অণুগল্প : বিরহ বিষাদ। লেখিকা : সুমাইয়া আক্তার বৃষ্টি

0

স্রোতস্বিনী নদীর পানিতে পা ভিজিয়ে একা একা স্মৃতিচারণ করছি। দীর্ঘ তিন বছর পর এলাম এখানে। আগে প্রায় প্রতিদিন’ই আসা হতো। তবে তখন সাথে প্রিয় মানুষটা থাকতো। অথচ আজ তার কোনো খুজ খবর নেই। সে কোথায় আছে, কেমন আছে, বিয়ে করেছে কিনা তা আমি জানি না। এমনকি এটাও জানি না সে বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে। এদিকে তাকে ভালোবেসে এখনো আমি কাউকে নিজের জীবনের সাথে জড়াতে পারি নি।

তিন বছর আগে-

অনেক্ষণ যাবত স্রোতস্বিনী নদীর তীরে বসে আছি। বসে আছি বললে ভুল হবে। আমার প্রেমিক স্তব্ধের জন্য অপেক্ষা করছি। স্তব্ধ বরাবরই দেড়িতে আসে। যেখানে সব জায়গায় প্রেমিকা দেড়ি করে আসে সেখানে আমার ক্ষেত্রে হয়েছে তার উলটো। আজ আসুক এর একটা বিহিত করেই ছাড়বো।

“সরি সরি, একটু দেড়ি হয়ে গেলো। আসলে যে জ্যাম বুঝলে! গাড়ি চলে কি চলে না এই অবস্থা।” হাপাতে-হাপাতে আমার পাশে বসে বললো স্তব্ধ।

“পুরো চল্লিশ মিনিট দেড়িকে একটু দেড়ি বলা হয়? কই আগে তো জানতাম না! আর তুমি যেই রাস্তা দিয়ে এসেছো সেই রাস্তায় জ্যামের কথা শুনলে লোকে হাসবে।”

“ইয়ে মানে সরি। আসলে একটু শপিংমলে গিয়েছিলাম।” মাথা চুলকে বললো স্তব্ধ।

এদিকে স্তব্ধের এই কথা শুনে আমি প্রচুর পরিমাণে রেগে গেলাম। আমি এখানে এতোক্ষণ যাবত অপেক্ষা করেছি আর সে নাকি শপিং করেছে। তাই রেগে গিয়ে বললা,”মানে কি স্তব্ধ? তুমি শপিং করবে আর আমি তোমার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করবো। তোমার কাছে কি আমার কোনো গুরুত্বই নেই?”

“আরে বাবা রাগ করছো কেন? তোমার জন্যই তো গিয়েছিলাম।”

“আমার জন্য?”

“হ্যাঁ, এসব ছাড়ো। এটা নিয়ে আর একটা কথাও জিজ্ঞেস করো না প্লিজ। প্রচুর গরম লাগছে একটু বাতাস করো তো।” বলে আমার ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে লাগলো স্তব্ধ। আমি কিছু বললাম না। গাল ফুলিয়ে বসে রইলাম। আর তা দেখে স্তব্ধ হেসে আমার নাক টেনে দিলো।

“আচ্ছা ম্যাডাম ভুল হয়ে গেছে। আর কখনো এমন হবে না প্রমিস।”

“তুমি প্রতিবারই এমনটা বলো স্তব্ধ।”

“পরের বার থেকে এমন হলে তুমি যা শাস্তি দিবে আমি সেটাই মাথা পেতে নিবো। আপাতত চলুন দুজনে এক প্লেট ফুসকা ভাগাভাগি করে খেয়ে দুজনের মধ্যকার ভালোবাসা বাড়াই।”

স্তব্ধের কথায় আমি হেসে দিলাম। তারপর দুজন মিলে এক প্লেট ফুসকা খেয়ে কিছুক্ষণ খুনসুটি করলাম। খানিক সময় বাদে স্তব্ধ আমাকে ওর মোটরসাইকেলে করে হোস্টেলের সামনে পৌছে দিলো। আমি হোস্টেলের ভিতরে যেতে নিলেই আমাকে থামিয়ে আমার হাতে একটা শপিং ব্যাগ ধরিয়ে দিলো। আর তা দেখেই আমি বুঝে গেলাম মানুষটা আমার জন্যই শপিংমলে গিয়েছিলো। কাল আবার স্তব্ধের জন্মদিন। আর আজকে ও আমাকে কিছু একটা গিফট করলো। সেটা ভেবেই বললাম,”জন্মদিন তোমার অথচ গিফট পাচ্ছি আমি! মন্দ নয় কিন্তু ব্যাপারটা কি বলো?”

“আমার জন্মদিনে আমি আমার প্রিয়সীকে আমার মনের মতো করে দেখতে চাই। আমি চাই কাল তুমি এই শুভ্র রঙের শাড়ি পড়ে হাতে রেশমি চুড়ি, কপালে ছোট্ট একটা টিপ, চোখে কাজল, ঠোঁটে হালকা রঙের লিপস্টিক আর খোলা চুলে আমার সাথে নদীর পাড়ে বসে আমার কাধে মাথা রাখবে। তোমার হাতের আঙুলের ভাজে আমার হাতের আঙুল থাকবে। নদীর পাড়ের ওই হাওয়া তোমার খোলা চুল এলোমেলো করে দিবে আর আমি তা আলতো হাতে ঠিক করে দিবো।” ফিসফিস স্বরে বললো স্তব্ধ।

“বাব্বাহ! সাহেব তো দেখা যাচ্ছে বড্ড রোমান্টিক মুডে আছেন?”

“তোমার মতো একটা প্রেমিকা থাকলে রোমান্টিক না হয়ে উপায় আছে কি?”

“হয়েছে, আর এতো ঢপ দিতে হবে না। আমি কালকে শুধু মাত্র তোমার জন্য সাজবো, একদম তুমি যেমনটা চাও ঠিক তেমন ভাবেই।”

“আমি অপেক্ষায় থাকবো।”

তারপর আমি মুচকি হেসে চলে এলাম হোস্টেলের ভিতরে।
পরের দিন বিকেলে স্তব্ধের কথা মতোই নিজেকে সাজালাম। শুভ্র শাড়ি, রেশমি চুড়ি, কপালে ছোট্ট টিপ, চোখে কাজল, হালকা রঙের গোলাপি লিপস্টিক আর খোলা চুল। তৈরী হয়ে নিজেকে একবার আয়নায় দেখে নিলাম। মন্দ লাগছে না। বরং প্রতিদিনের তুলনায় অনেক বেশি সুন্দর লাগছে আজকে। নিজেকে দেখে নিজেই লজ্জা পাচ্ছি। আর তা দেখে আমার রুমমেট নীলা আমাকে বললো,”তা নূহা জানু ব্যাপার কি? স্তব্ধ ভাইয়াকে কি আজকে একদম পাগল করে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিস নাকি? না মানে তোকে এই রূপে দেখলে স্তব্ধ ভাইয়া আজকে নির্ঘাত জ্ঞান হারাবে।”

“যাহ তো! কি উলটোপালটা কথা বলছিস?”

“ওমা উলটোপালটা কথা বলতে যাবো কেন? যা সত্যি তাই বলছি। আমি মেয়ে হয়েই তো তোর উপর ক্রাস খেয়ে গেলাম রে। আর সেখানে স্তব্ধ ভাইয়া তো আগে থেকেই তোর জন্য পাগল।”

আমি নীলার কথার কোনো প্রতিত্তোর করলাম না। মুচকি হেসে বেড়িয়ে পড়লাম। নদীর পাড়ে পৌছে অপেক্ষা করতে লাগলাম স্তব্ধের। আর এই মহাশয় তো আজকেও দেড়ি করছে।

প্রায় ত্রিশ মিনিট হয়ে গেলো তবে স্তব্ধের কোনো দেখা পেলাম না। ম্যাসেজ দিলাম, কল করলাম। কিন্তু কোনো রেসপন্স পেলাম না। ঘড়ির কাটা টিকটিক করে চলতে চলতে এক ঘন্টা পার হয়ে গেলো। তবুও স্তব্ধ এলো না। এখন বড্ড কান্না পাচ্ছে। চোখে পানি টলমল করছে। স্তব্ধ কেন আসছে না? কালই তো প্রমিস করেছিলো যে আর দেড়ি হবে না। অথচ আজই নিজের কথা রাখতে পারলো না। দেড়ি হবে ভালো কথা একবার কি আমার ম্যাসেজ বা কলের রেসপন্স করা যায় না? আজ আসুক, একদম কথা বলবো না।
কিন্তু আজ আর স্তব্ধ এলো না। আমার বারবার মনে হয়েছে এই বুঝি স্তব্ধ এলো। এসে আমার চোখে ছড়িয়ে যাওয়া কাজল টিস্যু দিয়ে মুছে দিয়ে বললো,”দূর পাগলি, কেউ বাচ্চাদের মতো এভাবে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদে? চোখের কাজল ছড়িয়ে একদম পেত্নিদের মতো দেখাচ্ছে।”

কিন্তু যখন সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার পরেও স্তব্ধ এলো না তখন বুঝে নিলাম আজ আর আসবে না। হাতে থাকা গোলাপ ফুলটি এতোক্ষণে নেতিয়ে পড়েছে। এই ফুলটি দিয়ে স্তব্ধকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাবো ভেবেছিলাম। কিন্তু তা আর হলো না।

সেদিন কাঁদতে কাঁদতে হোস্টেলে ফিরেছিলাম। এর পর কিভাবে যেনো পুরো তিন তিনটে বছর কেটে গেলো। অথচ এখনো আমি স্তব্ধের দেখা পেলাম না। সেদিনের পর থেকে যতোবারই স্তব্ধের নম্বরে ডায়াল করেছি ঠিক ততোবারই এক মহিলা মিহি কন্ঠে বলেছে,”আপনি যেই নম্বরে ডায়াল করেছেন সেই নম্বরটি এই মূহুর্তে বন্ধ আছে। অনুগ্রহ করে একটু পরে আবার ডায়াল করুন। ধন্যবাদ।” মহিলাটির গলার স্বর যথেষ্ট পরিমাণে মিস্টি হলেও আমার কাছে অনেক বেশি তেতো লেগেছে। সাথে স্তব্ধের প্রতি দিন দিন অভিমানের পাহাড় জমতে শুরু করেছে। কি এমন ঘটেছে যার জন্য স্তব্ধ আমাকে না জানিয়েই হারিয়ে গেলো? এর উত্তর আজও মেলে নি। তবে কি আমাদের দুবছরের সম্পর্কের পরিণতি এমন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে? ভাগ্যে কি এটাই লিখা ছিলো?

অতীত ভেবে এখন আর কান্না পায় না। তবে ক্রন্দন শ্বাস ঠিকই বেড়িয়ে আছে। এসব ভেবেই আনমনে হেসে উঠলাম। তারপর অদূর পানে তাকিয়ে বিরবির করে বললাম,”তোমার বিরহে আমি বিষাদের সাগরে ডুবেছি। তোমার অপেক্ষায় আমি নিজেকে হারিয়েছি। বেঁচে তো আছি তবে প্রাণ নেই। শুধু দেহ খানি’ই বেঁচে আছে। মন তো সেই কবেই মরে গেছে।”

~সমাপ্ত

 


Screenshot 3
বিজ্ঞাপনঃ বই কিনুন, বই পড়ুন

0

Sumaiya Akter Bristy

Author: Sumaiya Akter Bristy

❝শুভ্রচিন্তার উদ্ভব ঘটে যার কথা ভেবে সে যদি মোহ হয় দোষ বা কি তাতে?❞ ~Sumaiya Akter Bristy

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

গল্প চেয়ারম্যানের মেয়ে আফছানা খানম অথৈ

চেয়ারম্যানের মেয়ে আফছানা খানম অথৈ মেহেরপুর একটি সুন্দর গ্রাম।এই গ্রামে কিছু অদ্ভুত নিয়মকানুন চালু আছে,যা অন্যকোন গ্রামে নেই।এই গ্রামে নারীরা

গল্প মেয়েরা ও মানুষ আফছানা খানম অথৈ

গল্প মেয়েরা ও মানুষ আফছানা খানম অথৈ রানু বউ হয়ে এসেছে চার পাঁচ মাস হলো।এরই মধ্যে তার স্বামী স্কলারশিপ এর

গল্প মেয়ে সাক্ষী আফছানা খানম অথৈ

মেয়ে সাক্ষী আফছানা খানম অথৈ আবিদ হায়দার বেড়াতে এসেছে গ্রামে তার বন্ধু ফুয়াদ'র বাসায়।অবশ্য সে একা না,তার সঙ্গে আছে,বন্ধু সজল

গল্প বন্ধ্যা আফছানা খানম অথৈ

গল্প বন্ধ্যা আফছানা খানম অথৈ আলেয়া বউ হয়ে এসেছে চার বছর হলো।এখনো মা হতে পারেনি। এজন্য রীতিমতো তাকে কটু কথা

Leave a Reply