গল্প গোলাপি আফছানা খানম অথৈ

0

গোলাপী

আফছানা খানম অথৈ

গোলাপীর বয়স যখন পাঁচ বছর তখন তার বাবা-মা মারা যায়।তাদের দু’জনের মৃত্যু ছিল খুব মর্মান্তিক।মাত্র দু’দিনের পার্থক্যে দু’জন মানুষ মারা গেল,তাও আবার কঠিন বসন্ত রোগে।রোগটা ছিল খুব খারাপ।আগেকার দিনে এসব রোগের কোন চিকিৎসা ছিল না।মিলাদ, মাহফিল, জিকির এসব ছিল বসন্ত রোগের মতো বড় রোগের ঔষধ।এ রোগ যে বাড়িতে ঢুকত দু’চারটা নিয়ে তবে ছাড়ত।যেমনটি ঘটেছিল গোলাপীর মা-বাবার ক্ষেত্রে।মাত্র দু’দিনের পার্থক্যে দু’জনকে নিয়ে গেল।এরপর গোলাপী একা হয়ে পড়লো।আপন বলতে আছে চাচা-চাচী।আত্নীয়-স্বজন সবাই মিলে তাকে চাচার কাছে রেখে গেল।চাচা ও তাকে ছাড়তে চাইল না।কারণ গোলাপী এখন বাবার রেখে যাওয়া কিছু সম্পত্তির মালীক হলো।গোলাপীকে হাত ছাড়া করলে সে এ সম্পত্তি ভোগ করতে পারবে না।তাই মায়া দেখিয়ে চাচা চাচী দু’জন তাকে রেখে দিলো।প্রথমে তাকে খুব আদর যত্ন করলেও কিছু দিন যাবার পর চাচী তার উপর খুব কড়া নজর দারী শুরু করে দিলো।নিজের মেয়ে দীপাকে স্কুলে পড়াচ্ছেন,আর গোলাপীকে দিয়ে সংসারের কাজ করাচ্ছেন।একদিন তার মায়ের দিকের এক আত্মীয় এসব দেখে বলল,
ভাবী এসব কী?এতটুকুন মেয়েকে দিয়ে সংসারের কাজ করাচ্ছেন?ওর তো এখন স্কুলে পড়ার কথা।
চাচী কী আর থেমে থাকে কড়া ভাষায় বলল,
এত দরদ দেখাতে এসো নাতো।এই হতছাড়ির পড়ার খরচ কে দেবে শুন?
।আমরা বাপু এসব পারবো না।বরং সে সংসারের কাজ করুক এটাই ভালো।আর কখনো এসব বাড়তি কথা বলতে এ বাড়িতে এসো না,বলে দিলাম।
গোলাপীর মামী আর কিছু না বলে চলে গেল।
আসলে তার বা কী করার আছে।বেশি কিছু বলতে গেলে হয়তো গোলাপীকে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন।শেষে মেয়েটা কোথায় থাকবে।এই ভেবে তিনি নীরবে সবকিছু হজম করে নিলেন।দীপা পড়ছে গোলাপীর ও পড়তে ইচ্ছে করছে।তাই মাঝে মাঝে চাচাত বোনের পড়ার ঘরে গিয়ে বসে।একদিন দীপার পড়ার ঘরে গোলাপীকে বসে থাকতে দেখে চাচী হুমায়ারা বেগম তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে গোলাপীকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিলেন।তখনি দীপা বলল,
মা তুমি কী মানুষ না… ?
থামলি কেনো বল আমি কী?
দীপা বুঝতে পারলো মায়ের মেজাজ এখন চড়াও হয়ে আছে।আর কিছু বলা যাবে না।বললে গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দেবেন।তাই আস্তে করে বলল,
মা বলছিলাম কী আপু এমন কী অন্যায় করেছে যে ওকে এমন কড়াভাবে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিলে?
অন্যায় করেনি মানে, তার কাজ হলো থালা বাসন ধোয়া রান্নাঘরের কাজ দেখা।সে তোর ঘরে বসতে গেল কেনো?
মা তাতে কি হয়েছে। এটা কোন অন্যায় হলো?মা আর কখনো এমনভাবে আপুকে মারবে না।কারণ আপুও আমাদের মতো রক্তে মাংশে গড়া মানুষ।
মা কড়া ধমক দিয়ে বলল,
দীপা স্টপ বড়ই তর্ক করতে শিখেছ দেখি।সাবধান মায়ের সঙ্গে এভাবে তর্ক করতে নেই।
গোলাপী কাঁদতে কাঁদতে দীপার ঘর থেকে বেরিয়ে রান্না ঘরের এককোনে গিয়ে বসে পড়লো।কান্না ছাড়া তার আর কী বা করার আছে।সে ডুঁকরিয়ে কেঁদে উঠে বলে,
মা-বাবা তোমরা চলে গেলে,আমাকে নিয়ে গেলে না কেনো?আমি আর নির্যাতন সইতে পারছি না।
এমনি অমানুষিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে কাটতে লাগল গোলাপীর দিনগুলো।যতই দিন যাচ্ছে হুমায়ারা বেগমের নির্যাতনের মাত্রা আরও বেড়ে চলেছে।এত খাটুনির পর ও হুমায়ারা বেগম তিনবেলা পেটভরে খেতে দিচ্ছেন না গোলাপীকে।নিজের মেয়েকে ভালো খাওয়াচ্ছেন। আর গোলাপী আধাপেটে খাওয়া দিচ্ছেন তাও নিন্ম মানের।তবুও কেন জানি গোলাপীর শরীর স্বাস্থ্য খুব সুন্দর ভাবে বেড়ে উঠেছে।মাঝে ক’বছর পার হলো।গোলাপী কিশোর থেকে যৌবনে পা দিলো।চাচাতো বোন দীপা ইন্টারমিডিয়েটে পড়ছে।কিন্তু গোলাপীর ইচ্ছে থাকা সত্বেও পড়তে পারলো না,অশিক্ষিত রয়ে গেল।দীপার জন্য পাত্র দেখা হচ্ছে অথচ গোলাপী বড় তার কোন খবর নেই।আজ দীপাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে ঘর দুয়ার খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখল গোলাপী।ভালো রান্না বান্না ও করলো।পাত্রপক্ষ সময়মতো চলে আসল।গোলাপী চা নাস্তা দিয়ে টেবিল সাজিয়ে দিলো।গোলাপী দীপার চেয়ে সুন্দরী স্লিম ফিগার। পাত্রপক্ষের সবার নজর সে কেড়ে নিলো।পাত্রের মা বলল,
মা তোমার নাম কী?
গোলাপী বেগম।
বাহ: খুব সুন্দর তো।
আচ্ছা তুমি দীপার সম্পর্কে কী?
আমি ওর চাচাতো বোন।
তোমার বাবা-মা কোথায়?
গোলাপী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উত্তর দিলো।
আমার বাবা-মা বেঁচে নেই।আমি চাচার কাছে থাকি।গোলাপীকে অতিথিদের সাথে কথা বলতে দেখে হুমায়ারা বেগমের রাগ চরমে উঠে গেল।তিনি এগিয়ে এসে বললেন,
গোলাপী তোমার এখানে কী? যাও রান্নাঘরে।
গোলাপী কথা না বাড়িয়া রান্নাঘরে চলে গেল।হুমায়ারা বেগম ম্লান হেসে বলল,
দীপাকে আপনাদের পছন্দ হয়েছে?
পাত্রের মা উত্তর দিলো,
জ্বি হ্যাঁ হয়েছে,তবে দীপাকে নয় গোলাপীকে।
কী বললেন?
বলছিলাম দীপাকে নয়,গোলাপীকে আমাদের পছন্দ হয়েছে।
এবার হুমায়ারা বেগম চড়াও হয়ে বললেন,
কী বললেন ঐ ফকিন্নি মেয়েটাকে আপনাদের পছন্দ হয়েছে?সে তো আমাদের কাজের মেয়ে।
তাই নাকি?
তো আর বলছি কী।
কিন্তু গোলাপী যে বলল দীপার চাচাতো বোন।
এসব বুঝবেন না।সে আপনাদেরকে বশ করার জন্য বানিয়ে বলেছে।ছোট জাতের মেয়েদের এ একটা অভ্যাস কথায় কথায় মিথ্যে বলা।
ওহ তাই।
পাত্রপক্ষ কিভাবে কেটে পড়বে সেই চিন্তাই মগ্ন।পরিবেশটা কেমন জানি ঘোলাটে হয়ে গেল।হুমায়ারা বেগম রাগের বশে কি না কি করে বসেন,পাত্রপক্ষ ভয়ে জড়োসড়ো।কোন রকমে হাফ ছেড়ে বললেন,
তাহলে আপা আমরা এখন উঠি?
সে কী না খেয়ে যাবেন?
আপু চা নাস্তা সবইতো খেলাম আর কী?
কী যে বলেন আপা, আমার একমাত্র মেয়ের কুটুম বলে কথা।আমি কী আপনাদেরকে এভাবে ছেড়ে দিতে পারি?
সরি আপা আজ না।অন্যদিন এসে খেয়ে যাব।
বলতে না বলতে পাত্রপক্ষ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।হুমায়ারা বেগম বুঝতে পারলেন উনারা আর তার সাথে আত্মীয়তা করবেন না।তিনি খুব করে ক্ষেপে গেলেন গোলাপীর উপর। চোখ দুটো বড় বড় করে ছুটে গেলেন গোলাপীর ঘরে।তারপর দাঁত মুখ খিচিয়ে কোমরে কাপড় পেঁচিয়ে গোলাপীর গালে কষে দিলেন দুচড়।তারপর এলোপাতাড়ি মার…।
মারতে মারতে বলেন,
হতছাড়ি,অপয়া,অলক্ষণে তোর জন্য আজ আমার মেয়ের বিয়ে ভেঙে গেল।তোর আর এ বাড়িতে আর জায়গা নেই।বেরিয়া যা আমার বাড়ি থেকে।
মারের চড়ে গোলাপী মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।হুমায়ারা বেগমের পা ধরে কেঁদে কেঁদে বলে,
চাচী আর মেরো না,আমি আর সইতে পারছি না।
মারব না মানে,একশবার মারব,হাজারবার মারব,দেখি কে আমাকে বাঁধা দেয়?
হুমায়ারা বেগমের তোফের মুখে কেউ বাঁধা দেয়ার সাহস পেলো না।তিনি ঠিক মেরে রক্তাত্ব করে রাতের অন্ধকারে গোলাপীকে ঘর থেকে বের করে দিলেন।গোলাপী অজ্ঞান অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছে।হঠাৎ একটা টয়েটো গাড়ি চড়ে এক ভদ্রলোক আসছিলেন।লাইটের আলোতে রাস্তায় এক যুবতি মেয়েকে পড়ে থাকতে দেখে গাড়ি ব্রেক করলেন।কাছে আসতেই দেখলেন মেয়েটি মৃত না,জীবিত অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।তিনি তাকে দ্রুত হসপিটালে নিয়ে গেলেন।ইমারজেন্সি চিকিৎসার পর গোলাপীর জ্ঞান ফিরে আসল।গোলাপী চোখ খুলতে দেখল একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক তারপাশে বসে আছে।তখনি সে জানতে চাইল,
আমি কোথায়, আমি এখানে এলাম কী করে?
তখনি ভদ্র লোক উত্তর দিলেন,
মা তুমি অজ্ঞান অবস্থায় রাস্তায় পড়েছিলে।তারপর আমি তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসি।মা তোমার নাম কী?তুমি কোথায় থাক?বল মা আমি তোমাকে বাসায় পৌছে দিয়ে আসব।
ভদ্রলোকের কথার কোন উত্তর না দিয়ে গোলাপী গুম মেরে শুয়ে আছে।ভদ্র লোক ফের বললেন,
মা চুপ করে আছ কেনো?বলো তোমার ঠিকানা?
ঠিকানার কথা শুনে গোলাপীর চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।ভদ্র লোকের সন্দেহ হলো।তিনি আবার বললেন,
মা তুমি কাঁদছ কেনো? কী হয়েছে তোমার?তোমার বাবা-মা কি বেঁচে নেই?
চোখের পানি মুছতে মুছতে গোলাপী উত্তর দিলো,
চাচা আমার নাম গোলাপী।আমার বাবা-মা বেঁচে নেই।আমার বয়স যখন পাঁচ বছর,তখন বসন্ত রোগে দু’জন মারা যান।
তা তুমি এতদিন কোথায় ছিলে?
আমার চাচার কাছে।
তা রাস্তায় অজ্ঞান অবস্থায় পড়েছিলে কেনো?
চাচা সে এক করুণ কাহিনী।আপনি শুনে কি করবেন।
বল মা দেখি আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারি কিনা?
ভদ্র লোকের অনুমতি পেয়ে গোলাপী তার জীবনের করুণ কাহিনী প্রকাশ করলো।সবকথা শুনার পর ভদ্রলোক বললেন,
মারে চিন্তা করিস না।আমার কোন মেয়ে নেই।আজ থেকে তুই আমার মেয়ে। তুই আমার সঙ্গে থাকবি।তোর থাকা খাওয়া,বিয়ে শাদী সব দায়িত্ব আজ থেকে আমার।
সত্যি বলছেন চাচা?
হ্যাঁ মা সত্যি।আমার বুকে আয়।
বাবা মেয়ে মিট হলো।অসহায় “গোলাপী” অনেক নির্যাতনের পর বাবা-মায়ের ভালোবাসা ও আশ্রয় স্থল খুঁজে পেল।
ঃসমাপ্তঃ


Screenshot 3
বিজ্ঞাপনঃ বই কিনুন, বই পড়ুন

0

Afsana Khanam

Author: Afsana Khanam

লেখক

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

গল্প চেয়ারম্যানের মেয়ে আফছানা খানম অথৈ

চেয়ারম্যানের মেয়ে আফছানা খানম অথৈ মেহেরপুর একটি সুন্দর গ্রাম।এই গ্রামে কিছু অদ্ভুত নিয়মকানুন চালু আছে,যা অন্যকোন গ্রামে নেই।এই গ্রামে নারীরা

গল্প মেয়েরা ও মানুষ আফছানা খানম অথৈ

গল্প মেয়েরা ও মানুষ আফছানা খানম অথৈ রানু বউ হয়ে এসেছে চার পাঁচ মাস হলো।এরই মধ্যে তার স্বামী স্কলারশিপ এর

গল্প মেয়ে সাক্ষী আফছানা খানম অথৈ

মেয়ে সাক্ষী আফছানা খানম অথৈ আবিদ হায়দার বেড়াতে এসেছে গ্রামে তার বন্ধু ফুয়াদ'র বাসায়।অবশ্য সে একা না,তার সঙ্গে আছে,বন্ধু সজল

গল্প বন্ধ্যা আফছানা খানম অথৈ

গল্প বন্ধ্যা আফছানা খানম অথৈ আলেয়া বউ হয়ে এসেছে চার বছর হলো।এখনো মা হতে পারেনি। এজন্য রীতিমতো তাকে কটু কথা

2 Replies to “গল্প গোলাপি আফছানা খানম অথৈ”

Leave a Reply