সাজদাহ’র সময় রাফ’উল ইয়াদায়নের সবগুলো হাদীস কি য’ঈফ? —২
📒 অভিযোগ
ইমাম নাসা’ঈ বর্ণিত সাজদাহ’র সময় রাফ’উল ইয়াদায়নের হাদীসটির সনদে কাতাদা ও ইবনে আবূ আরূবাহ নামক দু’জন মুদাল্লিস রাবী রয়েছেন, তাঁরা হাদীসটি ‘আন’যুক্ত বর্ণনা করেছেন। আর উসুল হচ্ছে, মুদাল্লিস রাবীর ‘আন’যুক্ত হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়।
📗 আমাদের জবাব
প্রথমেই বলে রাখি, এই হাদীসে উল্লেখিত দু’জন রাবীর কারো থেকেই কোনো প্রকারের তাদলীস ঘটেনি, যা আমরা সামনে প্রমাণ করে দিবো।
দ্বিতীয়ত মুদাল্লিস রাবীর ‘আন’যুক্ত হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়। এই উসূলটি ইমাম নববীর উসূলের মাধ্যমে কেটে যায়। ইমাম নববী বলেন-
وما كانَ فِي الصَّحِيحَيْنِ وشِبْهِهِما مِنَ الكُتُبِ الصَّحِيحَةِ، عَنِ المُدَلِّسِينَ بِعَنْ، فَمَحْمُولٌ عَلى ثُبُوتِ السَّماعِ لَهُ مِن جِهَةٍ أُخْرى
সহীহায়ন ও এ দুটোর মতো অন্যান্য সহীহ হাদীসের কিতাবসমূহের মধ্যে মুদাল্লিস রাবীদের যে সমস্ত ‘আন’যুক্ত হাদীস রয়েছে, এগুলোর ক্ষেত্রে ভিন্ন সনদে শোনার স্বীকৃতি রয়েছে। [তাদরীবুর দাবী —সুয়ূতী: ১/২৬৪]
অর্থাৎ মুদাল্লিস রাবীর ‘আন’যুক্ত হাদীস গ্রহণযোগ্য নয় এই উসুলটি বুখারী-মুসলিম ও সুনানে নাসাঈ এবং এই পর্যায়ের অন্যান্য সহীহ হাদীসের কিতাব সমূহের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।
আপনারা কি অবাক হচ্ছেন? আরে এই উসূল তো লা-মাযহাব ভাইটিও উল্লেখ করেছিলো! জি হ্যাঁ, আপনি ঠিকই ধরেছেন। লা-মাযহাব ভাইটিও উসূলটি উল্লেখ করেছেন- তবে জালিয়াতি যাদের মন মস্তিষ্কে শেকড় গেড়ে বসে গেছে তারা কখনো জালিয়াতি থেকে বের হতে পারে না। অর্থাৎ লা-মাযহাব ভাইটি এখানেও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন।
তিনি উসূল তো উল্লেখ করেছেন ঠিকই তবে উসূল থেকে কিছু কথা খেয়ে ফেলেছেন মানে গোপন করে ফেলেছেন। অর্থাৎ তিনি কেবল সহীহায়ন (বুখারী-মুসলিম) বলেছেন অথচ উসূলের মধ্যে সহীহায়নের সাথে شبههما (এ দুটির মত অন্যান্য) শব্দটিও রয়েছে। এই শব্দের মাধ্যমে উসূলবিদগণ সহীহায়নের সাথে অন্যান্য সহীহ হাদীসের কিতাব তথা সিহা সিত্তাকেও শামিল করেছেন যা ইমাম সুয়ূতী من الكتب الصحيحة (সহীহ হাদীসের অন্যান্য কিতাবসমূহ) বলে স্পষ্ট করে দিয়েছেন। দেখুন সুয়ূতী রচিত তাদরীবুর রাবী: ১/২৬৪।
কিন্তু তিনি এ শব্দটি অনুবাদ করেননি যাতে করে আমাদের হাদীসটাকে দুর্বল প্রমাণিত করতে পারে। কিন্তু জালিয়াতের জালিয়াতি ধরার লোকও যে রয়েছে তা হয়তো সে জানে না।
যাই হোক, ‘মুদাল্লিস রাবী’ ‘মুদাল্লিস রাবী’ করে চেঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে লাভ নেই। কারণ উসূলমতে বুখারী-মুসলিম এবং সুনানে নাসাঈ ইত্যাদির মতো সহীহ হাদীসের কিতাবসমূহে মুদাল্লিস রাবীর ‘আন’যুক্ত হাদীস গ্রহণযোগ্য। তার উপর সহীহ হাদীসের বিবেচনায় সুনানে নাসাঈ গ্রন্থটি হচ্ছে সিহা-সিত্তার তৃতীয় গ্রন্থ। ঐতিহাসিক মতে এবং অধিকাংশ হাদীস বিশারদ এর মতে বুখারী মুসলিমের পরেই সহীহ হাদীসের গ্রন্থ হিসেবে সুনানে নাসাঈর অবস্থান।
.
📒 দ্বিতীয় অভিযোগ
হাদীসটির সনদে শু’বাহ হবে না বরং শু’বাহ এর স্থানে ‘সা’ঈদ ইবনে আবু আরূবাহ’ হবে। এটা পাণ্ডুলিপির ভুল। আর সা’ঈদও মুুদাল্লিস রাবী।
📗 জবাব —১
এটি কেবল ধারণা মাত্র, কখনোই অকাট্যভাবে প্রমাণিত নয়। কেবল অমুক অমুক কিতাবে এ হাদীসটি সা’ঈদ থেকে বর্ণিত এ কারণে এখানেও সা’ঈদ হবে এটা নিতান্ত মূর্খতা ও অহেতুক দাবি। এমন অদ্ভুত ও হাস্যকর দাবি ইতিপূর্বে কেউ করেওনি। এমনকি আলবানী সাহেবও এই হাদীসের উপর সহীহের হুকুম লাগিয়েছেন তিনিও এমন কোনো অদ্ভুত ও মূর্খতাসূলভ দাবি করেননি।
তাছাড়া শু’বাহ থেকেও ইবনে ‘আদীর শ্রবণ প্রমাণিত। এবং তিনি শু’বাহ থেকে অনেক হাদীস বর্ণনা করেছেন। আর এটাই সত্য যে এ হাদীসটিও তিনি শু’বাহ থেকে বর্ণনা করেছেন। এটিকে নিশ্চিতভাবে তখনই ভুল বলা যেতো যখন শু’বাহ থেকে ইবনে আদীর রেওয়ায়েত প্রমাণিত না হতো অথচ শু’বাহ থেকে তার হাদিস রেওয়ায়েত প্রমাণিত। দেখুন- সহীহ ইবনে খুজায়মাহ: ২৬৩৫, সুনানুল কুবরা: ১০৪২৮।
উপরের কথাগুলো তো কথার কথা বললাম। এবার দেখুন আসল জবাব
📗 জবাব —২
প্রথম কথা হচ্ছে, এমন আজগুবি অভিযোগ ইসলামী ইতিহাসে এই প্রথম! এর পূর্বে কোনো একজন ইমামও এমন অন্তঃসারশূন্য অভিযোগ করেনি। যেমনটা আমরা উপরেও বলেছি।
দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, এখানে শু’বাহ আছে, শু’বাহ-ই হবে কারণ, সাঈদ ইবনে আবু আরূবাহ থেকে বর্ণিত হাদীসটি শু’বাহ বর্ণিত ১০৮৫ নং হাদীসের ঠিক নিচেই ১০৮৬ নং-এ শোভা পাচ্ছে। দেখুন
حَدَّثَنا مُحَمَّدُ بْنُ المُثَنّى، قالَ: حَدَّثَنا عَبْدُ الأعْلى، قالَ: حَدَّثَنا سَعِيدٌ، عَنْ قَتادَةَ، عَنْ نَصْرِ بْنِ عاصِمٍ، عَنْ مالِكِ بْنِ الحُوَيْرِثِ، أنَّهُ رَأى النَّبِيَّ ﷺ رَفَعَ يَدَيْهِ، فَذَكَرَ مِثْلَهُ
অর্থাৎ একই হাদীস কাতাদা থেকে আলাদা আলাদা দুজন রাবী (শু’বাহ ও সাঈদ) উভয়েই বর্ণনা করেছেন! এবং ইমাম নাসাঈ উভয়ের বর্ণনাই পৃথকভাবে নিজের কিতাবে এনেছেন।
সুনানে নাসা’ঈতে যদি কেবল শু’বাহ থেকেই হাদীসটি বর্ণিত থাকতো তবে আমরা বুঝতাম যে ভুলে সাঈদের স্থানে শু’বাহ লেখা হয়েছে অথচ এখানে উভয় রাবী থেকেই আলাদা আলাদা দুটো হাদীস বর্ণিত রয়েছে।
এখন কেউ যদি বলে এই হাদীসটা অমুক অমুক কিতাবে অমুক রাবী থেকেই বর্ণিত আছে, তাই শু’বাহ থেকে বর্ণিত হতে পারে না- তবে আমরা এটা তার মূর্খতা ও ধূর্ততা ব্যতীত অন্য কিছু বিবেচনা করতে পারি না। তাছাড়া এই হাদিসটি সাঈদ থেকেও বর্ণিত হয়েছে সেটাকেও তো অস্বীকার করা হচ্ছে না। সেটা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি, জাহিলদের বলা লাগবে কেন!
মূলত জাহিলদের এই প্রতারণার পিছনে একটাই উদ্দেশ্য, তা হচ্ছে, হাদীসটি যদি শু’বাহ থেকে প্রমাণিত হয়ে যায় তাহলে তাদের নির্লজ্জ প্রতারণা সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করতে সফলকাম হবে না। কারণ, একটা উসুল রয়েছে, তা হচ্ছে ইমাম শু’বাহ যদি কোন মুদাল্লিস রাবী থেকে বিশেষ করে কাতাদা থেকে বর্ণনা করে তবে সর্বাবস্থায় তা সহীহ বলে বিবেচিত, এমনকি মুআনআন হলেও। আসুন উসুলটি পড়ে নিই-
وقال شعبة كفيتكم تدليس ثلاثة: قتادة، وأبي إسحاق، والأعمش. فإن وجدنا قتادة يروي عنه شعبة فلا ننظر في عنعنته سواء في الصحيحين أو في غير الصحيحين.
আমিরুল মু’মিনীন ফিল হাদিস ইমাম শু’বাহ বলেন- আমি তোমাদের জন্য তিন ব্যক্তির তাদলীস যথেষ্ট (গ্রহণযোগ্য) মনে করি, কাতাদাহ, আবু ইসহাক ও আ’মাশ। (লেখক বলেন) অতএব আমরা যখন ইমাম শু’বাহকে কাতাদাহ থেকে বর্ণনা করতে দেখি তখন আমরা কাতাদাহ’র আনআনাহ এর প্রতি দৃষ্টিপাত করি না- হোক সহীহায়নের মধ্যে বা সহীহায়নে বাইরের কিতাবসমূহের মধ্যে। [শরহু কিতাবিত তাদলীস: ৪/৫]
তাদের অভিযোগ ছিলো, কাতাদাহ মুদাল্লিস রাবী। আর মুদাল্লিস রাবীর মুআনআন হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু এই উসূলের মাধ্যমে সমস্ত অভিযোগের জবাব হয়ে গেছে। কারণ, কাতাদাহ থেকে বর্ণনা করেছেন ইমাম শু’বাহ, আর যখন কতাদাহ থেকে শু’বাহ বর্ণনা করেন, তখন মুআনআন হোক বা যা-ই হোক তাতে কিছু যায় আসে না, বরং সর্ব অবস্থায় সহীহ বলে বিবেচিত- বুখারী মুসলিমের হাদীস হলেও সহীহ, বুখারী মুসলিম ছাড়া অন্যান্য গ্রন্থের হাদীস হলেও সহীহ।
অতএব প্রতারণাকারীরা কি একটু হলেও লজ্জাবোধ করবেন!
আর যদি কিছুক্ষণের জন্য মেনেও নিই যে তিনি সাঈদ ইবনে আবু আরূবাহ, আর তিনি হচ্ছেন মুদাল্লিস রাবী। তবে এর উত্তরও উপরে চলে গিয়েছে।
📗 জবাব —৩
তিনি মুদাল্লিস রাবী হলেও কোন সমস্যা নেই- যতক্ষণ পর্যন্ত না তার থেকে তাদলীস প্রমাণিত হবে। আর এই হাদীসে সাঈদ ইবনে আবু আরূবাহ ও কাতাদা, এ দু’জন রাবীর কারো থেকেই কোনো প্রকারের তাদলীস প্রমাণিত হয়নি অর্থাৎ তাদলীস ঘটেইনি। এটা কীভাবে জানা গেলো? আসুন জেনে নিই-
প্রসঙ্গত: মুদাল্লিস রাবী বলা হয় এমন রাবীকে, যিনি কখনো সখনো বা অধিকহারে কোনো রাবী থেকে সরাসরি না শুনেও এমন শব্দে হাদীস বর্ণনা করেন, বাহ্যিকভাবে মনে হয় তিনি তার থেকে শুনেছেন, অথচ বাস্তবে তিনি শোনেননি।
মুদাল্লিস রাবী সবসময় এমন করেন ব্যাপারটি তেমন নয়। কারণ তিনি অনেক রাবী থেকে সরাসরিও শুনে থাকেন, যেমন নিজের শায়খগণ থেকে সরাসরি হাদীস শুনে থাকেন। তাঁর শায়খগণ থেকে হাদীস শুনেছেন এটা তো নিশ্চিত বিষয়, যদি হাদীস শুনে না থাকবেন তবে তাঁর শায়খ কীভাবে হবেন। এক্ষেত্রে তাদলীসের সম্ভাবনা অবাস্তব।
তো এই হিসেবে মুদাল্লিস রাবীর হাদীস দুই প্রকার:
১. সুনির্দিষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে পূর্বের রাবী থেকে তার শ্রবন প্রমাণিত। যেমন: যখন রাবী তাঁর শায়খ থেকে বর্ণনা করেন।
২. সুনির্দিষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে পূর্বের রাবী থেকে তার শ্রবন প্রমাণিত নয়। যেমন: যখন রাবী তাঁর শায়খ ব্যতীত সমকালীন কারো থেকে বর্ণনা করেন যার সাথে তাঁর দেখা হয়নি বা দেখা হয়েছে কিন্তু শ্রবণ হয়নি।
তো প্রথম প্রকার তো নিঃসন্দেহে গ্রহণযোগ্য, কারণ এই প্রকারে তো তাদলীস পাওয়াই যায় না। বরং অন্যান্য সিকাহ রাবীর মতো তিনি তাঁর শায়খ থেকে সরাসরি থেকে বর্ণনা করেছেন। তাদলীস তো তখন হবে যখন তিনি পূর্বের রাবী থেকে শ্রবণ না করেও এমন ভাবে বর্ণনা করবেন যে মনে হবে তিনি তার থেকে শ্রবণ করেছেন। অথচ এই হাদীসে তিনি সরাসরি তাঁর শায়খ থেকেই বর্ণনা করেছেন।
তো আমাদের আলোচ্য হাদীসটিও প্রথম প্রকারের: কারণ সা’ঈদ ইবনে আরূবাহ হাদীসটি সরাসরি তাঁর শায়খ কাতাদা থেকেই বর্ণনা করেছেন। আর তাঁর শায়খ থেকে তাঁর শ্রবন সুনিশ্চিত। দেখুন- সিয়ারু আ’লামিন নুবালা: ৬/৪১৩।
একই কথা কাতাদাহ’র ক্ষেত্রেও, কারণ তিনিও হাদীসটি তাঁর শায়খ থেকে সরাসরি বর্ণনা করেছেন। এখানেও তাদলীসের কোনো সম্ভাবনা নেই। সুতরাং এই হাদিসের ক্ষেত্রে তাদলীসের নাম গন্ধও নেই। অথচ মুহাদ্দিসগণ একটা হাদীসকে মুদাল্লাসের হুকুম তখন লাগান যখন রাবীদের মধ্যে শ্রবণ প্রমাণিত হয় না অথচ এখানে উভয় মুদাল্লিস রাবী ক্ষেত্রেই তাদের শায়খ থেকে শ্রবণ প্রমাণিত।
আর মুদাল্লিস রাবীর হাদীস প্রত্যাখ্যান করা হয় পূর্বের রাবী থেকে শ্রবণ না থাকায় সন্দেহের কারণে। এখানে যেহেতু সন্দেহই নেই সেহেতু এমন হাদীস মুত্বলাকান গ্রহণযোগ্য। যেখানে ইল্লতই নেই সেখানে মা’লূল কোত্থেকে আসবে?
📗সারকথা
রাবী ব্যক্তিগতভাবে মুদাল্লিস হলেও তাঁর হাদীসটি মুদাল্লাস নয়, মুদাল্লাস হাদীস বলা হয় যে হাদীসটি রাবী তার পূর্বের রাবী থেকে শুনবে না বরং তাদলীস করবে। কিন্তু এ হাদীসটি তিনি সরাসরি তাঁর শায়খ থেকে শুনেছেন।
আর ইসলামের ইতিহাসে এই হাদীসকে কোনো ইমাম মুদাল্লাস বলেওনি। কারণ তাঁরা ইলমে হাদীসের উসূল সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত ছিলেন। তাছাড়া কোনো লা-মাযহাবী গণমুকাল্লিদরাও এই হাদীসকে মুদাল্লাস প্রমাণ করতে পারেনি, কখনো পারবেও না।
অভিযোগকারীকে দেখলাম এ দু’জন রাবীকে মুদাল্লিস প্রমাণ করার খুব প্রচেষ্টা চালিয়েছে কিন্তু আমি বুঝলাম না, রাবীকে মুদাল্লিস প্রমাণ করে লাভ কী যদি নির্দিষ্ট হাদীসের ক্ষেত্রে তাঁদের থেকে তাদলীস প্রমাণ করতে না পারে!
এ কথাগুলো আমরা সা’ঈদ ইবনে আবু আরূবাহ’র আলোচনায় বললেও কাতাদার ক্ষেত্রেও একই উসূল, কারণ তিনিও সরাসরি তাঁর শায়খ থেকেই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ তাঁর শায়খ নাসর বিন আসিম থেকে কাতাদার তাদলীস প্রমাণিত নয়। সুতরাং এখানেও হাদীসটি তাদলীস থেকে মুক্ত। নাসর বিন নাসিম থেকে কাতাদার শ্রবণ সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত। যেমনটা আমরা উপরেও বলে এসেছি। দেখুন-[আস-সিকাত —ইবনু হিব্বান: ৫/৪৭৫, মা’রিফাতুস সাহাবাহ]
📗 জবাব —৪
তৃতীয় জবাবটি বেশ চমৎকার: তা হচ্ছে সা’ঈদ ইবনে আবু আরূবাহ দ্বিতীয় তবকার মুদাল্লিস রাবী। দেখুন- আত তাদলীস ওয়াল মুদাল্লিসূন-৩১। আর অধিকাংশ মুহাদ্দিসের উসূল হচ্ছে, দ্বিতীয় তবকার মুদাল্লিস রাবীর হাদীস গ্রহণযোগ্য। দেখুন- [শরহু নুখবাহ —খুজায়ের: ৬/৯। শরহুল-লু’লু’ আল-মাকনূন: ১৩/৫]
সালাফী শায়খ বিন বায এর বিশিষ্ট ছাত্র শায়খ আব্দুল করিম খুজায়ের বলেন-
وقع في التدليس أئمة كبار، الحافظ ابن حجر قسم المدلسين إلى خمس طبقات: من لم يوصف بذلك إلا نادرا، يعني حصل منه مرة أو مرتين كيحيى بن سعيد الأنصاري، الثانية: من احتمل الأئمة تدليسه وأخرجوا له في الصحيح لإمامته وقلة تدليسه كالثوري، أو لكونه لا يدلس إلا عن ثقة كابن عيينة، الطبقة الأولى والثانية ما فيها إشكال، يروى عنهم بأي صيغة كانت؛ لأن الأئمة احتملوا تدليسهم، الكلام على الطبقة الثالثة فما دون
বড় বড় ইমামগণও তাদলীসে পতিত হয়েছেন। হাফেয ইবনে হাজার মুদাল্লিস রাবীদের পাঁচটি তবকায় বিন্যস্ত করেছেন।
প্রথম. যারা কেবল অল্প কিছু হাদীসে তাদলীস করেছেন, অর্থাৎ তাদের থেকে জীবনে একবার কিবা দুইবার তাদলীস সাব্যস্ত হয়েছে। যেমন ইয়াহয়া ইবনে সা’ঈদ আনসারী।
দ্বিতীয়. ঐ সমস্ত ইমামগণ যাদের তাদলীস গ্রহণ করে নেওয়া হয়েছে। এবং সহীহ হাদীসের গ্রন্থসমূহে তাদের হাদীসসমূহ নেওয়া হয়েছে তাদের ইমামতের কারণে অথবা তাদের তাদলীসের সংখ্যা স্বল্পতার কারণে, যেমন সুফিয়ান সাওরী, অথবা এ কারণে যে তারা সিকাহ রাবী ব্যতীত কারো থেকে তাদলীস করতেন না, যেমন সুফিয়ান ইবনে উয়ায়নাহ।
প্রথম তবকা ও দ্বিতীয় তবকা নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। তাদের থেকে যেকোনো শব্দে হাদীস বর্ণনা করা যাবে। কারণ ইমামগণ তাদের তাদলীস গ্রহণ করে নিয়েছেন। আলোচনার বিষয় হচ্ছে তৃতীয় অথবা তার নিচের তবকাগুলো নিয়ে। [শরহু নুখবাহ —খুজায়ের: ৬/৯]
লেখক তাঁর শরহুল-লু’লু’ আল-মাকনূন গ্রন্থেও বলেন-
ما حكم رواية المدلِس؟ لا بد أن نعرف طبقات المدلسين قبل حكم رواية المدلس، قسموا المدلسين إلى خمس طبقات، منهم ما لا يدلس إلا نادراً، هذا اغتفر الأئمة تدليسه فيقبل خبره مطلقاً، ومنهم من أغتفر تدليسه لإمامته
মুদাল্লিস রাবীর রেওয়াতের হুকুম কী? মুদাল্লিস রাবীর রেওয়াতের হুকুম জানার আগে আমাদেরকে মুদাল্লিসের রাবীদের তবকা জানতে হবে। ইমামগণ মুদাল্লিস রাবীর পাঁচটি স্তর ভাগ করেছেন।
১. এমন মুদাল্লিস রাবী, যারা সামান্য কিছু হাদীস ব্যতীত তাদলীস করেননি। এ স্তরের মুদাল্লিস রাবীদের তাদলীস ইমামগণ মাফ করে দিয়েছেন/ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখেছেন। অতএব তাদের হাদীসসমূহ মুত্বলাকান গ্রহণ করা হবে।
২. এমন মুদাল্লিস রাবী যাদের তাদলীস ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে তাদের ইমামত বা ইমাম হওয়ার কারণে। [শরহুল-লু’লু’ আল-মাকনূন: ১৩/৫]
আর আমাদের আলোচ্য রাবী সাঈদ ইবনে আবু আরূবাহও সকল মুহাদ্দিসের ঐকমত্যে দ্বিতীয় তবকার মুদাল্লিস। অতএব তিনি উসূলের ভিত্তিতেই এসব আলোচনার বাইরে। তাঁর হাদীসকে মুদাল্লিস রাবীর অজুহাতে তারাই অস্বীকার করতে পারে যাদের ইলমে হাদীস সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞানও নেই।
📗 জবাব —৫ [সবিশেষ প্রনিধানযোগ্য]
ইমামতের কারণে যাদের তাদলীস গ্ৰহণযোগ্য
من احتمل الأئمة تدليسه وأخرجوا له في الصحيح لإمامته
ঐ সমস্ত ইমামগণ যাদের তাদলীস গ্রহণ করে নেওয়া হয়েছে। এবং সহীহ হাদীসের গ্রন্থসমূহে তাদের হাদীসসমূহ নেওয়া হয়েছে তাদের ইমামতের কারণে…। [শরহু নুখবাহ —খুজায়ের: ৬/৯]
ومنهم من أغتفر تدليسه لإمامته
কিছু মুদাল্লিস রাবী এমন রয়েছেন, যাদের তাদলীস তাদের ইমামতের কারণে মাফ করে দেওয়া হয়েছে। [শারহুল-লু’লু’: ৫/১৩]
এবার সা’ঈদ ইবনে আবু আরূবাহ ইমাম ছিলেন কিনা দেখুন। হাফেয যাহাবী তাঁর ব্যাপারে বলেন-
سعيد بن أبي عروبة ، الإمام ، الحافظ عالم أهل البصرة ، وأول من صنف السنن النبوية واسع الحديث عالم فقيه كبير الشأن
সা’ঈদ ইবনে আবু আরূবাহ। তিনি ইমাম, হাফেযুল হাদীস, আহলে বসরার আলেম, এবং তিনিই সর্বপ্রথম সুন্নাতে নববীয়্যাহ’র উপর গ্রন্থ লিখেন। এবং তিনি হাদিস সম্পর্কে অত্যন্ত প্রশস্ত জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন এবং তিনি ছিলেন মহান মর্যাদাবান ফকীহ। [সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৬/৪১৩ ও অন্যান্য]
এই কাতাদা এবং সা’ইদ ইবনে আবূ আরূবাহ কোন পর্যায়ের উঁচু মুহাদ্দিস ও হাফিযুল হাদীস এবং সিকাহ তা নিয়ে আরেক পর্বে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।
তাঁর ব্যাপারে অন্যান্য মুহাদ্দিসগনের মন্তব্য- দারাকুতনীসহ সকল মুহাদ্দিসগণই বলেন-
هو ثقة أحفظ أهل زمانه و أحفظهم عن قتادة
তিনি সিকাহ। তিনি স্বীয় জামানার সবচেয়ে বড় মুখস্থশক্তির অধিকারী/হাফেয। এবং তিনি কাতাদার হাদীস সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জ্ঞাত/সংরক্ষণকারী ছিলেন। দেখুন-[সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৬/৪১৩]
অতএব দলীলাদির ভিত্তিতে প্রমাণিত হলো যে, সাঈদ ইবনে আবু আরূবাহ’র তাদলীস সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণযোগ্য, এবং সিহা-সিত্তার ক্ষেত্রে কাতাদার তাদলীসও গ্রহণযোগ্য। যদিও মূলত এই হাদীসে কাতাদা এবং সা’ঈদ ইবনে আবূ আরূবাহ’র বর্ণনায় কারো থেকে তাদলীস ঘটেইনি। এই কারণেই কোনো মুহাদ্দিস এই হাদীসের উপর তাদলীসের অভিযোগ আরোপ করেননি।
📗 জবাব —৬
৬ষ্ঠ জবাবটি আরও মনোহর। এই সা’ঈদ ইবনে আবু আরূবাহ’র হাদীস গ্রহণযোগ্য হওয়ার ব্যাপারে অন্যতম হাদীস বিশারদ শায়খ রবী শাহাতাহ ‘আত-তাদলীস ইনদা সা’ঈদ ইবনে আবু আরূবাহ’ নামে আলাদা একটা পুস্তিকাও রচনা করা করেছেন। তিনি লিখেন-
ولم يؤثر تدليس على مروياته قبولا وردا لان سعيد بن ابي عروبة من المرتبة الثانية كما ذكره بذالك الحافظ ابن حجر وهو ممن اغتفر تدليسه
সা’ঈদ ইবনে আবু আরূবাহ’র তাদলীস তার রেওয়ায়েতসমূহে কোনো ধরনের প্রভাব ফেলবে না। কেননা সা’ঈদ ইবনে আবু আরূবাহ দ্বিতীয় তবকার মুদাল্লিস- যেমনটা হাফিজ ইবনে হাজার বলেছেন। এবং তিনি হচ্ছেন ঐ সকল রাবীদের অন্তর্ভুক্ত যাদের তাদলীস মাফ করে দেওয়া হয়েছে। [আত-তাদলীস ইনদা সাঈদ ইবনে আবু আরূবাহ: পৃষ্ঠা-৯]
📗 একটি প্রশ্নের উত্তর
এই হাদীসের ক্ষেত্রে তাদের থেকে তাদলীস ঘটেইনি তাহলে “তাদের তাদলীস গ্রহণযোগ্য” এ সমস্ত কথা বলার প্রয়োজন কেন হল?
এত কথা বলার প্রয়োজন ছিলো না তবুও বর্তমান যুগ যেহেতু মূর্খতার যুগ, লা-মাযহাবদের একটু উসূল আর রেফারেন্স দেখলেই মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে যায়। তাই কষ্ট হলেও বিস্তারিত আলোচনা করলাম। যাতে করে তারা মানুষকে কোনওভাবেই বিভ্রান্ত করতে না পারে।
আল্লাহ তাদেরকে হেদায়েত দান করুন যারা মানুষদেরকে বিভ্রান্ত করে। তাদেরকে সঠিক পথে অবিচল রাখুন, যারা সব সময় মিথ্যার মুখোশ উন্মোচন করে।
লুবাব হাসান সাফওয়ান
ছাত্র: ইফতা ওয়াল হাদীস
আরো পড়ুন-
- আহলে হাদিস কারা
- আহমদ ইবনে হাম্বল (রাঃ) এর জীবনী
- সীরাত গ্রন্থ পরিচিতি
- আসমানী কিতাবসমূহ
- ফেরেশতাগণের পরিচয়