ছোট গল্প : পথশিশু। লেখক : সুমাইয়া আক্তার বৃষ্টি

0

হিরা অনাথ পথশিশু। বয়স সবেমাত্র নয় পেরোল। গতবছর কলেরায় বাবা-মা দুজনেই গত হয়েছেন। এখন হিরা খোলা আকাশের পাখি হয়ে উড়ে বেড়ায়। শাসন করার মতো কেউ নেই। না আছে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার মতো কেউ।

বিকেলের শেষের ভাগে হিরা তার দলবল নিয়ে প্লাস্টিকের বোতল কুড়াতে রাস্তায় নেমেছে। সাথে আছে একটা প্লাস্টিকের বস্তা। একসময় দলের রতন হিরাকে জিজ্ঞেস করলো,”হ্যাঁ রে হিরা! তোর বাপ-মায় তোর নাম হিরা রাখলো কি ভাইব্বা? তুই তো হিরার মতো সুন্দর না।”

“বলদে কি কয়! হিরা সম্পর্কে তোর কোনো ধারনা আছে? হিরার যে কি পাওয়ার এইটা জানস তুই? পুরা পৃথিবীতে সবথেইকা দামী হইলো গিয়া হিরা। আর আমি আমার মায়ের কাছে সবচাইতে দামী আছিলাম। তাই আমার নাম রাখছিলো হিরা। দেহিস একদিন আমিও এই পৃথিবীর দামী একজন হমু।” খানিকটা ভাব নিয়েই কথাটি বললো হিরা।

“ঠিকমতো খাইবার পায় না দুই বেলা, আবার হেয় আয়ছে পৃথিবীর দামী একজন হইতে।” ভেংচি কেটে বললো রতন।

হিরা আরো কিছু বলবে তার আগেই দূরে পড়ে থাকা একটা মানিব্যাগের দিকে নজর পড়লো হিরার। তাই কিছু না বলে ব্যাগের কাছে গিয়ে ব্যাগটা হাতে দেখলো পুরো ব্যাগটা খালি। তবে ব্যাগের এক সাইডে কোনো রকম দুশো টাকার একটা নোট পড়ে আছে। যা হয়তো সহজেই সবার নজর এড়িয়ে যাবে। তবে কি করে যেনো হিরার নজরে পড়ে গেলো। আর তাই দেখে হিরা কিছুটা খুশি হয়ে দলের বাকি ছেলেদের বললো,”আরেব্বাস! রাইতের খাওনের টাকা হইয়া গেছে। নো চিন্তা বন্ধুগণ। আজকে আমরা মজা কইরা মাছ-ভাত খামু।”

দলের জগু সংশয় নিয়ে বললো,”ব্যাগের মালিক যদি এই টাকা খুঁজে?”

“আরেহ খুঁজবো না। দেহছ না কি সলিড ব্যাগ? ব্যাগের দাম’ই হইবো এক-দুই হাজার টাকা। এইগুলা বড়লোকদের বড় বড় ব্যাপার। হেগোর কাছে এই দুইশো টাকা কিচ্ছু না।” ব্যাগটি দেখিয়ে প্রতিত্তোরে বললো হিরা। আর তা শুনে জগু পুনরায় বললো,”দেখতো ব্যাগে আরো কিছু আছে নাকি?”

ব্যাগটা আরেকটু চেক করতেই ব্যাগে কিছু কাগজপত্র দেখতে পেলো হিরা। তাই দেখে বললো,”কি সব কাগজপাতিও দেহি আছে। এক কাজ করি লো। এই ব্যাগ পুলিশ মামুর কাছে দিয়া আহি। যদি দরকারি কাগজ হয়?

“পুলিশের কাছে যামু না। বেডাগো কাছে গেলেই ঝামেলা লাগায় দেয়।” অসন্তোষ চিত্তে কথাটি বললো রতন।

“কিচ্ছু হইবো না লো। আমরা কি কিছু করছি নাকি? আমাগো লগে ঝামেলা লাগাইবো কেন? বলতে না বলতেই কেউ একজন এসে হিরার হাত থেকে ব্যাগটা এক ঝটকায় নিয়ে নিলো। হিরা হাতের মালিকের দিকে তাকাতেই দেখলো মধ্যবয়স্ক এক লোক। পাশে পুলিশও আছে। কিছু একটা ভেবে হিরা লোকটির উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,” ও এইডা আপনের ব্যাগ? এনোই পইড়া আছিলো, আমরা মাত্র পাইলাম।”

লোকটা হিরার কথার প্রতিত্তোরে কিছু না বলে ব্যাগ চেক করতে লাগলো। খানিক সময় পর কিছু না বলেই হুট করে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিলো হিরার গায়ে। আর রক্তচক্ষু নিয়ে শুধালো,”চোরের বাচ্চা আমার বিশ হাজার টাকা কই?”

হিরা অনেকটা অবাক হয়ে গেলো। আসলে এই মুহুর্তে কেমন প্রতিক্রিয়া করা উচিত হিরা বুঝতে পারছে না। তাই কোনো রকম ভনিতা না করেই বলে দিলো,”লে মাজা! পাইলাম দুইশো টাকা আর আপনে কন বিশ হাজার টাকা।”

অতঃপর পকেট থেকে দুশো টাকার নোট টা বের করে লোকটির সামনে ধরে বললো,”ধরেন আপনের দুইশো টাকা। এই হিরা আপনের থেইকা বড় লোক আছে। দুইশো টাকার লাইজ্ঞা আমার জান চইলা যাইতো না।”

কথাটি বলে হিরা ও তার দলবল উলটো পথে হাঁটা ধরলো। কিন্তু পুলিশ তাদের পথ রুখে দাঁড়ালো। তারপর সাথে থাকা কন্সটেবলকে বললো,”এই চেক করো তো ওদের।”

“আমরা টাকা নেই নাই স্যার। এই দুইশো টাকাই পাইছিলাম ব্যাগে।”

জগুর কথা শুনে পুলিশটি ব্যাঙ্গ স্বরে বললো,”তাইলে কি টাকা হাওয়া হইয়া গেছে?”

“এমনও তো হইতে পারে কেউ টাকা আগেই সরাই ফেলছে পরে আমরা পাইছি।” হিরার এই কথায় পুলিশটি ক্ষিপ্ত স্বরে বললো, “এই কাজ তো তোরাও করতে পারছ। তোদের মতো টুকাই’রাই তো ঢাকা শহরে চুরি-ছিনতাই করে।”

হিরা, রতন, জগুর কোনো কথাই শুনলো না এরা। ভালোভাবে এই তিন বাচ্চা ছেলেকে চেক করলো। তারপর যখন কিছুই পেলো না তখন গায়ে হাত তোলা লোকটা হিরার শার্টের কলার ধরে দুই গাল চেপে ধরে শুধালো,”ভালোয় ভালোয় বলে দে টাকা কই রাখছোছ। নয়লে কিন্তু একদম জেলে ঢুকাইয়া দিমু। চিনোস আমারে? আমার পাওয়ার সম্পর্কে তোর কোনো ধারনা আছে?”

“এতোই যহন পাওয়ার আছে তার মানে আপনের অনেক টাকাও আছে। তারপরেও কেন এই বিশ হাজার টাকার লাইজ্ঞা পাগল কুত্তার মতো ব্যাবহার করতাছেন?”

হিরার কথায় লোকটি বেশ চটে গেলো। বেধড়ক মারতে লাগলো হিরাকে। জগু ও রতন বাধা দিতে এলে একসময় এই দুজনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। ফলস্বরূপ দুজনের’ই হাত-পা ছিলে গেছে রাস্তায় পড়ে থাকা খোয়া ও পাথরের টুকরোতে। এদিকে লোকটির মার খেয়ে হিরার গায়ে পরিহিত শার্ট প্রায় অনেকখানি ছিড়ে গেছে। নাক দিয়ে অনর্গল লাল টকটকে রক্ত নির্গত হচ্ছে। কিন্তু লোকটির কোনো মায়া হচ্ছে না এই বাচ্চা ছেলেটির জন্য। চারপাশে লোকজনের ভিড় জমে গেছে। অনেকে ভিডিও করছে ফেসবুকে আপলোড করবে বলে। অনেকে আবার সরাসরি লাইভ করছে ব্যাপারটা। যার শিরোনাম ছিলো অনেকটা এমন যে “ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়ে বেধড়ক মার খাচ্ছে বাচ্চা ছিনতাইকারী।”
পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে দেখে পুলিশ গিয়ে লোকটাকে কোনো রকম থামালো। আর হিরার হাত শক্ত করে ধরে জিজ্ঞেস করলো,”দেখ, টাকাগুলা দিয়া দে। তাহলে তোকে মাফ করে দিবো কথা দিচ্ছি আমি।”

হিরা নিজের চোখের অশ্রু মুছে কোনো রকম হিচকি তুলতে তুলতে বললো,”আমি সত্যি কইতাছি স্যার। আমি খালি এই দুইশো টাকাই পাইছি।”

“বুঝছি মোটা লাঠির মাইর না খাইলে তোর শিক্ষা হইবো না। তোদের মতো অনেক ছিনতাইকারী দেখছি জীবনে।”

তারপর পাশে থাকা কন্সটেবলকে উদ্দেশ্য করে বললো,”এই তিনটারে গাড়িতে তুলো তো।”

এতোক্ষণ যাবত সবাই নিরবে দেখে গেলেও এবার একজন প্রবীণ প্রতিবাদ করে বললেন,”আচ্ছা মানলাম এরা ছিনতাই করছে। তাই বলে এই বাচ্চা ছেলেটাকে এভাবে মারা কোনো ভদ্রলোকের কাজ বলে আমি মনে করি না। আর আপনারা পুলিশ হয়ে লোকটাকে একটুও বাধা দিলেন না। এই আপনাদের মতো কিছু পুলিশের জন্য আজ পুলিশের উপর থেকে ভরসা উঠে গেছে সাধারণ জনগণের।”

“বিগত দশ বছর ধরে পুলিশের চাকরি করছি। আমরা মানুষ দেখেই বুঝে যাই কে কেমন।” ক্ষিপ্ত স্বরে বললো পুলিশটি। সাথে হিরাকে মারা লোকটিও ক্ষেপে বললো,”টাকা তো আমার গেছে। আপনি কি বুঝবেন কতো কষ্টের টাকা।”

এবার প্রবীণ লোকটি হালকা হেসে বললো,”আমি আপনাদের থেকে নূন্যতম বছর বিশেক বড়। সেই হিসেবে আপনাদের থেকে একটু বেশি হলেও দুনিয়া চিনি। আর এই যে পুলিশ বাবা! ব্যাজে তো আনোয়ার লেখা। তা আনোয়ার সাহেব বলেই সম্বোধন করি। বলি কি আনোয়ার সাহেব পাশেই তো এটিএম বুথে। সেখানে তো সিসি ক্যামেরা আছেই যা সর্বাক্ষণ চালু থাকে। সেটা একবার দেখে নিলে কি বেশি অসুবিধা হতো?”

প্রবীণের কথায় এবার আনোয়ার সাহেবের টনক নড়লো। তাই উনি কিছু না বলে সাথে সাথেই সিসি ক্যামেরা ফুটেজ চেক করতে চলে গেলেন। সাথে গেলেন প্রবীণ লোকটিও।

ফুটেজ চেক করার পর সবার কাছে সবটা পরিষ্কার হয়ে গেলো। আনোয়ার সাহেব কথা বলার ভাষা খুজে পেলেন না। আর তা দেখে প্রবীণ লোকটি বললেন,”সব সময় ক্ষমতা দেখাতে নেই, ক্ষেত্রবিশেষে নিজের মস্তিষ্কও ব্যবহার করা শিখতে হয়।”

তারপর এই তিন বাচ্চাকে ছেড়ে দেওয়া হলো। লোকজন কেবল মুখে মুখে সহানুভূতি দেখিয়ে বললো,”আহারে! বেচারা বিনা দোষে কি মারটাই না খেলো!”
অনলাইন জগতে এই ভিডিও ও লাইভের শিরোনাম পালটে গেলো। আস্তেধীরে লোকজনের ভিড় কমতে শুরু করলো। পুলিশ মাথা নত করে চলে গেলো। প্রবীণ লোকটি হিরাকে এক ফার্মেসিতে ধরে নিয়ে গেলো। সেখানে গিয়ে ড্রেসিং করাতে করাতে হিরাকে জিজ্ঞেস করলো,”নাম কি তোমার দাদুভাই?”

“হিরা।” হিচকি তুলতে তুলতস ছোট্ট করে জবাব দিলো হিরা।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রবীণ লোকটি বললেন,”অতীতকে ভুলে যাওয়াই উত্তম। তবে অবশ্যই কি শিক্ষা পেলে তা সারাজীবন মনে রাখবে। আমাদের সমাজের মানুষদে মস্তিষ্ক শুকিয়ে অকেজো হয়ে পড়েছে। তাই সর্বদা এদের এড়িয়ে চলবে বুঝলে?”

হিরা এক হাতে নিজের চোখের পানি মুছে বললো,”আইজ আমি বড়লোক ঘরের পোলা হইলে কেউ এমনে আমার গায়ে হাত তুলতে পারতো না। পথশিশু বইলা কি আমরা মানুষ না? আমাদের ব্যাথা লাগে না?”

ছোট্ট এই বালকটির কথার কোনো প্রতিত্তোর দিতে পারলেন না প্রবীণ লোকটি। ছেলেটি তো সত্যিই বলেছে। আসলেই তো আমাদের সমাজে পথশিশুদের অন্য নজরে দেখা হয়। সবক্ষেত্রেই এরা সব কিছু থেকে বঞ্চিত হয়। আমরা ভুলে যাই যে এরাও মানুষ। এদেরও অনুভূতি রয়েছে। কিন্তু এ সমাজের ক’জনেই বা ভাবে এদের কথা?

সমাপ্ত

 


Screenshot 3
বিজ্ঞাপনঃ বই কিনুন, বই পড়ুন

0

Sumaiya Akter Bristy

Author: Sumaiya Akter Bristy

❝শুভ্রচিন্তার উদ্ভব ঘটে যার কথা ভেবে সে যদি মোহ হয় দোষ বা কি তাতে?❞ ~Sumaiya Akter Bristy

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

গল্প চেয়ারম্যানের মেয়ে আফছানা খানম অথৈ

চেয়ারম্যানের মেয়ে আফছানা খানম অথৈ মেহেরপুর একটি সুন্দর গ্রাম।এই গ্রামে কিছু অদ্ভুত নিয়মকানুন চালু আছে,যা অন্যকোন গ্রামে নেই।এই গ্রামে নারীরা

গল্প মেয়েরা ও মানুষ আফছানা খানম অথৈ

গল্প মেয়েরা ও মানুষ আফছানা খানম অথৈ রানু বউ হয়ে এসেছে চার পাঁচ মাস হলো।এরই মধ্যে তার স্বামী স্কলারশিপ এর

গল্প মেয়ে সাক্ষী আফছানা খানম অথৈ

মেয়ে সাক্ষী আফছানা খানম অথৈ আবিদ হায়দার বেড়াতে এসেছে গ্রামে তার বন্ধু ফুয়াদ'র বাসায়।অবশ্য সে একা না,তার সঙ্গে আছে,বন্ধু সজল

গল্প বন্ধ্যা আফছানা খানম অথৈ

গল্প বন্ধ্যা আফছানা খানম অথৈ আলেয়া বউ হয়ে এসেছে চার বছর হলো।এখনো মা হতে পারেনি। এজন্য রীতিমতো তাকে কটু কথা

4 Replies to “ছোট গল্প : পথশিশু। লেখক : সুমাইয়া আক্তার বৃষ্টি”

Leave a Reply