হযরত আবু বকর (রা.) সিদ্দিক, যার সম্পর্কে বলা হয়, “বাদল আম্বিয়া, আশরাফুল নাস”- অর্থাৎ নবি-রাসুলের পরে, মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছেন এই হযরত আবু বকর (রা.) সিদ্দিক। যার পরিচয়ের সাথে আরও অসংখ্য মহান এবং মহৎ ব্যক্তির নাম জড়িত এবং ইসলামে যার অবস্থান রাসুল (সা.) এর পরেই। ইসলাম প্রতিষ্ঠায় যার অবদানের কথা আজও অবিস্মরণীয়। আজ আমরা সেই মহৎ ব্যক্তি হযরত আবু বকর (রা.) এর সম্পূর্ণ জীবনী জানার চেষ্টা করব।
হযরত আবু বকর (রা.) এর জন্ম
মহান এই ব্যক্তি জাহেলি যুগে আনুমানিক ৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ২৭ অক্টোবর আরবে জন্মগ্রহণ করেন। জন্ম থেকেই তিনি ছিলেন নিষ্পাপ একজন মানুষ। জাহেলি যুগের হাজার পাপের মাঝেও তিনি তার চরিত্রকে নিষ্কলুষ রেখেছিলেন। যার পিতা ছিলেন কুহাফা ইবন আমির এবং মাতা ছিলেন সালমা বিনতে সাখর। হযরত আবু বকর (রা.) ছিলেন প্রথম দিকের মুসলমান। তাঁর সাথে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিলো। এবং তিনি সেই বন্ধুত্বকে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন।
ইসলাম পূর্ববর্তী জীবন
ইতিহাস থেকে হযরত আবু বকর (রা.) এর শৈশব কৈশোর সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। তিনি আরবের অন্যান্য শিশুদের মতোই বড় হয়ে উঠেছিলেন। তার দশ বছর বয়স থেকেই তিনি তার বাবার সাথে বিভিন্ন বাণিজ্য কাফেলায় করে নানান জায়গায় ভ্রমণ করতেন। যেকারণে পরবর্তীতে তিনি নিজেকে একজন ব্যবসায়ী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
আর তাই তিনি ব্যবসা করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। ব্যবসার কারণে তিনি প্রতিবেশী সিরিয়া, ইয়েমেন ও অন্যান্য বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করেছেন। আর এই ব্যবসা করেই তিনি যথেষ্ট সম্পদশালী এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। যেকারণে তিনি তার গোত্রের একজন নেতৃত্বস্থানীয় পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন।
ইসলাম গ্রহণ
হযরত আবু বকর (রা.) একজন ব্যবসায়ী ছাড়াও, তিনি ছিলেন তৎকালীন সময়ের মধ্যে যথেষ্ট শিক্ষিত এবং কাব্যানুরাগী। যারফলে তাঁর স্মৃতিশক্তি খুবই ভালো ছিল। এমনকি আরব গোত্রসমূহের বংশলতিকা নিয়ে তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল। হযরত আবু বকর (রা.) ছিলেন প্রথম মুসলিম হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম। এমনকি প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে তিনি প্রথম ইসলামগ্রহণ করেছিলেন বলে ইতিহাসে জানা যায়।
যখন রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কায় ইসলাম প্রচার শুরু করেন, তখন সেখানে একধরনের হৈ চৈ পড়ে যায়। মক্কার তাঁর আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে প্রভাবশালী ধনী নেতৃবৃন্দসহ সর্বস্তরের মানুষ তাঁর এবং ইসলামের বিরোধিতায় উঠে পড়ে লাগে। এমনকি এতদিন যারা আল আমিন বলে সম্মান এবং মর্যাদা দিতো, তারাও তাঁকে পাগল, মাথা খারাপ, জীনে ধরা রোগী (নাউজুবিল্লাহ) ইত্যাদি বলতে থাকে। শুধু তাইনয়, নেতাদের ইশারা ইংগিতে ও আশকারায় সাধারণ লোকেরাও ইসলাম থেকে দূরে সরে থাকে।
এতোদিনের পরিচিত মক্কাবাসীরা হঠাৎই চোখের পলকে মুহাম্মদের (সা.) বিরোধিতা করলেও, এমন একজনকে তিনি পেয়েছিলেন যিনি নির্দ্বিধায় তাকে মেনে নিয়েছিলেন। তিনি আর কেউ নয়, তিনি ছিলেন হযরত আবু বকর (রা.)। তাঁর সম্পর্কে রাসুল (সা.) জানিয়েছেন যে, “তিনি যাকেই ইসলামের দাওয়াত দিত না কেন, সবার মধ্যেই কিছু না কিছু দ্বিধা দ্বন্দ্বের ভাব ছিল। কিন্তু একমাত্র হযরত আবু বকর (রা.) এর মধ্যে কখনোই কোনো দ্বিধা ছিলো না।”
তার কারণ ছিলো, তিনি যেমন সৎ ছিলেন তেমনি তার চেয়েও বেশী সৎ মানুষ ছিলেন মুহাম্মদ (সা.)। তাই তিনি এই সৎ মানুষের কথাকে বিশ্বাস করেছিলেন। আর এভাবে যখনই তিনি ইসলামের দাওআত পেলেন, তখনই সাথে সাথে তা গ্রহণ করে নিয়েছিলেন।
ইসলাম গ্রহণের পরবর্তী জীবন
হযরত আবু বকর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করলেও তাঁর এক স্ত্রী কুতাইলা বিনতে আবদুল উজ্জা ইসলাম গ্রহণ করেন নি। তাই হযরত আবু বকর (রা.) সেই স্ত্রীকে তালাক দিয়েছিলেন। তার অন্য স্ত্রী উম্ম রুমান যিনি মা আয়েশা (রা.) এর মা তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তার পরিবারে ছেলে আবদুর রহমান ইবনে আবি বকর ছাড়া অন্য সকলেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। যদিও পরবর্তীতে আবদুর রহমান ইবনে আবি বকর মুসলিম হয়েছিলেন।
ইসলামের জন্য উদ্বুদ্ধকরণ
হযরত আবু বকর (রা.) নিজে ইসলাম গ্রহণ করেই থেমে থাকেননি। তিনি যেমন সত্যের সন্ধান পেয়েছেন, সেই সত্যের সন্ধান জনে জনে মানুষকে বুঝিয়েছিলেনও বটে। তাঁর উদ্বুদ্ধকরণের অনুপ্রেরণায় অনেকেই ইসলাম গ্রহণে অনুপ্রাণিত হয়েছে। যার বেশিরভাগই ছিলো তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁর অনুপ্রেরণায় মুসলিম হওয়াদের তালিকা হলো,
- উসমান ইবনে আফফান (রা.) (পরবর্তীতে তৃতীয় খলিফা)
- জুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা.)
- তালহা ইবনে উবাইদিল্লাহ (রা.)
- খালিদ ইবনে সাইদ (রা.)
- আবু হুজাইফা ইবনে আল মুগিরা (রা.)
- আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.), যিনি রাসুল (সা.) পরবর্তী রাশিদুন খিলাফতের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন।
- সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) (যার হাত ধরে মুসলিমরা পারস্য বিজয় করেছিল)
- আবু সালামা আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল আসাদ (রা.)
- আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রা.)
(যিনি সিরিয়ায় রাশিদুন সেনাবাহিনীর প্রধান অধিনায়ক ছিলেন।)
দাস মুক্তিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন
তৎকালীন আরবে দাস প্রথা চালু ছিলো। এই দাসদের উপর তখন থেকেই চলতো বিভিন্ন রকম নির্মম নির্যাতন। ইসলামের প্রথম দিকে স্বাধীন ব্যক্তিরা ইসলাম গ্রহণের পর বিভিন্ন বিরোধিতার সম্মুখীন হলেও তারা তাদের নিজ গোত্রের আত্মীয় স্বজনকে নিরাপত্তা ভোগ করত। কিন্তু বরাবরের মতো দাসদের কোনো নিরাপত্তাই ছিল না। বরং প্রতিয়ত তারা নির্যাতনের সম্মুখীন হত। হযরত আবু বকর (রা.) এই দাসদের প্রতি অসম্ভব সদয় দেখাতেন। আর তাই দাসদের মধ্যে যারাই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতো, তাদেরকে সাধ্যমত তিনি কিনে নিয়ে মুক্ত করে দিতেন। তাঁর মুক্তি দেওয়া অধিকাংশ দাসই ছিলো নারী, বৃদ্ধ বা দুর্বল ব্যক্তি।
ইতিহাস থেকে তার মুক্ত করা দাসদের যে তালিকা পাওয়া যায়,
- বিলাল ইবনে রাবাহ (রা.)
- আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা.)
- উম্মে উবাইস (রা.)
- হযরত আবু বকর (রা.) ফাকিহ
- আন নাহদিয়া (রা.)
- হযরত আবু বকর (রা.) ফুহাইরা
- হারিসা বিনতে আল মুয়াম্মিল (রা.)
- লুবাইনা (রা.)
হযরত আবু বকর (রা.) ইসলামের জন্য কত মেহনত করেছেন তা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। তাই তো রাসুলুল্লাহ (সা.) যখনই তাঁর প্রসঙ্গ উঠতো তখনই তিনি বলতেন,
“তিনি সকল মানুষের ইহসান পরিশোধ করেছেন, কিন্তু হযরত আবু বকর (রা.) এর গুলো নয়। কেননা রাসুল (সা.) তাঁর ইহসানসমূহ পরিশোধ করতে আমি অক্ষম। তাই তার প্রতিদান একমাত্র আল্লাহই দেবেন। এমনকি তিনি এও বলেছেন, হযরত আবু বকর (রা.) এর অর্থ সম্পদ তার যে উপকারে এসেছে, অন্য কারো অর্থ তেমন আসেনি।”
নির্যাতনের স্বীকার
ইসলামের শুরুতেই মুসলিমরা প্রকাশ্যে দ্বীন প্রচার করেনি। যখন প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু হলো, তখন থেকেই মুসলানদের উপর নির্যাতন শুরু হয়েছিল। এমনকি বিত্তশালী হওয়ার পরও হযরত আবু বকর (রা.) ও নিগ্রহের স্বীকার হয়েছিলেন। এই নির্যাতন নিগ্রহ এমন ছিলো যে, মুসলমানদের তিন তিনটি বছর একঘরে করে রাখা হয়েছিল।
সিদ্দিক উপাধি
যখন ৬১৭ খ্রিষ্টাব্দে মক্কার শাসক কুরাইশদের পক্ষ থেকে মুসলমানদের একঘরে করে রাখার সিদ্ধান্ত হয়। তখন থেকে তারা হঠাৎ মক্কার সামাজিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এরই মাঝে দুঃখের বছর ৬২০ খ্রিষ্টাব্দ আসে।
যে বছর ইসলামের জন্য সার্বিক সাহায্য সহযোগিতাকারী দুজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, রাসুলের স্ত্রী খাদিজা ও চাচা হযরত আবু তালিব মারা যান। এত দুঃখের মাঝেও আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবিবকে মিরাজে নিয়ে যান। যা বিশ্বাস করা তৎকালীন সময়ের জন্য খুবই অসম্ভব এবং বিস্ময়কর ব্যাপার।
কেননা রাসুলুল্লাহর (সা.) এর মুখে মিরাজের ঘটনা শুনে অনেকেই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝে ছিলো। যারা কাফির ছিলো তারা হেসেই গড়াগড়ি খাচ্ছিল। আর যারা মুসলমান ছিলো, তাদের অনেকেই ইসলামও ত্যাগ করেছিল। এই অবস্থায় লোকেরা হযরত আবু বকর (রা.) এর কাছে গিয়ে জানায়, হে হযরত আবু বকর (রা.), তোমার বন্ধুকে কি তুমি বিশ্বাস কর? সে তো এখন বলেছে, সে নাকি গতরাতে বাইতুল মাকদাসে গিয়ে, সেখানে নামায আদায় করে আবার রাতারাতি মক্কায় ফিরে এসেছে।’
তাদের কথা শুনে হযরত আবু বকর (রা.) বললেন, তোমরা কি তার কথা অবিশ্বাস কর? তারা বলল, অবশ্যই, কেননা মসজিদে বসে সবাই একথাই বলছে। ঠিক তখনই হযরত আবু বকর (রা.) বললেন, আল্লাহর কসম, তিনি যদি এই কথা সত্যিই বলে থাকেন তাহলে অবশ্যই সত্য কথাই বলেছেন। এতে অবাক হওয়ার কি দেখলে?
এরপর তিনি রাসুলুল্লাহর (সা.) কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তিনি জানতে চাইলেন, হে আল্লাহর নবী (সা.) আপনি কি গতরাতে বাইতুল মুকাদ্দাসে পরিভ্রমণ করেছিলেন? তিনি তাকে বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই। আর রাসুল (সা.) হ্যাঁ বলার সাথে সাথেই হযরত আবু বকর (রা.) বললেন, আপনি যা বলেছেন তা ঠিকই বলেছেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি নিঃসন্দেহে আল্লাহর একজন রাসুল। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) সাথে সাথেই ঘোষণা দিয়ে দিলেন, “হে হযরত আবু বকর (রা.), তুমি তো হচ্ছো সিদ্দীক। আর এভাবেই হযরত আবু বকর (রা.) “সিদ্দীক” উপাধিতে ভূষিত হন।
মদিনায় হিজরত
কুরাইশদের নির্যাতন থেকে বাচঁতে কিছু মুসলিম আবিসিনায় হিজর করে। আর কিছু মানুষ ধীরে ধীরে ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মদিনায় হিজরত করতে শুরু করে। কয়েকটি দলে ও উপদলে এই হিজরত হয়। মুহাম্মাদ সা. ও হযরত আবু বকর (রা.) একই সাথে হিজরত করেন। এই হিজরতের পথেই হযরত আবু বকর (রা.) অসম্ভব কষ্ট এবং ত্যাগ স্বীকার করেন। যেকারণে তাঁর কথা আল্লাহ কুরআনেও বলেছেন। বিশেষ করে গুহায় তাঁরা যে কষ্ট স্বীকার করেছেন তা অবর্ণনীয়।
মদিনায় হযরত আবু বকর (রা.) জীবনযাপন
ব্যাপক ত্যাগ তিতিক্ষা করে মুসলিমরা মদিনায় আগমন করে। এখানে প্রতিটি মুজাহির তথা মক্কাবাসীর সাথে এক একজন মনিনার আনসার তথা সাহায্যকারীর সাথে ভাতৃত্য বন্ধনে আবদ্ধ হন। অন্যান্য সাহাবিদের মতো হযরত আবু বকর (রা.) এর সাথে খারিজাহ বিন জাইদ আনসারিকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন।
এভাবে মদিনার জীবনের শুরুতে মুহাম্মাদ (সা.) একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। হযরত আবু বকর (রা.) এই মসজিদ নির্মাণকাজে অংশ নিয়েছিলেন।
মানিদায় ব্যবসা স্থাপন
হযরত আবু বকর (রা.) একজন পাক্কা ব্যবসাসী ছিলেন বলে, মদিনায় এসেও তিনি ব্যবসা শুরু করেন। এতে মদিনায় দ্রুত তার ব্যবসা সমৃদ্ধি লাভ করে। আর ব্যবসা বাণিজ্য করে তিনি এখানে ব্যাপক দান সাদকাসহ ইসলামের বিভিন্ন কাজে সাহায্য সহযোগিতা করতে থাকে।
সামরিক অভিযানে হযরত আবু বকর (রা.)
মুসলমানদের ইতিহাসে ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম যে ধর্ম যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়, তার নাম হচ্ছে বদর যুদ্ধ। গুরুত্বপূর্ণ এই যুদ্ধে হযরত আবু বকর (রা.) মুহাম্মাদ (সা.) এর তাবুর প্রহরার দায়িত্বে ছিলেন। পরের বছর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ উহুদেরও তিনি অংশ নিয়েছেন।
ইহুদিদের বিরুদ্ধে অভিযান
হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর প্রতিটি যুদ্ধের পরে ইহুদীদের বিভিন্ন গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেন। যাতে তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। এভাবে বনু নাদির অভিযান, বনু কুরাইজা অভিযান ও খায়বারের যুদ্ধেও হযরত আবু বকর (রা.) অংশ নিয়েছিলেন।
খন্দকের যুদ্ধ
৬২৭ সালে খন্দকের যুদ্ধেও তিনি অংশ নিয়েছিলেন। এই যুদ্ধে তাঁর তত্ত্বাবধানে একটি দল ছিলো। শত্রু পক্ষ বিভিন্নভাবে পরিখা অতিক্রমের চেষ্টা করে। কিন্তু হযরত আবু বকর (রা.) তার দায়িত্ব থাকা অংশে তাদের সকল আক্রমণ ঠেকিয়ে দেন। আর এই কারণেই তার নামে সে অংশে একটি মসজিদ নির্মিত হয় যা মসজিদ-ই-সিদ্দিকি নামে পরিচিত। একইসাথে তিনি ৬২৮ সালে অনুষ্ঠিত হুদায়বিয়ার সন্ধিতে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন এই সন্ধির অন্যতম একজন সাক্ষী। এছাড়াও তিনি তিনি খায়বারের যুদ্ধেও অংশগ্রহন করেন।
মক্কা বিজয়ের সাক্ষী
মুসলিম ইতিহাসে মক্কা বিষয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ৬৩০ সালের এই গুরুত্বপূর্ণ রক্তপাতহীন যুদ্ধের সাক্ষীও ছিলেন হযরত আবু বকর (রা.)।
হুনায়ন ও তাইফের যুদ্ধ
৬৩০ সালে অনুষ্ঠিত হওয়া হুনায়নের যুদ্ধ এবং তাইফের অবরোধেও হযরত আবু বকর (রা.) খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। হুনায়নের যুদ্ধের সময় শত্রু বাহিনী হুনায়ন উপত্যকার আড়ালে লুকিয়ে ছিলো। যখনই মুসলিম বাহিনী উপত্যকার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে, তখনই পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা শত্রুদের তীরের সম্মুখীন হয়। হঠাৎ অতর্কিত হামলা হওয়ায় মুসলিম বাহিনী অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে যায়। এতে তাদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়। শুধু তাইনয় এই ভীতির কারণে অনেকে ছুটোছুটি শুরু করলেও, হাতেগোনা কয়েকজন সাহাবি মুহাম্মাদ (সা.) কে রক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন। আর তাদের মধ্যে হযরত আবু বকর (রা.) ছিলেন অন্যতম।
তাবুক অভিযান
৬৩০ সালে রাসুলুল্লাহ (সা.) সিদ্ধান্ত নেন তিনি তাবুক অভিযানে নামবেন। এই অভিযানে সহায়তার জন্য তিনি সকল মুসলিমদের কাছে সাহায্যের হাত বাড়াতে নির্দেশ দেন। এই অভিযানে উসমান ইবনে আফফান প্রায় নয়শ উট এবং একশ ঘোড়া পর্যন্ত দান করেছিলেন। একইভাবে উমর ইবনুল খাত্তাব তার সম্পদের অর্ধেক দান করেন। কিন্তু হযরত আবু বকর (রা.) তার সকল সম্পদ দান করে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
আমিরুল হজ্জ হিসেবে হযরত আবু বকর (রা.)
মক্কা বিজয়ের পর ৬৩১ সালে প্রথম বারের মতো পূর্বের জাহেলি যুগের হজ্জের বিপরীতে শুদ্ধ পদ্ধতিতে হজ্জ্ব পালনের জন্য মুসলিমদের একটি দল হজ্জের উদ্দেশ্যে মক্কা গমন করে। হযরত আবু বকর (রা.) ছিলেন সেই দলের নেতা। এই কারণে ইসলামের ইতিহাসে তিনি প্রথম আমিরুল হজ্জ্ব বা হজ্জ্বের নেতা হিসেবে স্বীকৃত।
যখন তিনি হজ্জ্বের উদ্দেশ্যে রওনা হন, তখন হজ্জ্ব এবং অমুসলিমদের সাথে কীরূপ সম্পর্ক থাকবে সেই বিষয়ে কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হয়। আর এই তথ্য জানানোর জন্য হযরত আলি (রা.) কে হযরত আবু বকর (রা.) এর কাছে প্রেরণ করা হয়।
এরপর আলি কুরআনের আয়াতের নির্দেশ ঘোষণা করেন। এতে বলা হয়,
- এই হজ্জ্বের পর থেকে অমুসলিমরা হজ্জ্ব পালনের জন্য কাবায় আসতে পারবে না।
- হজ্জ্বে কেউ নগ্নভাবে কাবার তাওয়াফ করতে পারবে না।
- মুশরিকদের সাথে অতীতে সম্পাদিত সকল চুক্তিসমূহ বিলুপ্ত করা হয়। একইসাথে এইসকল বিষয় নিষ্পত্তি করার জন্য চার মাস সময় দেওয়া হয়।
মুহাম্মাদের (সা.) মৃত্যু
বিদায় হজ্জ্বের পর থেকেই রাসুলুল্লাহ (সা.) অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর অসুস্থতা ক্রমান্বয়ে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই অবস্থায়ও তিনি তার মৃত্যুর চারদিন আগ পর্যন্ত সালাতের ইমামতি করেন। পরবর্তীতে অসুস্থতার মাত্রা বৃদ্ধির কারণে তিনি আর ইমামতি করতে পারেননি। তিনি এসময় সালাতের দায়িত্ব দেওয়া হয় হযরত আবু বকর (রা.) কে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) এর মৃত্যু সংবাদ প্রচার হওয়ার পর হযরত উমর (রা.) অশান্ত হয়ে পড়েন এবং রাসুলুল্লাহর মৃত্যুকে মানতে অস্বীকৃতি জানান। তাঁর মতে এতো বড় সর্বশ্রেষ্ঠ নবি কখনোই মরতে পারেন না। তারমতে, যেভাবে মুসা (আ.) চল্লিশ দিন পর তুর পাহাড় থেকে ফিরে এসেছিলেন, ঠিক তেমনি মুহাম্মদও একদিন ফিরে আসবেন। এমন ধারণা তখন অনেকেই করতে থাকেন। এই অবস্থায় মুসলিম উম্মাহকে সঠিক পথ দেখাতে এগিয়ে এসেছিলেন হযরত আবু বকর (রা.)। তিনি এসে ঘোষণা দেন,
“তোমাদের মধ্যে যারা মুহাম্মাদের (সা.) অনুসরণ করতে তারা জেনে রাখুক যে, মুহাম্মাদ (সা.) মৃত্যুবরণ করেছেন। আর যারা আল্লাহর ইবাদত করতে, তারা জেনে রাখ অবশ্যই আল্লাহ সর্বদাই জীবিত থাকবেন কখনো মৃত্যুবরণ করবেন না।”
একইসাথে হযরত আবু বকর (রা.) কুরআন থেকে সুরা : আল ইমরানের ১৪৪ নং আয়াত পড়ে শোনান।
“আর মুহাম্মাদ কেবল একজন রাসূল। তার পূর্বে নিশ্চয় অনেক রাসূল বিগত হয়েছে। যদি সে মারা যায় অথবা তাকে হত্যা করা হয়, তবে তোমরা কি তোমাদের পেছনে ফিরে যাবে ? বস্তুতঃ যে পশ্চাদপসরণ করবে, সে কখনও আল্লাহর কিছু ক্ষতি করতে পারবে না। আর আল্লাহ অচিরেই কৃতজ্ঞদের প্রতিদান দেবেন।”
তাঁর এই বক্তব্যের পর উমর শান্ত হন এবং অন্যান্যরাও শেষ পর্যন্ত স্বীকার নেন যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) আসলেই মৃত্যুবরণ করেছেন।
ইসলামি খিলাফত নির্বাচন
রাসুলুল্লাহ (সা.) ওফাতের পর মুসলিম জাহান একপ্রকার অভিভাবক শূন্য হয়ে পড়ে। এই ক্রান্তিকাল মুহূর্তে কে তাঁর উত্তরাধিকারী হবে তা নিয়ে চলে ব্যাপক মতপার্থক্য। এই সময় মুহাজির ও আনসাররা চায় নিজেদের মধ্য থেকে নেতা নির্বাচন করতে। আনসারদের দাবি ছিলো, যেহেতু তারা রাসুলুল্লাহকে (সা.) আশ্রয় দিয়েছে, নিজেদের জান-মালের বিনিময়ে দুর্বল ইসলামকে সবল ও শক্তিশালী করেছে, সুতরাং তাদের মধ্য থেকে কাউকে রাসুলুল্লাহর (সা.) স্থলাভিষিক্ত করতে হবে। কিন্তু মুহাজিরা তাদের এই দাবি গ্রহণ করতে নারাজ। তারা দাবি করে, আমরাই ইসলামের বীজ আমরা বপন করেছি এবং এতে আমরাই পানি সিঞ্চন করেছি ও যাবতীয় কষ্ট ভোগ করেছি। অতএব আমরাই খিলাফতের অধিকতর দাবিদার। এই দুই দল ছাড়াও কিছু কিছু গোত্র ছিলো যারা পুরনো প্রথা অনুযায়ী গোত্রভিত্তিক নেতৃত্ব ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চায়।
এইসব বিভিন্ন দলের মুখোমুখি পর্যায়ে পরিস্থিতি ভিন্নদিকে মোড় নিতে থাকল। তখন হযরত আবু বকর (রা.) কে ডাকা হল। তখন তিনি, উমর ও আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ সেখানে গিয়ে উপস্থিত হন। এবং ধীর-স্থিরভাবে কথা বলতে লাগলেন। তাঁর যুক্তি ও প্রমাণের কাছে আনসাররা নতি স্বীকার করলো।
শেষ পর্যায়ে উমর ইবনুল খাত্তাব হযরত আবু বকর (রা.) এর হাত ধরে তার কাছে বাইয়াত হয়ে আনুগত্য প্রকাশ করলেন। তার দেখাদেখি হযরত আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহও তাকে অণুসরণ করেন। এভাবে অন্যান্য সকলেই হযরত আবু বকর (রা.) কে নেতা হিসেবে মেনে নেয়। এভাবে রাসুলুল্লাহর (সা.) ওফাতের পর হযরত আবু বকর (রা.) বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা দিয়ে জটিল পরিস্থিতির সুন্দর সমাধান দিয়েছিলেন।
হযরত আবু বকর (রা.) এর শাসনামল
রাসুল (সা.) পরবর্তী হযরত আবু বকর (রা.) এর শাসনামল ছিলো মাত্র ২৭ মাস। তাঁর শাসনামল অল্প দিনের হলেও, তাকে মোকাবিলা করতে হয়েছে বিপুল পরিমাণ প্রতিকূলতা। তাঁর সময়ে তাকে এমন সব অস্থিতিশীলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে, যা ছিলো খুবই চ্যালেঞ্জিং।
বিশেষ করে রাসুলুল্লাহ (সা.) ওফাত পরবর্তী নতুন নতুন নবি দাবিদারসহ আরবের আশেপাশের শত্রুরাও এই সময় বিদ্রোহ করে বসে। এই সময় তিনি বেশ কিছু যুদ্ধের সম্মুখীন হন। একইসাথে তিনি বাইজেন্টাইন ও সাসানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধেও ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করেন। যার গুরুত্ব আজও ইতিহাসে চীর অম্লান। আমরা নিচে তার শাসনামলের কিছু ক্ষুদ্র চিত্র দেখি।
হযরত আবু বকর (রা.) চারিত্রিক দৃঢ়তা
হযরত আবু বকর (রা.) ছিলেন খুবই সহজ সরল এবং অমায়িক মনের মানুষ। তিনি সহজকে কাউকে কষ্ট দেননি। এবং তার কাছ থেকে কেউ কষ্ট পেয়েছে এমন ঘটনাও নেই। কিন্তু এমন সহজ সরল মনুষটির চারিত্রিক দৃঢ়তা ছিলো অকল্পনীয়। যার নমুনা আমরা পাই তার খিলাফতের শুরুতেই।
মুতা যুদ্ধের রক্তের প্রতিশোধ হিসাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি বাহিনী প্রস্তুত করেন। যার কমাণ্ডার নিযুক্ত করা হয় নওজোয়ান উসামা ইবন যায়িদকে। রাসুলুল্লাহর (সা.) নির্দেশে উসামা তাঁর বাহিনী নিয়ে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। তারা কিছুদূর যেতেই খবর পেলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) অসুস্থ। তাই তারা যাত্রা বিরতি দেয়। পরবর্তীতে এই অবস্থায় রাসুলুল্লাহ (সা.) এর ওফাত হয়ে যায়।
আর তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথেই আরবের চিত্র পাল্টে যায়। তখন আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন দিকে থেকে নানা অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। একইসাথে কেউ কেউ ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে যাচ্ছে, কেউবা যাকাত দিতে চাইছে না, আবার কেউ কেউ নবুওয়াতের দাবীও করে বসে। এইরকম এক চরম পরিস্থিতিতে অনেকে পরামর্শ দিলেন সিরিয়ায় উসামার বাহিনী পাঠানোর ব্যাপারটি স্থগিত রাখতে।
কিন্তু হযরত আবু বকর (রা.) অত্যন্ত কঠোরভাবে এই পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি কোনভাবেই এই অভিযান থেকে পিছু হটলেন না। কেননা এই নির্দেশ তার ছিলো না, বরং এই অভিযানের নির্দেশ ছিলো খোদ রাসুলুল্লাহ (সা.) এর। তাই হযরত আবু বকর (রা.) এই বিষয়ে খুবই কঠোর মনোভাব দেখালেন। শুধু তাই নয় যখন একদল মুসলমান যাকাত দিতে অস্বীকার করল। তখন উমর বলল চারদিকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে এদের ছেড়ে দিন। কিন্তু হযরত আবু বকর (রা.) তাদের বিষয়েও কঠোর মনোভাব দেখালেন। এবং বললেন, প্রয়োজনে তিনি তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবেন। তবুও কাউকে তিনি ছেড়ে দিবেন না।
রিদ্দার যুদ্ধ
রাসুল পরবর্তী রিদ্দর যুদ্ধ ইসলামি ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। যা খুবই সুকৌশলে এবং হিম্মতের সাথে খলিফা হযরত আবু বকর (রা.) মোকাবেলা করতে পেরেছিলেন। এই যুদ্ধের কারণ ছিলো অনেক গুলো। যার মধ্যে ছিলো, নতুন নতুন নবি দাবিদারকারী, যার মধ্যে মুসায়লিমা কাজ্জ্বাব ছিল প্রধান। একইসাথে বেশ কিছু আরব গোত্রও হযরত আবু বকর (রা.) বিদুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে। তাছাড়াও কিছু কিছু গোত্র হযরত আবু বকর (রা.) কে মেনে নিতে চাইলো না বলেই বিদ্রোহ করল। এরচেয়েও বড় সমস্যা দেখা দিয়েছিল কিছু মুনাফিকের কারণে। তারা সরাসরি যাকাত দিতে অস্বীকার করা বসে।
এইসব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীর কারণে হযরত আবু বকর (রা.) বাধ্য হন রিদ্দর যুদ্ধে নামতে। যে যুদ্ধে মুসায়লিমা ইয়ামামা থেকে ধর্মদ্রোহিতার নেতৃত্ব দেয়। এই বিদ্রোহের অন্যান্য কেন্দ্রসমূহ ছিলো দক্ষিণ ও পূর্বে বাহরাইন, ওমান, মাহরা ও ইয়েমেন।
এই যুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য হযরত আবু বকর (রা.) তাঁর বাহিনীকে ১১টি সেনাবাহিনীতে পৃথক করেন। তার সবচেয়ে শক্তিশালী দলের নেতৃত্ব দেন খালিদ বিন ওয়ালিদ। হযরত আবু বকর (রা.) পরিকল্পনা করেন প্রথমে পশ্চিম ও মধ্য আরবের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনবেন। তারপর মালিক ইবনে নুয়াইরাকে মোকাবেলা করবেন। তারপর চূড়ান্তভাবে সবচেয়ে বড় শক্তিশালী প্রতিপক্ষ মুসায়লিমার মুখোমুখি হবেন।
তার পরিকল্পনা অনুযায়ী অনেক গুলো সফল ও ধারাবাহিক অভিযান শেষ করে চূড়ান্ত পর্যায়ে খালিদ বিন ওয়ালিদ কে দিয়ে মুসায়লিমাকে ইয়ামামার যুদ্ধে পরাজিত করেন। আর এভাবেই সকল বিদ্রোহীকে দমন করে হযরত আবু বকর (রা.) তাঁর খিলাফত অটুট রাখেন।
কুরআন মাজীদ সংকলন
হযরত আবু বকর (রা.) এর শাসনামলে ইয়ামামার যুদ্ধে অনেক হাফেজ শহীদ হয়ে যান। এভাবে এতো হাফেজ শহীদ হয়ে যাওয়া যায় সকলের মধ্যে একটা উৎকণ্ঠা কাজ করে। তাই উমর ইবনুল খাত্তাব পবিত্র কুরআনকে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করার জন্য আবেদন জানান। কিন্তু এই প্রথা মুহাম্মাদ সা. এর সময় ছিল না বলে প্রথমে হযরত আবু বকর (রা.) এতে রাজি হননি। কিন্তু পরবর্তীতে উমর তাকে রাজি করাতে সক্ষম হন। আর এভাবে সকলের সম্মতিক্রমে জায়েদ ইবনে সাবিতকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। আর এই কমিটির সকল সদস্যরাই ছিলে হাফেজ। তারা কুরআনের ছড়িয়ে ছিটিয়ে সকল অংশকে সংগ্রহ করে একক গ্রন্থ হিসেবে লিপিবদ্ধ করেন। এবং তা হাফেজদের স্মৃতির সাথে মিলিয়ে দেখেন। আর এভাবেই আল্লাহ হযরত আবু বকর (রা.) কে দিয়ে পবিত্র কুরআন মজিদ সংরক্ষণ করে নেন।
সামরিক সম্প্রসারণ
রিদ্দার যুদ্ধে বিজয়ের ফলে হযরত আবু বকর (রা.) এর সাহস ও মনোবল বেড়ে যায়। আর তাই তিনি নতুন করে বিজয় অভিযান শুরু করেন। আর এইসময় তিনি বাইজেন্টাইন ও সাসানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন। তৎকালীন সময়ে এইসব অভিযান খুবই সাফল্য লাভ করে। যেকারণে পরবর্তী খলিফারাও এইসব অভিযান চালু রাখেন।
সাসানীয় সাম্রাজ্য জয়
হযরত আবু বকর (রা.) এর সবচেয়ে দক্ষ সেনাপতি ছিলো খালিদ বিন ওয়ালিদ। তিনি তাকে সাসানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেছিলেন। সাসানীয়রা ছিলো মুসলমানদের থেকেও শক্তিশালী। তাই এসকল অভিযানে পরাজিত হওয়ার আশঙ্কা ছিল অনেক। তাই সাফল্যের জন্য হযরত আবু বকর (রা.) দুইটি পদক্ষেপ নেন।
- প্রথমত, স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে বৃহৎ একটি সেনাবাহিনী গড়ে তোলা।
- দ্বিতীয়ত, এই অভিযানে খালিদ বিন ওয়ালিদকে প্রধান সেনাপতি হিসাবে নিয়োগ দেওয়া।
এদিকে ইয়ামামার যুদ্ধে ভন্ড নবি দাবিদার মুসায়লিমাকে পরাজিত করার পর খালিদ সেখানেই অবস্থান করছিল। তাকে ঐ অবস্থায় খলিফা হযরত আবু বকর (রা.) সাসানীয় সাম্রাজ্যে অভিযানের নির্দেশ দেন। আর তার নেতৃত্বেই সাসানীয় সাম্রাজ্য মুসলিমরা জয় লাভ করে।
আবু বকর (রা.) এর মৃত্যু
চারদিকে এতো খবরের মধ্যেই ৬৩৪ সালের আগস্ট মাসে আরবি ১৩ হিজরিতে হযরত আবু বকর (রা.) কঠিন জ্বরে আক্রান্ত হন। অসুস্থতার মাত্রা এতো বৃদ্ধি পায় যে তিনি সব সময়ই বিছানায় শায়িতাবস্থায় থাকেন। তিনি বুঝতে পারলে তার সময় ঘনিয়ে এসেছে। তাই তিনি তার উত্তরসূরি মনোনীত করার জন্য চিন্তা করলেন। কেননা তিনি আগে থেকেই কাউকে মনোনীত না করলে পরবর্তীতে নানান সমস্যা দেখা দিতে পারে।
তাই তিনি অন্যান্য শীর্ষ সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করে তাঁর পরবর্তী উত্তরসূরি হিসেবে উমর ইবনুল খাত্তাবকে নিয়োগ দেন। এভাবে ১৫ দিন রোগাক্রান্ত থাকা অবস্থায় ৬৩৪ খৃষ্টাব্দের আগস্ট মাসের ২২ তারিখ তিনি ইনতিকাল করেন। এবং তাঁকে আয়িশার ঘরে মুহাম্মাদ (সা.) এর পাশে তাকে দাফন করা হয়।
ইসলামে হযরত আবু বকর (রা.) এর অবদান
ইসলামে হযরত আবু বকর (রা.) এর অবদান অবিস্মরণীয়। তাঁর সারাজীবনের ব্যাপক অবদানের কথা আমরা আজও নির্দ্বিধায় স্বরণ করি। তাঁর তার উল্ল্যেখযোগ্য অবদান গুলো হলো
- ক্রীতদাস মুক্ত করণ: তিনি তাঁর জীবনে অসংখ্য ক্রীতদাসকে নিজের টাকা দিয়ে মুক্ত করেছেন।
- দান সাদকা: তাঁর সারাজীবনটা তিনি দান সাদকা করেই কাটিয়েছেন। এমনকি তিনি বিভিন্ন যুদ্ধে এমনও দান করেছিলেন যে, ঘরের কোনো কিছুই বাদ রাখেননি। সবই দান করে দিয়েছিলেন।
- বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ: তিনি তাঁর জীবনে অসংখ্য যুদ্ধে অংশ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
- আমিরুল হজ্জ্ব উপাধি অর্জন: সর্বসম্মত মত অনুযায়ী, হিজরি নবম সালে হজ্জ্ব ফরজ হয় এবং সেই বছরই রাসুলুল্লাহ (সা.) হযরত আবু বকর (রা.) -কে আমিরুল হজ্জ্ব বা হজ্জ্বের প্রতিনিধি করে একটি দলের সাথে হজ্জ্ব পালন করতে পাঠান। হজ্জ্বের জন্য রওনা হওয়া এই দলের সংখ্যা ছিল তিনশ’। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর পক্ষ থেকে হযরত আবু বকর (রা.) আমিরুল হজ্জ্ব হিসেবে এই হজ্জ্বের দায়িত্ব পালন করবেন এবং এই দলের মুসলমানদের হজ্জ্ব করাবেন, এটাই ছিল মূল উদ্দেশ্য।
এখানে উল্লেখ্য যে, ইবনে সাদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “হযরত আবু বকর (রা.) যখন ‘আল-আরাজ’ নামক জায়গায় পৌঁছালেন, তখন হজরত আলী (রা.) সেখানে গিয়ে পৌঁছান। তাঁকে সেখানে দেখে হযরত আবু বকর (রা.) জানতে চাইলেন, ‘আপনি কি এখানে আমির হিসেবে এসেছেন নাকি ‘মামুর’ (আদিষ্ট) হিসেবে?’ তার জবাবে হজরত আলী (রা.) বলেন,” আমি মামুর হিসেবে এখানে এসেছি।” এরপর আলী (রা.) সহ সকলেই হজ্জ্বের জন্য পুনরায় যাত্রা করেন।
এখানে আরও উল্লেখ্য যে, হযরত আলী (রা.) মূলত হজ্জ্ব সংক্রান্ত কুরআনের আয়াত সমূহ জানিয়ে দেওয়ার জন্যই সেই দলে যোগ দিয়েছিলেন। আর এভাবেই রাসুলুল্লাহ (সা.) এর পক্ষ থেকে হজ্জ্ব করিয়ে হযরত আবু বকর (রা.) আমিরুল হজ্জ্ব উপাধি অর্জন করেন।
- মসজিদে নববীতে ইমামতি: রাসুলুল্লাহ (সা.) অসুস্থ হওয়ার পর থেকে, যখনই তিনি সালাতের ইমামতি করতে পারেন নাই, তখনই সেখানে হযরত আবু বকর (রা.) কে ইমামতি করার জন্য রাসুলুল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। আর এভাবেই রাসুলুল্লাহ (সা.) এর জীবিত অবস্থায় হযরত আবু বকর (রা.) মসজিদে নববীতে ইমামতি করার সৌভাগ্য অর্জন করেন।
- রাসুলের মৃত্যু পরবর্তী প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা: রাসুলুল্লাহ (সা.) এর ওফাতের পর নেতৃত্ব নিতে
- বিদ্রোহ বিশৃঙ্খলা দমন: রাসুলুল্লাহ (সা.) এর ওফাত পরবর্তী মুসলিম সাম্রাজ্যে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল, তা অব্যাহত থাকলে তখনই মুসলিম বুনিয়াদ ধ্বংস হয়ে যেতো। এই পরিস্থিতিতে আল্লাহ হযরত আবু বকরকে দিয়ে যাবতীয় বিশৃঙ্খলা দূর করেছিলেন।
- ধর্মত্যাগীদের দমন বা রিদ্দার যুদ্ধে নেতৃত্ব দান: রাসুল (সা.) এর মৃত্যুর পর, আরবের চারিদিকে ব্যাপক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এই বিশৃঙ্খলা দমন করতে হযরত আবু বকর (রা.) রিদ্দার যুদ্ধে নামেন। তিনি শক্ত হস্তে এই যুদ্ধের মাধ্যমে সকল বিশৃঙ্খলাতা নিবারণ করে মুসলিম সাম্রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
- ভন্ড নবীদের দমন: রাসুল (সা.) পরবর্তী অনেকেই নিজেকে ভন্ড নবি দাবি করে বসে। এইসব ভন্ড নবিদের শায়েস্তা করেও আবু বকর ইসলামের ইতিহাসে ব্যাপক অবদান রাখেন।
- আরবের বাহিরে বিভিন্ন সামরিক অভিযান পরিচালনা : হযরত আবু বকর শত্র দমনের পাশাপাশি মুসলিম সাম্রাজ্যকে বৃদ্ধি করার জন্য ব্যাপক সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। তাঁর এই অভিযান সমূহের কারণে বিপুল পরিমাণ দেশ মুসলমানদের আয়ত্তে আসে। তাঁর শিক্ষা থেকেই পরবর্তী খলিফারা বিভিন্ন অভিযান অব্যাহত রাখেন।
- কুরআন সংকলন: ইসলামে হযরত আবু বকর (রা.) এর সবচেয়ে বড় অবদান হলো কুরআন সংকলন। তিনি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কুরআনের বিভিন্ন অংশ একত্রিত করে তাকে গ্রন্থাকারে রূপ দেন। যা ইসলামের জন্য একটি বড় আবদান।
উপরোক্ত এইসব কাজের কারণেই হযরত আবু বকর (রা.) কে ইসলামের ত্রাণকর্তা বলা হয়।
হাদিস বর্ণনায় সতর্ককারী
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে তাঁর নামে মিথ্যা বলবে, তার স্থান হবে জাহান্নাম। আর তাই হযরত আবু বকর (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে খুবই কম হাদিস বর্ণনা করেছেন। অথচ সারাজীবন রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সাথে থাকার কারণে তার বর্ণিত হাদিস সংখ্যা হওয়ার কথা ছিলো বেশী। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তিনি খুব কমই হাদিস বর্ণনা করেছেন। তাঁর থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন ওমর, হুজাইফা, যায়িদ ইবন সাবিত,হযরত আবু বকর (রা.) উমামা, হযরত আবু বকর (রা.) বারাযা, হযরত আবু বকর (রা.) মুসা, উসমান, আবদুর রহমান ইবন আউফ, ইবন উমার, ইবন আমর ইবন আব্বাস,ইবন মাসউদ, উকবা, মা’কাল, আনাস, হযরত আবু বকর (রা.) হুরাইরা, তাঁর দু’কন্যা আয়িশা ও আসমা প্রমুখ সাহাবী। বিখ্যাত বিশিষ্ট তাবেয়ীরাও তাঁর থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন।
প্রশ্নোত্তর
হযরত আবু বকর (রা.) এর প্রকৃত নাম কি
হযরত আবু বকর (রা.) এর পূর্ণ নাম হচ্ছে, আবদুল্লাহ বিন আবি কুহাফা, সংক্ষেপ তিনি “হযরত আবু বকর (রা.)” নামে পরিচিত।
হযরত আবু বকর (রা.) এর স্ত্রীদের নাম
হযরত আবু বকর (রা.) জীবনে চারটি বিয়ে করেন। তাঁর এক স্ত্রীকে ইসলাম গ্রহণ না করার কারণে তিনি তালাক দিয়েছিলেন।
তাঁর স্ত্রীদের তালিকা হচ্ছে,
- কুতাইলা বিনতে আবদুল উজ্জা (তালাকপ্রাপ্ত)
- উম্মে রুমান
- আসমা বিনতে উমাইস
- হাবিবা বিনতে খারিজা
হযরত আবু বকর (রা.) এর মাজার কোথায়
হযরত আবু বকর (রা.) ৬৩৪ সালের ২৩ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর জীবনের শেষ ইচ্ছানুযায়ী তাকে তাঁর কন্যা মা আয়িশার ঘরে মুহাম্মাদ (সা.) এর রওজার পাশে তাকে কবর দেওয়া হয়। সেখানেই তাঁর কবর আজও আছে।
হযরত আবু বকর (রা.) কে ইসলামের ত্রাণকর্তা বলা হয় কেন?
ইসলামে হযরত আবু বকর (রা.) এর বিভিন্ন অবদানের কারণে তাকে ইসলামের ত্রানকর্তা অর্থাৎ বিপদে উদ্ধারকারী বলা হয়।
তার উল্ল্যেখযোগ্য অবদান গুলো হলো
- ক্রীতদাস মুক্ত করণ
- অকাতরে অর্থ দান
- বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ
- উমরাতুল কাযায় নেতৃত্ব দান
- মসজিদে নববীতে ইমামতি
- রাসুলের মৃত্যু পরবর্তী প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা
- বিদ্রোহ বিশৃঙ্খলা দমন
- ধর্মত্যাগীদের দমন বা রিদ্দার যুদ্ধে নেতৃত্ব দান
- ভন্ড নবীদের দমন
- আরবের বাহিরে বিভিন্ন সামরিক অভিযান পরিচালনা
- কুরআন সংকলন
উপরোক্ত এইসব কাজের কারণেই হযরত আবু বকর (রা.) কে ইসলামের ত্রাণকর্তা বলা হয়।
হযরত আবু বকর (রা.) কে কিভাবে খলিফা নির্বাচিত করা হয়
রাসুল (সা.) এর মৃত্যু পরবর্তী, বনু সাকিকে একটি সভায় সবার সর্বসম্মতিক্রমে তিনি খলিফা নির্বাচিত হন।
হযরত আবু বকর (রা.) সিদ্দিক নামের অর্থ কি?
হযরত আবু বকর (রা.) নামের অর্থ হলো “বিশ্বাসী”। তিনি তাঁর জীবনের সর্বাবস্থায় রাসুল (সা.) কে নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করতেন। এমনকি মিরাজের মতো অলৌকিক ঘটনাও লোক মুখে শুনেই বিশ্বাস করেছিলেন। তাই তাকে রাসুল (সা.) “সিদ্দিক” তথা বিশ্বাসী উপাধি দিয়েছিলেন।
আপনি আরো যা পড়তে পারেন
- হযরত মুহাম্মদ সা. এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
- ইমাম বুখারি (রহ.) এর জীবনী
- হযরত উসমান (রা.) এর জীবনী
- হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর জীবনী
- হযরত আদম (আ.) এর জীবনী
- হযরত আলী (রা.) এর জীবনী
- হযরত ওমর (রা.) এর জীবনী
- ইমাম আবু হানিফা (রহ.)
- ১০ টি সেরা ইসলামিক বই–যা অবশ্যই পড়া উচিত