গল্প অকৃতজ্ঞ স্বামী আফছানা খানম অথৈ

0

অকৃতজ্ঞ স্বামী

আফছানা খানম অথৈ

পঞ্চাশ বছরের খালেক বেপারী দ্বিতীয় বিয়ে করে বউ নিয়ে হাজির।ঘরের দরজায় এসে কড়া নাড়ে।প্রথম স্ত্রী অজিফা ভিতর থেকে আওয়াজ তোলে,
কে ওখানে?
কোন আওয়াজ নেই।আবার ও কড়া নাড়ে।এবার অজিফা আর থেমে থাকল না।হাতের কাজ ফেলে তড়িঘড়ি করে দরজা খোলে দিলো।
সে কী!তার স্বামী দাঁড়িয়ে আছে।পাশে বউ বেশে দাঁড়িয়ে আছে পনেরো ষোলো বছরের এক যুবতি।অজিফা চিন্তা করে কিনারা পাচ্ছে না,এ মেয়ে কে?তার উপরে বউ বেশে।সে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।তখনি খালেক বেপারী বলল,
বউ দাঁড়িয়ে আছ কেনো? ওকে ঘরে তোল।
ওহ কে?
তোমার সতীন।
মানে..?
মানে আমার দ্বিতীয় স্ত্রী।
কী বললেন,আপনি আবার বিয়ে করেছেন?
হুম করেছি।তো কী হয়েছে?

কথাটা শুনামাত্রই অজিফা মুর্ছিত হয়ে মেঝেতে পড়ে যায়।আর এই সুযোগে খালেক বেপারী বউ নিয়ে অন্ধর মহলে প্রবেশ করলো।নিজের খাস কামরায় বউকে নিয়ে অবস্থান করলো।হাসি আনন্দে ব্যস্ত…।
এদিকে অজিফা যে মুর্ছিত হয়ে পড়ে আছে সেদিকে খালেক বেপারীর একটু ও খেয়াল নেই।কিছু সময় পরে অজিফার জ্ঞান ফিরে আসে এবং সে স্বাভাবিক হয়।ইতিমধ্যে ছেলে সজল ও মেয়ে জারা বাবার দ্বিতীয় বিয়ের কথা জেনে যায়।বাবাকে কিছু বলার থাকলেও বলতে পারে না।মাকে বুঝায় এ ব্যাপারটা মেনে নেয়ার জন্য।কিন্তু মা মানলে তো?
মায়ের এককথা আমি কার জন্য এতকিছু করলাম।তিলতিল করে এই সংসার সাজালাম।বেকার স্বামীকে বাবার বাড়ি থেকে টাকা এনে ব্যবসা ধরালাম।আজ সে খালেক বেপারী বড়লোক।সবাই তাকে এক নামে চিনে,সম্মান করে।এসব কার জন্য হয়েছে আমার জন্য।আজ এর বিনিময়ে সে আমায় কী প্রতিদান দিলো।ঘরে সতীন আনল। আমার মাথায় কুড়াল মারল।আমি এসব মানব কী করে?আমি এসব মানতে পারব না।তাকে পুলিশে দেব।জেল হাজত খাটাব।
প্লিজ মা একটু শান্ত হও।

কী করে শান্ত হব।দেখছিস না বিয়ে করতে না করতে আমাদেরকে পর ভাবতে শুরু করেছে।আমি মুর্ছিত হয়ে পড়ে আছি।সে বউ নিয়ে মোজ মাস্তি করছে।
সজল ও জারা দুজনে মাকে বুঝিয়ে একটু শান্ত করলো।কিন্তু মায়ের অবুঝ মন কিছুতেই প্রবোধ মানছে না।বারবার স্বামীর কথা মনে পড়ছে।কারণ মেয়েরা কখনো স্বামীর ভাগ কাউকে দিতে পারে না।অথচ আজ থেকে স্বামীর উপর অজিফার আর কোন অধিকার নেই।সে অন্যের দখলে চলে গেছে।এই ভাবনাগুলো তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে প্রতিটি মুহূর্ত।
এদিকে দিন যায় রাত হয়।খালেক বেপারী দ্বিতীয় বউ লায়লাকে নিয়ে খুব ব্যস্ত।লায়লা ও আপ্রাণ চেষ্টা করছে তার মনের রাজ্য পুরোপুরি দখল করারা জন্য।সেই সঙ্গে তার টাকা পয়সা ধন সম্পত্তি।বড় বউ ও তার ছেলে-মেয়ের সম্পর্কে খুব করে কানপড়া দিচ্ছে।ভুলভাল বুঝাচ্ছে।যাতে খালেক বেপারী তাদের টেককেয়ার না করে।খালেক বেপারী প্রথমে আমলে না নিলেও পরে ঠিক তার কথামতো চলতে শুরু করলো।
বড় বউ আর তার ছেলে- মেয়ের টেককেয়ার করছে না।
একদিন বড় বউর সঙ্গে এই নিয়ে তুমুল ঝগড়া হয়।খালেক বেপারীর এককথা সে তাদের দায় দায়িত্ব নিতে পারবে না।এতদিন যা করার করেছে।এখন থেকে আর কিছু করতে পারবে না।বড় বউ থেমে নেই তাকে পুলিশের ভয় দেখায়,জেলা হাজত খাটানোর কথা বলে।তখনি খালেক বেপারী ক্ষেপে যায়।তাদেরকে ঘর থেকে বের করে দেয়।এই সুযোগে ছোট বউ ঘরে খিল দেয়।রাজা আর রাজত্ব দুটো পেল ছোট বউ।এতদিনে লায়লার মনের আশা পূর্ণ হলো।সে খুশিতে গদগদ…।

এদিকে অজিফা কোন উপায় না দেখে ছেলে-মেয়ে দুটোকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যায়।অজিফার বাবা-মা নেই।ভাই ভাবীরা তাকে ভালোভাবে মেনে নেয়নি।উপায় নেই তবুও তাকে থাকতে হবে।ভাইয়ের সংসারে তাকে কাজের বুয়া হয়ে থাকতে হচ্ছে।বিনিময়ে দুবেলা দুমুঠো খেতে দিচ্ছে।সবকিছু মেনে নিয়েছে অজিফা।সজল মায়ের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে পড়ালেখা ছেড়ে একটা দোকানে কাজ নিয়েছে।জারার ও পড়ালেখা প্রায় বন্ধ।দুবেলা পেটের ভাত জোগাতে কষ্ট হচ্ছে।পড়ালেখার খরচ দেবে কোত্থেকে।
এদিকে লায়লার ভালোবাসার অভিনয়ে খালেক বেপারী পাগল প্রায়।সে যখন যা বলে খালেক বেপারী তখন তা করে।লায়লা বলল,তাকে দ্বো-তলা ঘর বানিয়ে দিতে হবে।খালেক বেপারী তাই করলো।দ্বো-তলা ঘর বানিয়ে লায়লাকে সিংহাসনে বসাল।লায়লার কোনকিছুর অভাব নেই।ইতিমধ্যে সে দুসন্তানের মা হয়ে গেছে।সে কায়দা করে তার দুসন্তানের নামে জাগা সম্পদ লিখে নিয়েছে।মাঝে আর ও কয়েক বছর কেটে গেলো। খালেক বেপারীর বুড়ো হয়ে গেছে,শরীর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গেছে।আগেরমতো শরীরে শক্তি নেই।অজিফার ছেলে-মেয়ে বাবাকে যেমন ভক্তি শ্রদ্ধা করত।লায়লার ছেলে-মেয়ে কিন্তু তেমন ভক্তি শ্রদ্ধা করে না।লায়লার মেয়ে দীপা নষ্টা বদমেজাজি, যখন যা মন চাই তা করে।এই নিয়ে মা তেমন একটা কেয়ার করে না।আর এই সুযোগে দীপা যার তার সাথে রিলেশন করে।শুধু তাই নয় বখাটে ছেলেদের সাথে রাত কাটায়,লং ড্রাইভে যায়।।একথাটা বাবার কানে আসতেই তিনি তাকে খুব বকাঝকা করলেন, শাসন করলেন।মেয়ে বাবাকে কোন পাত্তা দিলোনা।উলটো গালমন্দ করলো।আর তা সাপোর্ট করলো মা।শুধু তাই নয়,মা বলল,
আমার মেয়েকে শাসন করার তুমি কে?

কে মানে, যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা।যেমন মা তেমন মেয়ে নষ্টা।এক্ষণি মা মেয়ে দুজনে আমার ঘর থেকে বের হয়ে যাও।
আমি বের হব না।তুমি বের হও।
আমি বের হব মানে,তুই বের হও।তানা হলে গাঢ় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব।
এতবড় সাহস আমাকে গলাধাক্কা দিবি, আয়…।
এমনিভাবে তারা আর ও কিছু সময় কথাকাটাকাটি করে।দুজনের মাঝে তুমুল ঝগড়া হয়।কেউ কাউকে ছাড় দেয় না।এতদিনে লায়লার আসলরুপ ফুটে উঠে।সে স্বামীকে যাতা ব্যবহার করে।এতদিন পর খালেক বেপারী আসল নকল বুঝতে পারে।সে লায়লাকে বের করে অজিফাকে ঘরে তোলার প্ল্যানিং করে।আর তা বুঝতে পেরে লায়লা ও তার ছেলে-মেয়ে তাকে টেনে হেঁছড়ে করে ঘর থেকে বের করে দেয়।খালেক বেপারীর প্রেশার হাইতে উঠে যায় এবং তিনি স্রোক করেন।স্রোক করার সাথে সাথে তার একহাত একপা অবশ হয়ে যায়।এই সুযোগে সুযোগ লায়লা তার ছেলে-মেয়েসহ তাকে ধরাধরি করে গভীর রাতে রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসে।সকাল হলে লোকজন জড়ো হয়।কিছু মিডিয়ার লোক ও সেখানে উপস্থিত হয়।খালেক বেপারীর সঙ্গে কথা বলার পর তিনি সকল ঘটনা প্রকাশ করেন।সবকথা শোনার পর মিডিয়ার লোক ছুটে যায় তার দ্বিতীয় স্ত্রী লায়লার কাছে।স্বামীকে রাস্তায় ফেলে আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন,

উনার সাথে তিন বছর আগে আমার ডিভোর্স হয়ে যায়।উনাকে কে রাস্তায় ফেলে এসেছে তা আমরা জানি না।
কিন্তু উনিতো বলল,আপনি ফেলে এসেছেন।
মিথ্যে বলেছে,আমি এই ব্যাপারে কিছুই জানি না।
সবসত্য অস্বীকার করলো লায়লা।এমনকি তার ছেলে মেয়েরা ও এই ব্যাপারে কিছু জানে না বলে অস্বীকার করেছে।তার প্রথম স্ত্রী এর সাথে জড়িত বলে তারা জানালো।এবার মিডিয়ার লোকজন প্রথম স্ত্রীর সন্ধানে ছুটে গেল তার বাবার বাড়িতে।কিন্তু সেখানে তাকে পেলো না।কারণ ভাই ভাবী তাকে বের করে দিয়েছে।তারপর সে চলে যায় শহরে।ততদিনে সজল আর জারা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে চাকরী নেয়।তাদের সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে আসে।
মিডিয়ার লোক প্রথম স্ত্রীর উদ্দেশ্য খালেক বেপারীর ছবি দিয়ে ফেসবুকে একটা লাইভ দেয়।তার রাস্তায় পড়ে থাকার করুণ কাহিনী প্রকাশ করে।লোকজন ও থেমে নেই।তার দ্রুত শেয়ার করা শুরু করে।আর তা স্বল্প সময়ের মাঝে জারা ও সজলের চোখে পড়ে যায়।তারা দ্রুত ছুটে আসে বাবার কাছে।কিন্তু সে কী!
রাস্তায় পড়ে আছে বাবা মোশা মাছি তাকে কামড়ে খাচ্ছে।কোন সাড়াশব্দ নেই।দুভাই বোন বাবা বাবা বলে কয়েকবার ডাকে।বাবা কোন সাড়া দেয় না।তারা বুঝতে পারল বাবা আর নেই।তারা ডুঁকরিয়ে কেঁদে উঠল।অজিফার চোখে থেকে ও জল পড়ছে।তবুও ছেলে মেয়ে দুটোর চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
আর কেঁদোনা তোমরা। এভাবে কাঁদলে উনার আত্মা কষ্ট পাবে।
ঠিক বলেছ মা।

অজিফা ও তার ছেলে মেয়ে খালেক বেপারীকে বাসায় নিয়ে আসল।গোসলের জন্য গায়ের জামা খুলতেই পেলো একটা চিঠি তাতে লেখা,
প্রিয়
অজিফা আমার সালাম ও ভালোবাসা নিও।আল্লাহ তোমাদের ভালো রাখুক এই দোয়া করি।

অজিফা আজ আমি কিছু সত্য কথা না বলার জন্য কাগজ কলম হাতে নিয়েছি।জানি এই চিঠিটা যখন তোমার হাতে যাবে, তখন আমি থাকব না।লায়লার মিথ্যে ভালোবাসা পেয়ে আমি তোমাকে ভুলে গেছি।তোমার উপর অনেক অন্যায় করেছি, জুলুম করেছি।তোমাদেরকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছি।তোমার ভালোবাসাকে অবজ্ঞা করেছি।তোমাকে ভুল বুঝেছি।কিন্তু আজ সব বুঝতে পেরেছি।কে আসল কে নকল?তাই লায়লাকে বের করে তোমাকে ঘরে তুলতে চেয়েছিলাম।আর তা বুঝতে পেরে লায়লা আর তার ছেলে মেয়ে আমাকে ঘর থেকে বের করে দেয়।আমি সহ্য করতে না পেরে স্রোক করি।এক হাত এক পা অবশ হয়ে যায়।আর এই সুযোগে তারা আমাকে রাস্তায় পেলে দিয়ে আসে।
আমি এখন আসহায় । আমার পাশে কেউ নেই।অজিফা,একটা সত্য কথা,আল্লাহ ছাড় দেয়।কিন্তু ছেড়ে দেয়না।একদিন আমি তোমাকে ঘর থেকে বের করে ছিয়েছিলাম।আজ আমার সন্তানেরা আমাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে।এটা আমার পাপের ফসল।অকৃতজ্ঞতার ফল। অজিফা সবশেষে বলব আমি যে পাপ করেছি তা ক্ষমার যোগ্য নয়।তবুও বলব,আমাকে ক্ষমা করে দিও।জারা সজলকে নিয়ে সুখে থেকো এই দোয়া করি।
ইতি
তোমারই অকৃতজ্ঞ স্বামী
খালেক বেপারী।
চিঠিটা পড়ার পর অজিফা ও তার ছেলে মেয়ের সকল ক্ষোভ দূর হয়ে যায়।সকল দু:খ কষ্ট ভুলে তাঁরা ছহিছালামতে খালেক বেপারীর দাফনের কাজ শেষ করে।

ঃসমাপ্তঃ


Screenshot 3
বিজ্ঞাপনঃ বই কিনুন, বই পড়ুন

0

Afsana Khanam

Author: Afsana Khanam

লেখক

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

গল্প চেয়ারম্যানের মেয়ে আফছানা খানম অথৈ

চেয়ারম্যানের মেয়ে আফছানা খানম অথৈ মেহেরপুর একটি সুন্দর গ্রাম।এই গ্রামে কিছু অদ্ভুত নিয়মকানুন চালু আছে,যা অন্যকোন গ্রামে নেই।এই গ্রামে নারীরা

গল্প মেয়েরা ও মানুষ আফছানা খানম অথৈ

গল্প মেয়েরা ও মানুষ আফছানা খানম অথৈ রানু বউ হয়ে এসেছে চার পাঁচ মাস হলো।এরই মধ্যে তার স্বামী স্কলারশিপ এর

গল্প মেয়ে সাক্ষী আফছানা খানম অথৈ

মেয়ে সাক্ষী আফছানা খানম অথৈ আবিদ হায়দার বেড়াতে এসেছে গ্রামে তার বন্ধু ফুয়াদ'র বাসায়।অবশ্য সে একা না,তার সঙ্গে আছে,বন্ধু সজল

গল্প বন্ধ্যা আফছানা খানম অথৈ

গল্প বন্ধ্যা আফছানা খানম অথৈ আলেয়া বউ হয়ে এসেছে চার বছর হলো।এখনো মা হতে পারেনি। এজন্য রীতিমতো তাকে কটু কথা

Leave a Reply