অপেক্ষা। পর্ব-০৫। সুমাইয়া আক্তার বৃষ্টি

0

 

আলো জহির রায়হানের পাশে দাঁড়িয়ে চাতক পাখির মতো অপেক্ষার প্রহর গুনছে। কখন এই অসভ্য লোকটি চায়ের কাপে চুমুক দিবে আর আলো নিজের প্রতিশোধে সাফল্য লাভ করবে এই আশায়। এর মাঝে জহির রায়হান বলতে লাগলেন,”ওহ হ্যাঁ আলো। এই হলো রোশান, রোশান সিকদার। আমার খুব কাছের বন্ধু নাসিম সিকদারের ছেলে। রোশান পড়ালেখায় অনেক ভালো, ওকালতি পড়ছে। কিছুদিনের জন্য গ্রামে ঘুরতে এসেছে। তাই আমি ভাবলাম যে কটা দিন রোশান এখানে আছে সে কটা দিন তোমাকে একটু পড়াটা দেখিয়ে দিবে।”

জহির রায়হানের মুখে এমন কথা শুনে আলো চোখ-মুখ কুচকে রোশানের দিকে তাকালো। আলোর কাছে এ কথাটা মোটেও ভালো লাগলো না। এদিকে চা মুখে নিতেই রোশানের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। এতো জঘন্য স্বাধের চা আজ পর্যন্ত কোথাও খেয়েছে বলে রোশানের মনে হচ্ছে না। সামনের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো আলো মিটিমিটি হাসছে। তা দেখে আর বুঝতে বাকি রইলো না এটা কার কাজ। এবার রোশান নিজেও আলোর দিকে তাকিয়ে আলোর মতো করে মিটিমিটি হাসতে লাগলো। তা দেখে আলোর হাসি থেমে গেলো। আলো মনে মনে ভাবতে লাগলো,”এই চা খেয়ে কি লোকটার মাথা গেলো নাকি?”

আলোর ভাবনার মাঝেই রোশান আলোকে উদ্দেশ্য করে বললো,”বাহ! চা’টা চমৎকার হয়েছে তো। আলো, চা’টা কি আপনি বানিয়েছেন?”

আলো রোশানের দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বললো,”না আম্মা বানিয়েছে। আমি শুধু চিনি মিশিয়েছি।”

রোশান চায়ের কাপে আবার চুমুক দিয়ে প্রফুল্লচিত্তে বললো,”একদম পারফেক্ট চিনি মিশিয়েছেন তো। সত্যি অসাধারণ হয়েছে।”

আলো কিছু বললো না। শুধু বড় বড় চোখ করে রোশানের খাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবছে,” লোকটা এমন জঘন্য চা খাচ্ছে কিভাবে? লোকটা কি পাগল?”

বাচ্চাদের সাথে কানামাছি খেলছে আলো। মূলত এরাই আলোর খেলার সাথী। আলোর চোখ বাধা ছিলো। বাচ্চারা একেক সময় একেকজন এসে আলোকে ছুয়ে দিয়ে যাচ্ছে। আর আলো তাদের ধরার চেষ্টা করছে। তখন সেখানে তাফীফ উপস্থিত হলো। ধীর পায়ে আলোর দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। আলোর খানিকটা সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসলো। আর বাচ্চাদের ইশারা করলো কেউ যেনো কিছু না বলে। তারপর আশেপাশে ভালো ভাবে তাকিয়ে দূরে একটা রশি দেখতে পেলো। সেটা দেখে তাফীফ কিছুটা বাকা হাসলো। তারপর রশিটা এনে আলোর গায়ে ফেলে জোরে জোরে চেঁচাতে লাগলো,”আলো সাপ সাপ। সইরা যা আলো। সাপ।”

আলো বেচারি রশিটাকে সত্যি সত্যিই সাপ ভেবে চিৎকারে দিয়ে কেঁদে উঠলো। আর বলতে লাগলো,”তাফীফের বাচ্চা সরা। তারাতারি সরা। ও আম্মা বাঁচাও আমারে। আব্বা দেখো তোমার মাইয়ারে সাপ মাইরা ফেললো। ও আল্লাহ!”

আলোর আহাজারি দেখে তাফীফ হেসে উঠলো। আর বললো,”আলো আমার মনে হইতাছে সাপটা তোরে অনেক বেশি পছন্দ করছে। এইজন্য তোর গলায় ঝুইল্লা পরছে।”

আলো আবারো কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলতে লাগলো,”তাফীফ তারাতারি সরা না সাপডা। সরাইতাছোছ না কেন?”

“সাপ আংকেল কইছে তোরে নাকি হেতের পছন্দ হইছে । আর আমারে হেতের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে না করছে।”

এদিকে বাচ্চারা খিলখিলিয়ে হেসে যাচ্ছে। এতোক্ষণে আলোর হুশ ফিরলো সাপ হলে বাচ্চারা কেনো হাসবে? আর তাফীফই’বা কেনো এসব উদ্ভট কথা বলবে? তাই কিছু একটা ভেবে ভয়ের সহিত চোখের বাধনটা খুলতেই আলো নিজের কাধে মোটা এক রশি দেখতে পেলো। যা দেখে আলোর সকল ভয় ক্রোধে রুপান্তর হলো। ক্রোধান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তাফীফের দিকে। তারপর কিছু একটা ভেবে আশেপাশে তাকাতে লাগলো। তাফীফ বুঝার চেষ্টা করছে আলোর প্রদক্ষেপ কি হতে পারে। হঠাৎ করে পাশ থেকে বেশ বড় একটা পাথর হাতে নিয়ে তাফীফের দিকে তেড়ে গেলো আলো। যা দেখে তাফীফ সাথে সাথে আলোর হাত ধরে ফেললো। আর শুধালো,”মাইরা ফেলবি নাকি?”

আলো প্রতিউত্তরে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,”হ মাইরা ফেলমু। তোর কোনো সমস্যা?”

“বাহ রে! আমারে মারতে চাস আর আমারেই জিগাস আমার কোনো সমস্যা নাকি?”

“হাত ছাড় তাফীফের বাচ্চা। আজকে যদি তোর মাথা না ফাটাইছি তাইলে আমার নামও আলো না।”

“এই এই আমার বাচ্চা পাইলি কই তুই? না মানে আমি তো আমার বউরেই খুইজা পাইলাম না আর তুই বাচ্চা পাইয়া গেছোস?”

“ছাড় কইতাছি, আমার হাত ছাড়। পরে তোরে তোর বউ বাচ্চা দেহাইতাছি আমি।” বলে আলো নিজের হাত ছাড়ানোর জন্য মোচড়ামুচড়ি করতে লাগলো। আর এসবের মাঝে সেখানে উপস্থিত হলো কুতুব মিয়া নামের গ্রামের এক বয়স্ক লোক। আলোর হাত তাফীফের হাতে দেখে নাক মুখ ছিটকে বলতে লাগলেন,”ছি,ছি,ছি,ছিহ! কি দিনকাল আয়লো। বিয়ার বয়সী দুইডা অবিয়াইত্তা পোলামাইয়া এই বাচ্চাডির সামনে নষ্টামি শুরু করছে।”

লোকটির কথা শুনে আলো আর তাফীফ দুজনের থেমে গেলো। তাফীফ আলোর হাত ছেড়ে কুতুব মিয়ার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো,”চাচা আপনে যা ভাবতাছেন তেমন কিছু না। আলো আমারে মারতে আয়ছিলো তাই আমি ওর হাতটা ধইরা আটকাইছিলাম। আর তহন’ই আপনে আয়ছেন।”

“তোর কাছে আমি কিছু জানতে চাইছি? আমার কি চোক্ষু নাই? আমি কি দেহি নাই কিছু? আর চোর কি কহনো চুরি কইরা কয় আমি চুরি করছি? এই গেরামে এগুলা কি হইতাছে মাবুদ! মাবুদ, এইদিনকাল দেহনের লাইজ্ঞাই বাচাই রাখছো আমারে? এই বাচ্চাগুলার সামনে ছিহ ছিহ! আমার কইতেও শরম করতাছে।”

তাফীফ একবার আলোর দিকে তাকালো। দেখলো আলো মাথা নিচু করে নিরবে চোখের পানি ফেলছে। এখন কিছু বললে ব্যাপারটা অনেক বেশি ঘোলাটে হয়ে যাবে সেটা ভেবেই তাফীফ নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে বললো,” চাচা, কোনো কিছু পুরাপুরি না দেইখা, না জাইনা কিছু কইতে হয় না। এইডা কি আপনে জানেন না?”

তাফীফের কথায় লোকটি ক্ষিপ্ত স্বরে বললো,”আমারে বুঝাস তুই? ভুইলা যাইস না আমি তোগো বয়স পার কইরা আয়ছি। আমার বয়স হইতে পারে কিন্তু চোক্ষের পাওয়ার এহনো কমে নাই। তোরা যেইহানে ইচ্ছা সেইহানে রঙ্গলীলা কইরা বেড়াবি আর আমি কইলেই দোষ? আর ওইডা জহির মাস্টারের মাইয়া না? দাঁড়া আইজাকাই ওই মাস্টারের কাছে যাইয়া হের মাইয়ার কুকীর্তি কতা জানাইতাছি আমি।”

তাফীফ এবার কিছুটা চটে গেলো। নিজেকে আর শান্ত করতে পারলো না। জোরে শ্বাস ফেলে বললো,”যে যেমন তার মনে হেইডাই লাফাইয়া উঠে। আপনে আমাগো বয়সে রঙ্গলীলা করছেন মানে এইডা না আপনের মতো সবাই।”

কুতুব মিয়া এবার পুরোপুরি ক্ষেপে গেলো। খারাপ ভাষায় আলোকে গালমন্দ করতে গেলেই তাফীফ চিৎকার দিয়ে বললো,”খবরদার চাচা। আলোরে নিয়ে একটাও বাজে কথা কইবেন না। তাইলে কিন্তু আমার থেইকা খারাপ আর কেউ হইবো না।”

“এই তুই আমারে ধমক দেস? কি করবি তুই? হ্যাঁ কি করবি? তোর ধমকানিরে আমি ডরাই? এই মাইয়া গেরামের পোলাগো লগে নষ্টামি করতে শরম করে না তোমার? তোমার বাপে তো ভালা মানুষ, তুমি এমন হইছো কেমনে? নাকি তোমার বাপে তোমারে এইগুলাই শিখায়?”

“চাচা আপনে কিন্তু এবার বাড়াবাড়ি করতাছেন।”

“তুই চুপ থাক। তোর লগে আমি আর কোনো কতা কইতে চাই না। যা কওনের তোগো বাপ মার লগেই কমু।”

তাফীফ জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। কারন এই বয়স্ক লোকের সাথে আর কিছুক্ষণ কথা বললে নিজেকে সামলাতে পারবে না নিশ্চিত। কোনো না কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে। কুতুব মিয়া বিলাপ করতে করতে চলে যেতেই তাফীফ কিছুটা ক্ষিপ্ত স্বরে আলোকে শুধালো,”ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চার মতো কান্দস কেন? তুই খারাপ কিছু করছোছ? আল্লাহ তোরে মুখ দেয় নাই? কতা কইতে পারছ না তুই? এমনিতে তো আমার লগে বহুত ঝগড়া করছ।”

তাফীফের কথার পীঠে আলো কোনো জবাব দিলো না। আলো এখনো নীরবে চোখের পানি বিসর্জন দিতে ব্যাস্ত।

জহির রায়হান বাড়ি ফিরছিলেন। পথেই কুতুব মিয়ার ডাক শুনতে পেয়ে থেমে গেলেন। তারপর সালাম দিয়ে খবরাখবর জিজ্ঞেস করতেই কুতুব মিয়া অসন্তোষ প্রকাশ করে বললেন,”ভালাডা থাহি কেমতে কও দেহি।”

“কেন ভাইজান? কোনো সমস্যা?”

“তোমার মাইয়া যে গেরামে কি কইরা বেড়ায় খুঁজ খবর রাহো কিছু?”

জহির রায়হান খানিকটা সময় নিয়ে রয়েসয়ে জিজ্ঞেস করলেন,”কি হয়েছে ভাইজান? অনুগ্রহ করে একটু খুলে বললে ভালো হয়।”

বলার সুযোগ পেয়ে কুতুব মিয়া তিলকে তাল করে ব্যাপারটা মাখোমাখো করে বলতে লাগলো,”একটু আগে বাগান দিয়া আওনের সময় দেহি তোমার মাইয়া আর ওই বাহাদুর মিয়ার পোলা তাফীফ দুইজনে দুইজনের হাত ধইরা হাসাহাসি করতাছে। ওইহানে আরো বাচ্চা পোলাপান আছিলো। পোলাপানডির সামনে এগুলা করলে তো সামনে যাইয়া হেরাও এডি কইরা বেড়াইবো। এইডা ভাইবাই আমি খালি কইছিলাম এমনে হাত ধইরা বইয়া আছে কেন। আর ওমনেই তাফীফ আমারে ধমকানো শুরু করছে। আরো কইছে আমি নাকি ওগো বয়সে রঙ্গলীলা কইরা বেড়াইছি। কউ দেহি বাপের বয়সের বুড়া মানুষরে কেউ এমনে কয়?”

কুতুব মিয়ার মুখে এতো কিছু শুনার পর জহির রায়হান দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন। জহির রায়হান খুব ভালো করেই জানেন কুতুব মিয়ার আচার-আচরণ সম্পর্কে। উনি যে ব্যাপারটার সাথে ঝাল মসলা মিশিয়ে দিয়েছেন তা খুব ভালো করেই বুঝতে পারলেন জহির রায়হান। তাই খানিকটা ভেবে বললেন,”আমি দেখছি ব্যাপারটা ভাইজান।”

জহির রায়হানের এই কথাটা কুতুব মিয়ার পছন্দ হলো না। তা উনার চোখ মুখ দেখেই বুঝা গেলো।

“মাইয়াডা তো মেলা বড় হইয়া গেলো। তা বিয়া সাদি কবে দিবা? গেরামে তোমার মাইয়ার মতো বড় মাইয়া আর একটাও অবিয়াত্তা দেখছো? তোমার মাইয়ার রুপ আছে দেইহাই এহনো বিয়ার সম্বন্ধ পাও। তাই এহনো সময় আছে বিয়াডা দিয়া দেও। নইলে যা দেখতাছি কয়দিন পর তোমার মাইয়ার এইসব কুকীর্তির জন্য রুপ দেইহাও কেউ নিবার চাইবো না।”

সেদিন বাড়ি ফিরে আলো আর নিজের ঘর থেকে বের হয়নি। আর না জহির রায়হানের সামনে গিয়েছে। অবশ্য জহির রায়হান নিজেও কিছু বললেন নি আলোকে। জহির রায়হান বুঝে উঠতে পারছেন না ব্যাপারটা উনি কিভাবে সামাল দিবেন। কেননা ব্যাপারটা যে পুরো গ্রামে বাজে ভাবে ছড়াবে তা উনি বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছেন। আর অপরদিকে তাফীফ আজ বাড়ি ফিরে নি। কারন তাফীফ জানে ব্যাপারটা বাজে ভাবে বাহাদুর মিয়ার কানে পৌছে গেছে। তাই নিজের খুব কাছের এক বন্ধুর বাড়ি আজ রাতে থেকে গেলো।

চলবে….


Screenshot 3
বিজ্ঞাপনঃ বই কিনুন, বই পড়ুন

0

Sumaiya Akter Bristy

Author: Sumaiya Akter Bristy

❝শুভ্রচিন্তার উদ্ভব ঘটে যার কথা ভেবে সে যদি মোহ হয় দোষ বা কি তাতে?❞ ~Sumaiya Akter Bristy

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

গল্প চেয়ারম্যানের মেয়ে আফছানা খানম অথৈ

চেয়ারম্যানের মেয়ে আফছানা খানম অথৈ মেহেরপুর একটি সুন্দর গ্রাম।এই গ্রামে কিছু অদ্ভুত নিয়মকানুন চালু আছে,যা অন্যকোন গ্রামে নেই।এই গ্রামে নারীরা

গল্প মেয়েরা ও মানুষ আফছানা খানম অথৈ

গল্প মেয়েরা ও মানুষ আফছানা খানম অথৈ রানু বউ হয়ে এসেছে চার পাঁচ মাস হলো।এরই মধ্যে তার স্বামী স্কলারশিপ এর

গল্প মেয়ে সাক্ষী আফছানা খানম অথৈ

মেয়ে সাক্ষী আফছানা খানম অথৈ আবিদ হায়দার বেড়াতে এসেছে গ্রামে তার বন্ধু ফুয়াদ'র বাসায়।অবশ্য সে একা না,তার সঙ্গে আছে,বন্ধু সজল

গল্প বন্ধ্যা আফছানা খানম অথৈ

গল্প বন্ধ্যা আফছানা খানম অথৈ আলেয়া বউ হয়ে এসেছে চার বছর হলো।এখনো মা হতে পারেনি। এজন্য রীতিমতো তাকে কটু কথা

One Reply to “অপেক্ষা। পর্ব-০৫। সুমাইয়া আক্তার বৃষ্টি”

Leave a Reply