অপেক্ষা। পর্ব-০৪। লেখিকা : সুমাইয়া আক্তার বৃষ্টি

0

 

সকাল থেকেই আলো তাফীফকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। তবে তাফীফের দেখা আর পাচ্ছে না। স্কুলে যাওয়ার সময় ও আসার সময় বারবার আশেপাশে তাকিয়েছে আলো। কিন্তু তাফীফের দেখা মেলেনি। তাই মন খারাপ করে গালে হাত দিয়ে বাগানের সেই কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে বসে রইলো আলো। চারপাশে মৃদু হাওয়া বয়ে যাওয়ার কারনে আলোর উন্মুক্ত চুলগুলো বাতাসে উড়ছে কিছুটা। যা বারবার আলোর মুখে এসে বারি খাচ্ছে। একসময় আলো বিরক্ত হয়ে আলতো হাতে চুলগুলো হাত খোঁপা করে নিলো।

অপরদিকে দূর থেকে কোনো এক নাম না জানা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে কেউ একজন এসব কিছু ক্যামেরা বন্দি করছে। আলোর প্রতিটি কার্যকলাপ কারো ক্যামেরায় বন্দি হচ্ছে। অথচ আলো তা বুঝতেই পারলো না।

আলোর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে তাফীফের দেখা মিললো। গান গাইতে গাইতে এদিকেই আসছে তাফীফ।

❝পড়েনা চোখেব় পলক
কি তোমার রূপের ঝলক
দোহাই লাগে মুখটি তোমার
একটু আঁচলে ঢাকো
আমি জ্ঞান হারাবো
মরেই যাবো
বাঁচাতে পারবেনা কো❞

“কি তাফীফ ভাই! কাহিনি কি? মনে রঙ লাগছে নাকি?”

“আমার মনে রঙ লাগবো নাকি আলকাতরা লাগবো ওইডা আমার মনের ব্যাপার। তোরে কইতে যামু কেন? তোয় আর একবার তুই আমারে ভাই ডাইকা দেখ খালি।”

“কেন ভাই ডাকলে কি করবি তুই? আর তোরে আমি ডরাই নাকি? তাফীফ ভাইইইইইইই।”

আলো আবারো ভাই ডাকটা অনেকটা টেনে বললো। তাফীফ এবার কিছুক্ষণ চুপ করে আলোর দিকে সন্দিহান নজরে তাকিয়ে রইলো। তারপর চোখ যুগল ছোট ছোট করে বলতে শুরু করলো-

“এইসব নাটক বাদ দিয়া আসল কথা ক।”

“কিয়ের আসল কথা ভাইইইইই?”

“আমি কাউরে মেলাই নিয়া যাইতে পারমু না।”

আলো কিছুটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,”এই তুই বুঝলি কেমনে আমি তোরে মেলায় নিয়া যাইতে কমু?”

“আমি তোরে হারে হারে চিনি আলো।”

তাফীফের প্রতিউত্তরে আলো মুখে ভেংচি কাটলো। যা দেখে তাফীফ নিরবে হেসে উঠলো।

এক মাস পর আলোর এসএসসি পরীক্ষা। তাই জহির রায়হান আলোকে আজকাল চোখে চোখে রাখেন। নিজে আলোর থেকে পড়া আদায় করে নেন। এদিকে বাহিরে খেলতে যেতে না পারার বিরহে আলোর নিজেকে অসহায় এক নারী বলে মনে হচ্ছে। মাঝে মাঝে ঠোঁট উল্টিয়ে গাল ফুলিয়ে অনিহা নিয়েই পড়া মুখস্থ করে যাচ্ছে। একটু পরে জহির রায়হান বাজারের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যেতেই তাফীফ আলোর জানালায় এসে দাঁড়ায়। আর দেখতে পায় আলো ঠোঁট উল্টিয়ে গাল ফুলিয়ে বাচ্চাদের মতো করে পড়ছে। আলোকে ক্ষেপানোর উদ্দেশ্যে তাফীফ বলতে শুরু করলো,”আহারে মাইয়াডা এতো কষ্ট কইরা পড়তাছে। কিন্তু কি লাভ? শেষে তো ওই বুইড়া, টাকলা, ভুড়িওয়ালা জামাই’ই কপালে জুটবো। তারপর ওই জামাই নিয়ে তুই টুনাটুনির সংসার করবো।”

তাফীফের কন্ঠস্বর পেয়ে আলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য তাফীফের দিকে তাকিয়ে ছিলো। তারপর আবার নিজের বইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,”যা তো এনতে। ঝগড়া করার ইচ্ছা নাই। মেলা পড়া বাকি।”

“পড় পড়। যদি ফেইল ঠেকাইতে পারছ তাইলে অন্তত চাচার মান-সম্মানডা একটু হইলেও থাকবো।”

এবার আলো খানিকটা ক্রোধ মিশ্রিত স্বরে তাফীফের দিকে তাকিয়ে বললো,”আমি কি তোর মতো ফেইল্টুস পোলাপান যে ফেইল করমু?”

“এমা! ছিহ! ছিহ আলো! তুই দেহা যায় আমার মত নিরীহ এক অবলা প্রানীর উপর মিছা দোষ দিতাছোছ!”

“তো তুই কি মনে করছোছ? তুই যে মেট্টিক ফেইল ওইডা আমি জানি না?”

চুরি ধরা পেরে গেছে বুঝতে পেরে তাফীফ মেকি হেসে বললো,”পড়, পড় তুই। আমি যাই হ্যাঁ? ভালো মতো পরিছ কইলাম। নয়লে চাচার কাছে বিচার দিমু তুই পড়ালেহা বাদ দিয়া আমার লগে গপ্প করছ।”

আলো প্রতিউত্তরে শুধু তাফীফের দিকে ক্রোধান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।

অনেক বেশি গরম পরায় আলো আজকে নিজের রুমের জনালা খুলে ঘুমিয়েছে। জানালার পাশ ঘেষেই আলোর খাট। যার ফলে চাঁদের আলো তীর্যক ভাবে এসে আলোর মুখে পড়েছে। হালকা বাতাসে আলোর চুলগুলো মৃদু নড়াচড়া করছে। সামনে দিয়ে আবার কিছু ছোট চুল কপালের উপর দিয়ে চোখের উপর পড়ে আছে। আলোর সেদিকে হুশ নেই। আলোতো নিজের ঘুমে ব্যাস্ত। কিন্তু কেউ একজন এসে আলোর এই রুপ মুগ্ধতা নিয়ে দেখছে। হঠাৎ করে কি মনে করে যেনো আস্তেধীরে এক হাত আলোর দিকে বাড়িয়ে দিলো। আলোর চোখের উপর থেকে চুলগুলো যত্নসহকারে কানের পিছনে গুজে দিলো। তারপর অপর হাতে থাকা লাল বর্নের কৃষ্ণচূড়া ফুলটি আলতো হাতে আলোর কানে গুজে দিলো। এবার আলোর প্রতি মুগ্ধতা যেনো কয়েক গুন বেড়ে গেলো। লোকটি হালকা হেসে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেলো।

সকালে ফজরের আজান দিতেই আলো আড়মোড় ভেঙে উঠে বসলো। অবাধ্য চুলগুলোকে হাত দিয়ে সরাতে নিলেই বুঝতে পারলো কানে কিছু একটা আছে। কি সেটা দেখার জন্য যখন জিনিসটা হাতে নিলো তখন কৃষ্ণচূড়া ফুল দেখতে পেলো। যা অনেকটা নেতিয়ে পরেছে। আলো কিছুক্ষন তব্দা খেয়ে বসে রইলো। আলো ভাবছে ফুল এলো কি করে? সেটাও আবার কানে গুজা ছিলো। কে এসে দিয়ে গেলো এই ফুল? তাফীফ ছাড়া তো কেউ এদিকটায় আসে না। তাহলে কি তাফীফ!

তাফীফ নামটা মনে আসতেই আলোর ঠোঁট যুগল প্রসারিত হয়ে মুখে হাসি ফুটে উঠলো। লজ্জায় গাল দুটো ঈষৎ রক্তিম বর্ন ধারন করলো।

নামাজ শেষ করে আলো ফুলটাকে একটা পানির মগে রেখে দিলো। তারপর বই খাতা নিয়ে পড়তে বসলো। তার কিছুক্ষণ পরে বাহির থেকে জহির রায়হানের ডাক পড়তেই মাথায় ভালো করে উড়না দিয়ে আলো ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো। গিয়ে দেখলো জহির রায়হানের মুখোমুখি একজন লোক বসে আছে। বয়স সম্ভবত সাতাশ কি আঠাশ হবে। আলোর বিপরীতে মুখ করে বসে আছে বিধায় আলো মুখ দেখতে পারলো না। আলোকে দেখতে পেয়ে জহির রায়হান ইশারায় আলোকে কাছে ডাকলো আলোও গুটিগুটি পায়ে সেদিকটায় গিয়ে অচেনা লোকটিকে সালাম দিলো। লোকটি একবার আলোর দিকে তাকিয়ে সালামের জবাব দিলেন। তারপর জহির রায়হান আলোকে উদ্দেশ্য করে বললেন,”এই হলো আমার মেয়ে আলো। ছোট থাকতে একবার দেখেছো মনে আছে?”

“হ্যাঁ আংকেল। ওইযে আমি আর বাবা যখন আগের বার এসেছিলাম তখন এখানে সবার সমনে হঠাৎ করে যে কাদায় পড়ে গেলো?”

লোকটির কথায় জহির রায়হান উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। আর এদিকে লজ্জায় আলোর মরিমরি অবস্থা। অবশ্য এই অচেনা লোকটার প্রতি আলোর রাগও লাগছে। কি দরকার পুরোনো কথা মনে করিয়ে আলোকে এভাবে লজ্জায় ফেলার? তাই লোকটির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কিভাবে এর প্রতিশোধ তুলবে মনে মনে সেটার ছক কষে নিলো।

আলো সেখানে আর দাড়ালো না। রান্নাঘরে আমেনা বেগমের কাছে চলে গেলো। গিয়ে দেখলো আমেনা বেগম চা বানাচ্ছেন। তা দেখে আলো বাকা হেসে বললো,”আম্মা! তুমি ঘর থেইকা বিস্কুট নিয়া দেও। আমি চা নিয়া যাই।”

আমেনা বেগম একপলক আলোর দিকে তাকিয়ে বললেন,”ওইডাই চিনি দিয়া নাড়া শেষ। আর এইডায় চিনি দিছি তুই একটু নাইড়া দিয়া আয়।”

আলো হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াতেই আমেনা বেগম উঠে গেলেন। আমেনা বেগম রান্না ঘর থেকে বের হতেই আলো আবারো বাকা হাসলো। তারপর চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে লবনের কৌটা হাতে নিলো।গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে দু-তিন চামচ লবন চায়ের সাথে মিশিয়ে নিলো।

চলবে…..


Screenshot 3
বিজ্ঞাপনঃ বই কিনুন, বই পড়ুন

0

Sumaiya Akter Bristy

Author: Sumaiya Akter Bristy

❝শুভ্রচিন্তার উদ্ভব ঘটে যার কথা ভেবে সে যদি মোহ হয় দোষ বা কি তাতে?❞ ~Sumaiya Akter Bristy

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

গল্প চেয়ারম্যানের মেয়ে আফছানা খানম অথৈ

চেয়ারম্যানের মেয়ে আফছানা খানম অথৈ মেহেরপুর একটি সুন্দর গ্রাম।এই গ্রামে কিছু অদ্ভুত নিয়মকানুন চালু আছে,যা অন্যকোন গ্রামে নেই।এই গ্রামে নারীরা

গল্প মেয়েরা ও মানুষ আফছানা খানম অথৈ

গল্প মেয়েরা ও মানুষ আফছানা খানম অথৈ রানু বউ হয়ে এসেছে চার পাঁচ মাস হলো।এরই মধ্যে তার স্বামী স্কলারশিপ এর

গল্প মেয়ে সাক্ষী আফছানা খানম অথৈ

মেয়ে সাক্ষী আফছানা খানম অথৈ আবিদ হায়দার বেড়াতে এসেছে গ্রামে তার বন্ধু ফুয়াদ'র বাসায়।অবশ্য সে একা না,তার সঙ্গে আছে,বন্ধু সজল

গল্প বন্ধ্যা আফছানা খানম অথৈ

গল্প বন্ধ্যা আফছানা খানম অথৈ আলেয়া বউ হয়ে এসেছে চার বছর হলো।এখনো মা হতে পারেনি। এজন্য রীতিমতো তাকে কটু কথা

Leave a Reply