ভিটামিনকে বাংলায় বলা হয় খাদ্যপ্রাণ। খাদ্যের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ভিটামিনকেই বিবেচনায় আনা হয়। ভিটামিন আবার ছয় প্রকার, যার মধ্যে ভিটামিন ডি একটি। ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার কেন খাবেন? চলুন প্রশ্নটির উত্তর জেনে আসা যাক!
ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার বিষয়ক আজকের আর্টিকেলে আমরা যে সকল বিষয়ে আলোকপাত করতে চলেছি–
আমরা বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য গ্রহণ করি। এই খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে আমাদের দেহের জন্য যে অত্যাবশকীয় খাদ্য উপাদানের চাহিদা থাকে তা পূরণ হয়। খাদ্য বলতে আমরা বুঝি, যা দেহের প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করতে পারে এবং দেহ গঠনে প্রয়োজনীয় জৈবিক উপাদানের যোগান দিয়ে সহায়তা করে।
মানুষকে সুস্থ থাকার জন্য পুষ্টিগুণ যুক্ত খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। খাদ্যের মোট ছয়টি পুষ্টি উপাদান রয়েছে। সেগুলো হলো- ভিটামিন, খনিজ লবণ, শর্করা, আমিষ, চর্বি ও পানি। আজ আমরা অন্যতম একটি খাদ্য উপাদান ভিটামিন সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব।
ভিটামিন কী?
ভিটামিন আমাদের জৈবিক চাহিদা পূরণের জন্য অন্যতম একটি খাদ্য উপাদানের মধ্যে একটি। এটি এমন একটি খাদ্য উপাদান, যা আমাদের দেহে একেবারে বেশি পরিমানে প্রয়োজন হয় না, আবার প্রয়োজনের চেয়ে কম গ্রহণ করলে শরীরে নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়।
ভিটামিন খুব অল্প পরিমাণে প্রয়োজন হলেও এর গুরুত্ব আমাদের জীবনে অনস্বীকার্য। ভিটামিন দেহের কোষের অস্বাভাবিকতা দূর করে। এটি রক্তের বিভিন্ন কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণ করে থাকে সেই সাথে স্নায়ুর বিভিন্ন কাজেও সহায়তা করে।
ভিটামিন অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে, যা ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা রাখে। ভিটামিন অনেক ধরনের হয়ে থাকে। যেমন: ভিটামিন এ, ভিটামিন বি, ভিটামিন ডি ইত্যাদি। এই সকল ভিটামিন ঘাটতি দেখা দিলে শরীরে নানা ধরনের উপসর্গ সহ বিভিন্ন রকমের জটিলতা দেখা দেয়।
ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার কেন খাবেন?
আজকের আলোচনার শুরুতে ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার ও এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করা যাক! ভিটামিনের প্রকারভেদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধরণ হলো ভিটামিন ডি। ভিটামিন ডি একটি ফ্যাটে দ্রবণীয় ভিটামিন। সাধারণত মানব দেহের অন্ত্রে ক্যালসিয়ামের শোষণ নিয়ন্ত্রণ কাজে ও ক্যালসিয়াম হোমিওস্টাসিস নিয়ন্ত্রণে ভিটামিন ডি কাজ করে থাকে।
হাড় গঠন ও হাড় মজবুতের জন্য ভিটামিন ডি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার, অস্টিওপোরোসিস, সিলিয়াক রোগ, কিডনির রোগ, হৃদরোগের মতো বিভিন্ন জটিল রোগের বিরুদ্ধে কাজ করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। রোগ প্রতিরোধ বৃদ্ধির জন্য কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ এড়াতেও ভিটামিন ডি কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছে।
ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার
ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হলে প্রথমেই আমাদের জানতে হবে কোন কোন খাবারে ভিটামিন ডি পাওয়া যায়। সাধারণত চর্বিযুক্ত মাছ, ডিম, যকৃত ইত্যাদি খাবার থেকে ভিটামিন ডি পাওয়া যায়। তাছাড়া ভিটামিন ডি এর আরেকটি অন্যতম উৎস হলো সূর্যের আলো। অনেকেই সকাল বেলায় ভিটামিন ডি এর গুণাগুণ গ্রহণের জন্য সূর্যের আলো ও উত্তাপ গ্রহণ করে থাকে।
ভিটামিন ডি যুক্ত শাকসবজি
কিছু কিছু শস্যজাতীয় খাবার থেকেও ভিটামিন ডি পাওয়া যায়। যেমন গম, বার্লে, ওটস ইত্যাদি ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার। শুষ্ক ফল এর মধ্যে রয়েছে বাদাম ও আখরোট। সবজির মধ্যে রয়েছে শাক জাতীয় খাবার যা থেকে ভিটামিন পাওয়া যায়। শাকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো পালং শাক।
আমরা জানি, সামুদ্রিক মাছ ভিটামিন ডি এর জন্য একটি অন্যতম প্রধান উৎস। সামুদ্রিক মাছ বা মাছের তৈলে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন ডি থাকে। যেমন- স্যামন, টুনা, হ্যারিং এই সকল মাছের মধ্যে ভিটামিন ডি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়।
এমনকি বাংলাদেশের জাতীয় মাছ হচ্ছে ইলিশ; এই ইলিশ মাছের ডিমের মধ্যেও রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমানের ভিটামিন ডি। বাঙ্গালীদের অতি জনপ্রিয় চিংড়ি থেকেও ভিটামিন ডি পাওয়া যায়। সবচেয়ে বেশি পরিমাণ ভিটামিন ডি পাওয়া যায় সামুদ্রিক মাছ স্যামন থেকে। দৈনিক চাহিদার প্রায় ৮৪ শতাংশ ভিটামিন ডি এর চাহিদা পূরণ করা যায় এই সকল সামুদ্রিক মাছের থেকে।
ডিম পুষ্টিকর খাবারগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। ডিমও একটি ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার বলে বিবেচ্য। তবে ডিমের হলুদ কুসুমের মধ্যে ভিটামিন ডি এর পরিমাণ তুলনামূলক ভাবে বেশি রয়েছে। ডিমের কুসুমের মধ্যে প্রায় ৪০ আইইউ পরিমাণ ভিটামিন ডি উপস্থিত থাকে এবং সমগ্র ডিমে আনুমানিক ০.৯ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন ডি থাকে। কিন্তু অতিরিক্ত কোলেস্টেরলে যাদের সমস্যা রয়েছে তাদের ডিম খাওয়ার মাত্রা সীমিত পরিসরে রাখাই ভালো।
মাশরুমে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ডি। মাশরুমের আরও একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটি দীর্ঘ সময় সূর্যের আলোর সংস্পর্শ পেয়ে থাকে। এর ফলে প্রায় ৪৬ হাজার আইইউ পরিমাণ ভিটামিন উৎপন্ন হয়। সাধারণত একদিনে ১০০ গ্রাম মাশরুম থেকে দেহে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ডি এর চাহিদা পূরণ হতে পারে।
দুধকে ভিটামিন ডি এর জন্য সর্বোৎকৃষ্ট উৎস হিসেবে বলা না গেলেও দুধ থেকে কিছু পরিমাণ ভিটামিন ডি পাওয়া যায়। কিছু কিছু দেশে আবার গরুর দুধকে ফরটিফায়েড এর সাহায্যে ভিটামিন ডি এর গুনাগুন যুক্ত করা হয়।
সাধারণত কোনো ব্যক্তি এক ক্লাস দুধ পান করলে তার ১৫ থেকে ২২ শতাংশের মত ভিটামিন এর চাহিদা পূরণ হয়। দুধের অধিক পরিমাণের ভিটামিন ডি না থাকলেও বিভিন্ন দুগ্ধজাত অন্যান্য খাবার থেকে এই উপাদান গ্রহণ করা যায়।
যেমন: পনির, মাখন, ছানা, দই এই ধরনের খাবার থেকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন পাওয়া যায়। মাত্র এক কাপ দই থেকে আমরা যে পরিমাণ ভিটামিন পাই তা দেহের প্রায় ১৬ শতাংশ ভিটামিন ডি এর চাহিদা পূরণ করতে সহায়তা করে।
যারা সাধারণত দুধ, ডিম জাতীয় খাবার খেতে পারেন না তাদের জন্য কমলা জুস ভিটামিনের ডি যোগানের কার্যকরী উৎস হিসেবে দারুণ সাহায্য করে।
এছাড়া গরুর কলিজা থেকেও ভিটামিন ডি পাওয়া যায়। গরুর কলিজা অনেকেরই প্রিয় খাদ্য। কিন্তু তাই বলে এটি বেশি পরিমাণে খাওয়া উচিত নয়। অতিরিক্ত পরিমাণ গরুর কলিজা গ্রহণ করলে স্বাস্থ্যহীনতা ঘটার সম্ভাবনা থাকে।
ভিটামিন ডি যুক্ত ফল
ফলের মধ্যে কমলা জুস থেকে ভিটামিন ডি পাওয়া যায়। এক গ্লাস সমপরিমাণ কমলার জুস পান করলে প্রায় ১০০ আইইউ ভিটামিন ডি পাওয়া যায়, যা আমাদের দেহের ১২ শতাংশ ভিটামিন ডি অভাব পূরণ করতে পারে।
ভিটামিন ডি 3 যুক্ত খাবার
ভিটামিন ডি এর মধ্যে একটি বিশেষ ধরণ হচ্ছে ভিটামিন ডি 3। এটি কোলেস্টেরল থেকে সংশ্লেষিত একটি ফ্যাট দ্রবণীয় দ্রবণ, যা রক্তের মধ্যে ক্যালসিয়াম ও ফসফেটের বিপাকের জন্য অত্যন্ত কার্যকর।
যদি দেহে ভিটামিন ডি 3 এর পরিমাণ কম হয় অথবা ঘাটতি দেখা যায় তাহলে শারীরিক দুর্বলতা বৃদ্ধি পায়। সেই সাথে হাড়ের ক্যান্সার, হাড় ভঙ্গুর, হাড়ের ফাটলের মত মারাত্মক সমস্যার ঝুঁকি থাকে। ভিটামিন ডি 3 এর মাত্রা অতি নিম্ন হয়ে গেলে মানুষ স্বাভাবিক চিন্তাধারা করতে ব্যাহত হয়।
ভিটামিন ডি 3 সমৃদ্ধ বিভিন্ন খাবার, যেমন: মাশরুম, মাছ, সালমন থেকে পাওয়া যায়, তেমনি ভিটামিন ডি 3 সমৃদ্ধ ট্যাবলেটও তৈরি করা হয়েছে। কোনো রোগীর যদি ভিটামিন ডি 3 গ্রহণের প্রয়োজন হয় তাহলে চিকিৎসক রোগীর বয়স, উচ্চতা, ওজন ইত্যাদি আনুষঙ্গিক বিষয়ের উপর নির্ভর করে সঠিক ওষুধ প্রদান করবেন এবং প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দিবেন।
কেননা ভিটামিন ডি 3 এর কার্যকরী উপকারিতা যেমন রয়েছে সেই সাথে এর কিছু পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াও রয়েছে। যদি সঠিক রোগীকে সঠিক পরিমাণে ভিটামিন ডি 3 প্রদান করা না হয়, তাহলে বিভিন্ন রকমের শারীরিক জটিলতা যেমন: বমি ভাব বা বমি, ডায়রিয়া, ক্ষুধামন্দা, মাথাব্যথা, বুকে ব্যথার মত সমস্যা হতে পারে।
ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার
ভিটামিন ডি এর সাথে ক্যালসিয়ামের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। আমাদের দেহ ক্যালসিয়াম কখনোই গ্রহণ করতে পারবে না, যদি কিনা ভিটামিন ডি না গ্রহণ করে থাকি। ক্যালসিয়াম শোষণ করতে হলে ভিটামিন ডি এর প্রয়োজন।
তবে মজার ব্যাপার হলো, যে সকল খাদ্যে ক্যালসিয়াম আছে, সেগুলো খাদ্যে অন্য পরিমাণে ভিটামিন ডি রয়েছে। ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার তালিকা নিচে দেখে নিন–
হাড়ের গঠন ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চয়তায় ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার গ্রহণের কোনো বিকল্প পথ নেই। বিশেষ করে বয়স বেড়ে গেলে ভিটামিন ডি এর অভাবের লক্ষণ প্রকাশ পায়, যা কিনা শেষ বয়সে পীড়াদায়ক হওয়ার মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে সময় থাকতে ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার খেলে যাবতীয় হাড় জনিত সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব।
খাদ্যাভ্যাস ও সুস্থ জীবনযাপন নিয়ে আমাদের প্রকাশিত ফিচার লেখাগুলো পড়ুন:
