অপেক্ষা। পর্ব-০৬। সুমাইয়া আক্তার বৃষ্টি

0

 

ফজরের নামাজ শেষ করে আলো জানালার কাছে গিয়ে একধ্যানে তাকিয়ে রইলো। সারা রাত কান্নার জন্য চোখ মুখ ফুলে আছে। কি করে বাবার সামনে যাবে সেটা ভেবেই কান্না পাচ্ছে আলোর। হঠাৎ পিছন থেকে পুরুষালি কন্ঠে নিজের নাম শুনতেই পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো আলোর অতি নিকটে রোশান দাঁড়িয়ে আছে।

রোশান মূলত এসেছিলো আলোকে পড়ানোর উদ্দেশ্যে। কিন্তু এসে যখন অনেকক্ষন দরজার কড়া নেড়েও কোনো সারা শব্দ পেলো না তখন খেয়াল করলো দরজাটা শুধু ভিড়ানো অবস্থায় আছে। তাই অনেকটা অস্বস্তি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখলো আলো উদাসীন হয়ে জানালার পাশ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর আলোর পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ধীর কন্ঠে ডাকলো,”আলো!”

রোশানকে এতো নিকটে দেখে অস্বস্তিতে পড়ে গেলো আলো। তাই কোনো রকম অমতা অমতা করে জিজ্ঞেস করলো,”আপনি এখানে?”

“আপনাকে পড়াতে এসেছিলাম। অনেকবার দরজায় কড়াও নেড়েছিলাম। কিন্তু আপনার সারা শব্দ না পেয়ে ভিতরে চলে এসেছি। তার জন্য দুঃখিত।”

আলো কিছু না বলে পড়ার টেবিলে গিয়ে বসলো। রোশান আলোর যাওয়া দেখে নিজেও আরেকটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো।

পড়ানোর ফাকে ফাকে রোশান আলোর মুখও পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। কিন্তু আলো বই থেকে একবারের জন্যও মাথা তুলে তাকায়নি। তাকালে হয়তো দেখতে পেতো রোশানের চোখের গভীরতা।

পড়ানো শেষ হতেই রোশান বললো,”আলো লুক এট মি।”

রোশানের কথায় আলো খানিকটা মাথা তুলে তাকালো। তবে চোখে চোখ রাখলো না।

“কি হয়েছে আপনার? কেদেছেন কেন?”

“ক কই না তো।”

“তাহলে তুতলাচ্ছেন কেন?”

“আপনি ভুল ভাবছেন।”

“দেখুন আলো আপনার চোখ-মুখ দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে আপনি অনেক বেশি কেদেছেন। আপনি আমাকে বলতে চাচ্ছেন না সেটাও স্পষ্ট। আমি জানি না আপনার কি হয়েছে, তবে কোনো দিন যদি বিন্দু পরিমান মনে হয় আপনি একা, আপনার পাশে কেউ নেই। তাহলে সে সময় অবশ্যই এই অধমকে মনে করবেন। কেউ আপনার পাশে থাকুক বা না থাকুক আমাকে আপনি সব সময় নিজের পাশে পাবেন।”

এবার আলো নিজের মুখ খুললো। রোশানের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,”কেউ আমার পাশে না থাকলে আপনি কেন থাকবেন? আপনি তো আমাকে ভালোমতো চিনেনও না!”

“সব প্রশ্নের উত্তর জানতে নেই আলো। যদি কখনো সুযোগ হয় আমি অবশ্যই আপনাকে কারনটা জানাবো। আজ আসি তবে।”

তাফীফ নিজ বাড়ির পিছনে লুকিয়ে সামনের দিকে চুপিচুপি দেখছে বাহাদুর মিয়া বাহিরে আছে নাকি। আপাতত নিজের বাবার সামনে পড়তে চাচ্ছে না তাফীফ। যেই তৃতীয় বারের মতো মাথাটা সামনের দিকে দিয়ে দেখতে যাবে ওমনি কেউ একজন তাফীফের কান টেনে ধরলো।

“বদমাইশ পোলা, আকাম কুকাম কইরা আবার সারা রাত কই আছিলি? আমার মান সম্মান শেষ পর্যন্ত ডুবাইয়া ছাড়লি।”

“আব্বা কান ছাড়েন। লাগতাছে তো।”

“আকাম কুকাম করার সময় কিছু মনে পড়ে নাই। আজকে তোর পিঠের চামড়া যদি আমি না উঠাইছি তাইলে আমার নামও বাহাদুর মিয়া না।”

“তাইলে নাম পালটাইয়া কষাই মিয়া রাইখা দিয়েন।”

“এই কি কইলি তুই? বাপের লগে কেউ এমনে কথা কয় বেদ্দপ পোলা? তোরে দেখলে আমার মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়। তুই আমার পোলা হইতেই পারছ না।”

“আম্মারে যাইয়া জিগান আমি কার পোলা তাইলেই তো সন্দেহ দূর হয়।”

তাফীফের কথা শুনে বাহাদুর মিয়া ক্ষেপে উঠলেন। কান টেনে নিয়ে গেলেন বাড়ির সামনে। বাপ ছেলেকে এভাবে দেখে তাফীফের মা জোহরা রান্নাঘর থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে এলেন। জোহরাকে দেখে তাফীফ আহ্লাদী স্বরে বলে উঠলো,”আম্মা দেহো আব্বা আমারে মারতাছে।”

তাফীফে কথায় বাহাদুর মিয়া তেতে উঠলেন। নিজের স্ত্রীকে শুধালেন,”জোহরা এ আমার পোলা হইতেই পারে না। সত্যি কইরা কও এইডা কার পোলা?”

“আম্মা আমি কার পোলা?”

“দেহো দেহো, কিরকম অসভ্য পোলা জন্ম দিছো তুমি। আর এই হতচ্ছাড়া তোকে তো আমি…” বলে তাফীফের কান ছেড়ে দিয়ে একপাশে পড়ে থাকা বাশ থেকে একটা হাতে তুলে নিলেন বাহাদুর মিয়া। তারপর তাফীফের দিকে তেড়ে আসতেই জোহরা ছেলের পক্ষ নিয়ে বাহাদুর মিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে বললেন,”খবরদার যদি আমার পোলার গায়ে একটা আচরও দিছেন। তাইলে কিন্তু ভালা হইবো না তাফীফের বাপ।”

“এই তোমার আস্কারা পাইয়া পোলা আইজকা গোল্লায় গেছে। কি সব কান্ড কইরা বেড়াইতাছে, আমার মান সম্মান সব শেষ করলো পোলাডা।”

“আমি কিছু করি নাই আম্মা। ওই বুইড়া বেডা মিছা কথা কইতাছে সবাইরে।”

“দেহো দেহো, মুখের ভাষা দেহো। হ্যাঁ রে হতচ্ছাড়া! তুই এইসব কইরা বেড়াবি সেইটা কিছু না আর মাইনষে কইলেই দোষ?”

এবার জোহরা শাড়ির আঁচল কোমরে গুজে শাসানোর স্বরে বললেন,”মাইনষের কথায় কান দিতে যান কেন আপনে? ওই কুতুব ভাই যে কি রকম মানুষ ওইডা আপনে জানেন না? নিজের পোলারে রাইখা বাইরের মাইনষের কথা বিশ্বাস করেন আপনের লজ্জা করে না?”

বাবা-মায়ের কথার মাঝে তাফিফ ফট করে বলে উঠলো,”আম্মা, এরেই কয় ঘরের শত্রু বিভীষণ। নিজের পোলার চাইতে মাইনষের কথার দাম বেশি উনার কাছে।”

জোহরা নিজের ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর মাখা কন্ঠে বললেন,”থাক বাবা, বাদ দে। আমিও দেইখা নিমু আমি থাকতে আমার পোলারে কেউ কেমনে কিছু কয়।”

মা ছেলের কাহিনি দেখে বাহাদুর মিয়া কিছুক্ষণ থ মেরে দাঁড়িয়ে রইলেন। শেষমেশ কিনা নিজের ছেলে এটা বলতে পারলো? আর ছেলের থেকে বউও বা কম কিসে। তাই কাতর চোখে নিজের সহধর্মিণীর দিকে তাকিয়ে বাহাদুর মিয়া বললেন,”তুমি আমার জোহরা হইতেই পারো না। আমার জোহরা আমারে কহনো এমনে কইতেই পারে না।”

এবার জোহরা নিজের স্বামীর পানে তাকিয়ে বললেন,”আমি পুকুর পাড়ের বকুল গাছের পেত্নি। আপনার বউরে বন্ধি কইরা এইহানে তার রুপ ধইরা আয়ছি। এবার হইছে? খুশি আপনে?”

তারপর নিজের ছেলের দিকে তাকিয়ে জোহরা আবারো আদর মাখা কন্ঠে বললেন,”চল আব্বা, খাইতে যাবি চল। আহারে কালকে রাইত থেইকা কি খাইছে না খাইছে আমার আব্বা’টার মুখটা শুকাইয়া একেবারে ছোট্ট হইয়া গেছে।”

এদিকে বাহাদুর মিয়া মা ছেলের ভালোবাসা দেখে নিজের মনে বিরবির করে বললতে লাগলেন,”হ আর এইদিকে যে আমি কিছু খাই নাই কালকে রাইত থেইকা ওইডার খেয়াল কি কারো আছে? আমি তো উইড়া আইয়া জুইরা বইছি।”

রোশান দুপুরের বাড়ির দিকে যাচ্ছিলো ঠিক সে সময় বয়স্ক এক অপরিচিত লোকের ডাকে থেমে যায়।

“বাজান তোমারে যে ঠিক চিনলাম না! গেরামেও তো এর আগে কহনো দেখছি বইলা মনে হইতাছে না।”

“চাচা আমি নাসিম সিকদারের ছেলে রোশান সিকদার।”

“ওহ, তোয় নাসিম আহে নাই? গেরাম ছাইড়া যে শহরে গেলা আর তো আহো না তোমরা।”

“এইযে চাচা এলাম তো। তা আপনার পরিচয়টা চাচা!”

“আমি কুতুব মিয়া।”

“ওহ, বাবার কাছে আপনার সম্পর্কে শুনেছি।”

“তা বাপজান সক্কালে তোমারে মাষ্টারের বাড়ি থেইকা বাইর হইতে দেখলাম যে! এতো সক্কালে ওই বাড়ি কি করো?”

“আলোকে পড়াতে গিয়েছিলাম চাচা।”

“বাপজান এগুলা কি কও! ওই মাইয়ারে পড়াইতে যাও তুমি?”

কুতুব মিয়ার কথায় রোশান নিজের ব্রু যুগল কুচকে তাকালো। বুঝতে পারলো আলোর মন খারাপের সাথে নিশ্চিত এই লোকের কোনো সম্পর্ক আছে। বাবার কাছে এই লোক সম্পর্ক যতো দূর শুনেছে, বুঝেছে তাতে এটাই মনে হচ্ছে রোশানের।

“তা কেন চাচা? কোনো সমস্যা?”

“সমস্যা মানে? ওই মাইয়া পুরাডাই তো সমস্যা।”

“তা কি কারনে সমস্যা চাচা?”

“পোলাগো হাত ধইরা হাসাহাসি করে। মাইয়ার চরিত্র ভালা না বাপজান।”

“আপনি দেখছেন চাচা?”

“হ, নিজের চোক্ষে দেখছি। তা না হইলে কি আর কই?”

“তা চাচা শুধু হাত’ই তো ধরেছে। চুমু টুমু তো আর খায় নি। তাই না?”

“ছিহ ছিহ কি সব কথাবার্তা মুহে আনতাছো। আইজকা হাত ধরছে, পরশু যে এর থেইকা বেশি করবো না তার কোনো পরমান আছে?”

“কিন্তু পরশু যে তারা এমন করবে তারও কিন্তু প্রমান নেই। সাথে আপনি যে আলোকে ছেলেদের সাথে হাত ধরাধরি করে হাসতে দেখেছেন এটারও প্রমান নেই।”

“কি কইতে চাও তুমি? আমি বানাইয়া বানাইয়া সব কইতাছি? এতে আমার লাভ কি বাপু?”

“আপনার লাভ কি সেটা তো আর আমি জানি না। তবে আমি আপনার সম্পর্কে যতোটুকু জানি তা থেকে এটাই বলবো মানুষের পিছিনে সিসি ক্যামেরার মতো লেগে থাকা বাদ দিন।” বলেই রোশান চলে গেলো।

এদিকে কুতুব মিয়া রোশান বলা শেষক্ত কথাটি বুঝতে পারেন নি। তাই নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলেন,”ছি ছি কামরা! এইডা আবার কি?”

চলবে…..


Screenshot 3
বিজ্ঞাপনঃ বই কিনুন, বই পড়ুন

0

Sumaiya Akter Bristy

Author: Sumaiya Akter Bristy

❝শুভ্রচিন্তার উদ্ভব ঘটে যার কথা ভেবে সে যদি মোহ হয় দোষ বা কি তাতে?❞ ~Sumaiya Akter Bristy

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

গল্প চেয়ারম্যানের মেয়ে আফছানা খানম অথৈ

চেয়ারম্যানের মেয়ে আফছানা খানম অথৈ মেহেরপুর একটি সুন্দর গ্রাম।এই গ্রামে কিছু অদ্ভুত নিয়মকানুন চালু আছে,যা অন্যকোন গ্রামে নেই।এই গ্রামে নারীরা

গল্প মেয়েরা ও মানুষ আফছানা খানম অথৈ

গল্প মেয়েরা ও মানুষ আফছানা খানম অথৈ রানু বউ হয়ে এসেছে চার পাঁচ মাস হলো।এরই মধ্যে তার স্বামী স্কলারশিপ এর

গল্প মেয়ে সাক্ষী আফছানা খানম অথৈ

মেয়ে সাক্ষী আফছানা খানম অথৈ আবিদ হায়দার বেড়াতে এসেছে গ্রামে তার বন্ধু ফুয়াদ'র বাসায়।অবশ্য সে একা না,তার সঙ্গে আছে,বন্ধু সজল

গল্প বন্ধ্যা আফছানা খানম অথৈ

গল্প বন্ধ্যা আফছানা খানম অথৈ আলেয়া বউ হয়ে এসেছে চার বছর হলো।এখনো মা হতে পারেনি। এজন্য রীতিমতো তাকে কটু কথা

5 Replies to “অপেক্ষা। পর্ব-০৬। সুমাইয়া আক্তার বৃষ্টি”

Leave a Reply