্যই এর পাকাপোক্ত ওয়াদা হয়ে গেছে, কিন্তু অধিকাংশ লোক জানে না। তিনি পুনরুজ্জীবিত করবেনই, যাতে যে বিষয়ে তাদের মধ্যে মতানৈক্য ছিলো তা প্রকাশ করা যায় এবং যাতে কাফেররা জেনে নেয় যে, তারা মিথ্যাবাদী ছিলো। [সূরাহ আন-নাহল: ৩৮-৩৯]
পুনর্জন্ম বলতে কী বুঝায়?
পুনরুত্থান ও পুনর্জন্মের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। পুনরুত্থান হচ্ছে যা আমরা ওপরে বর্ণনা করেছি। অর্থাৎ কিয়ামতের পর জীবিত হয়ে আল্লাহর সামনে পুনর্বার দণ্ডায়মান হওয়া। আর পুনর্জন হচ্ছে হিন্দু বা অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসমতে মৃত্যুর পর পৃথিবীতে দ্বিতীয় জন্ম লাভ করা। তারা বিশ্বাস করে কেউ যদি প্রথম জন্মে ভালো কাজ করে সে দ্বিতীয় জন্মে শান্তিতে কাটায়। আর কেউ প্রথম জন্মে পাপ কাজ করলে পরের জন্মে পশুপাখি হয়ে জীবন লাভ করে বা কষ্টের জীবন যাপন করে। অর্থাৎ একটি মানুষ পৃথিবীতে একাধিকবার আসাকেই পুনর্জন্ম বলে।
যীশুর পুনরুত্থান বা ঈসা আ. এর পুনরাগমন
কিয়ামতের পূর্বে ঈসা আলাইহিস সালাম এর পুনরাগমন হবে। অর্থাৎ তিনি কেয়ামতের পূর্বে পৃথিবীতে আবার আগমন করবেন। ইসলাম ধর্মে কেবল তাঁর ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম। তিনি ছাড়া আর কারো পুনরাগমন হবে না। যেহেতু মহান আল্লাহ তা’আলা তাঁকে পৃথিবী থেকে জীবিতই আকাশে উঠিয়ে নিয়েছেন, তাই তাঁকে আবারো পৃথিবীতে পাঠানো হবে পথভ্রষ্ট মানুষদেরকে পথ দেখানোর জন্য।
পরকাল সম্পর্কে কুরআন কী বলে?
এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে অসংখ্য আয়াত রয়েছে, তা আমরা ‘পরকাল’ শীর্ষক প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এখানে প্রাসঙ্গিকতা রক্ষায় সংক্ষেপে কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করছি।
وَمَا هَٰذِهِ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا لَهْوٌ وَلَعِبٌ ۚ وَإِنَّ الدَّارَ الْآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ ۚ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ
অনুবাদ: এই পার্থিব জীবন ক্রীড়া-কৌতুক বৈ তো কিছুই নয়। পরকালের গৃহই প্রকৃত জীবন; যদি তারা জানত। [সূরাহ আল-আনকাবুত: ৬৪]
সূরা আল-আনআমে তিনি আরো বলেন-
وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا لَعِبٌ وَلَهْوٌ ۖ وَلَلدَّارُ الْآخِرَةُ خَيْرٌ لِلَّذِينَ يَتَّقُونَ ۗ أَفَلَا تَعْقِلُونَ
অনুবাদ: পার্থিব জীবন খেল-তামাশা ব্যতীত কিছুই নয়। পরকালের আবাস পরহেযগারদের জন্যে শ্রেষ্টতর। তোমরা কি বুঝো না ? [সূরাহ আল আনআম: ৩২]
সূরা বাকারায় এসেছে-
أُولَٰئِكَ الَّذِينَ اشْتَرَوُا الْحَيَاةَ الدُّنْيَا بِالْآخِرَةِ ۖ فَلَا يُخَفَّفُ عَنْهُمُ الْعَذَابُ وَلَا هُمْ يُنْصَرُونَ
অনুবাদ: এরাই পরকালের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবন ক্রয় করেছে। অতএব এদের শাস্তি লঘু হবে না এবং এরা সাহায্যও পাবে না। (সূরাঃ আল বাকারা, আয়াতঃ ৮৬)
লিখনে: লুবাব হাসান সাফওয়ান
