গল্প ছোট মেয়ে আফছানা খানম অথৈ

0

ছোট মেয়ে

আফছানা খানম অথৈ

হালিমা বজল মাস্টারের বাসার সামনে এসে দরজায় নক করলো।খড়খড় শব্দ শুনে এগিয়ে আসল বজল মাস্টারের স্ত্রী ফারহানা।দরজা খুলতেই দেখতে পেলো তেরো চৌদ্দ বছরের একজন যুবতি মেয়ে হাতে একটা কাপড়ের পুটলা, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।তিনি প্রথমে মেয়েটির আপাদমস্তক দেখে নিলো।কিন্তু তাকে চিনতে পারলেন না।তবে মেয়েটি কে?প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।মেয়েটি ও হা করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।কিছু বলতে চেয়েও পারছে না।ভয়ে বুকের ভিতর ধুকধুক করছে।ঠিক সেই মূর্তে ফারহানা জিজ্ঞেস করলেন?
তুমি কে?
আমি হালিমা।
কোত্থেকে এসেছ?
গ্রাম থেকে।
কাকেও চাও?
বজল মাস্টার সাহেবকে?
উনি তোমার কী হয়?
আমার বাবা।আমি উনার ছোট মেয়ে?
কথাটা শুনামাত্রই ফারহানার চোখ উপরে উঠে গেল।তিনি চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন।ততক্ষণে বাসার সব লোক জড়ো হলো।বজল মাস্টারের প্রথম পক্ষের তিন ছেলে এক মেয়ে।ছোট ছেলে আয়ান ছাড়া সবার বিয়েশাদী শেষ।ফারহানা সবাইকে বিষয়টা খুলে বললেন।কিন্তু এ’কথাটা কেউ বিশ্বাস করতে পারলো না।আর বিশ্বাস করবে বা কেনো?উনি জীবিত থাকা অবস্থায় প্রথম স্ত্রীকে দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপারে কিছুই বলে যাননি।তাই সবার ধারণা মেয়েটি মিথ্যে বলছে।মাস্টার কখনো এমন কাজ করতে পারেন না।তিনি খুব ভালো স্বভাবের মানুষ ছিলেন।নিজের স্ত্রী ছাড়া পর নারীর দিকে ভুলেও তাকাতেন না।কিন্তু আজ এই মেয়েটি কী বলছে। সবার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।তাদের ধারণা মেয়েটি তাদেরকে ব্ল্যাকমেইল করতে চাইছে।তাই এমন একটা উদ্ভট কথা বলেছে।মাস্টারের বড় ছেলে সেলিম কড়া ধমক দিয়ে বলল,

এই মেয়ে তুমি মিথ্যে বলছ।বাবা আমার মাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করেননি?
ভাইয়া সত্যি বলছি।মাস্টার সাহেব আমার মাকেও বিয়ে করেছেন?
মিথ্যে কথা,সত্যি কর বল,তোমাকে এখানে কে পাঠিয়েছে?
আমার মা পাঠিয়েছে?
তোমার মা এখন কোথায়?
সাতদিন আগে আমার মা মারা গেছে।মারা যাবার সময় এই ঠিকানা দিয়ে বলেছেন,আমি মারা যাবার পর উনার কাছে চলে যাবি।বলবি তুই উনার ছোট মেয়ে।আমার এই জনমে কেউ নেই।আমাকে একটু আশ্রয় দিন।
না দেব না।কারণ মুখের কথায় কেউ কারো মেয়ে হতে পারে না।এটা সম্পূর্ণ মিথ্যে বানোয়াট। আজকাল এমন ঘটনা অহরহ ঘটে।ভালোই ভালোই চলে যাও।তা না হলে পুলিশে দেব।
হালিমা হাত জোড় করে কেঁদে কেঁদে বারবার বিশ্বাস করাতে চাইছে।সে ওদের মতো এই পরিবারের সদস্য।কিন্তু তার কথা কেউ বিশ্বাস করছে না।সবাই মিলে তাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে।এমন সময় মাস্টারে ছোট ছেলে আয়ান উপস্থিত হলো।সে সবেমাত্র মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে।চাকরী এখনো পাইনি।তবে বিভিন্ন পদে ইন্টারভিউ দিচ্ছে।সে এসে দেখে হালিমা কাঁদছে আর সবাই মিলে তাকে কড়াভাবে ধমকাচ্ছে।হালিমাকে কেনো জানি তার পরিচিত মনে হলো।সে তাকে ভালোভাবে দেখে নিলো।তারপর পরিচয় জানতে চাইলে ফারহানা মেয়েটির দেয়া জবানবন্দি প্রকাশ করলো।সবকথা শুনার পর আয়ান বলল,
মা হালিমা ঠিক বলেছে।সে এই পরিবারের ছোট মেয়ে?
কে বলেছে?

বাবা মারা যাওয়ার আগে আমাকে সবকথা বলেছে?
আমি বিশ্বাস করি না।
মা বিশ্বাস না করলে ও হালিমা এই পরিবারের মেয়ে।
আমি মানি না।
মা মানতে তোমাকে হবে।এই পরিবারে আমাদের যেমন অধিকার আছে।হালিমার ও আছে।
কোথাকার কে একটা কথা বলল,আর অমনি তুই বিশ্বাস করলি?
হুম করলাম।তেরো চৌদ্দ বছর আগের কথা,বাবা গিয়েছিলেন গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে।গিয়ে দেখলেন উনার দু:সম্পর্কে চাচা কবির মিয়া খুব অসুস্থ,মৃত্যু পথযাত্রী।একমাত্র মেয়ে হাজেরা বাবার পাশে বসে বসে কাঁদছে।বাবাকে দেখামাত্রই উনার চাচা বলল,
বজল তুই এসেছিস?
জ্বি চাচা।কিছু বলবে?
হ্যাঁ বলব।
জ্বি চাচা বলুন।
আমি আর বাঁচব না।আমার মেয়েটার এই দুনিয়ায় কেউ নেই।তুই আমার মেয়েটার দায়িত্ব নিবি?
চাচা ইয়ে মানে…।
মানে মানে করিস না।বল আমার মেয়েটার দায়িত্ব নিবি?

তিনি বারবার কয়েকবার অনুরোধ করলেন।একটা লোক মৃত্যুপথ যাত্রী এই অবস্থায় না করাটা কী ঠিক হবে?মাস্টার পড়লেন মহাবিপদে হ্যাঁ ও করতে পারছে না,নাও করতে পারছে না।চাচার প্রাণ যায় যায় অবস্থা।ঠিক সেই মূহূর্তে তিনি সত্যি তার মেয়েকে বজল মাস্টারের হাতে তুলে দিলেন।মাস্টার ও ওয়াদা করলো তার মেয়েকে সুখে রাখার।তিনি মারা গেলেন।মাস্টার তার কাপন দাফনের কাজ শেষ করলেন।তারপর চাচার ওয়াদা পূরণ করতে হাজেরাকে বিয়ে করলেন।তারপর খোরপোষ দিয়ে শহরে চলে আসলেন।এরপর তিনি আর কখনো গ্রামে যাননি।তবে খোরপোষ ঠিকমতো দিয়েছেন।জীবিত অবস্থায় এই সত্য প্রকাশ হলে পরিবারে একটা কেলেংকারীর সৃষ্টি হবে।তাই তিনি সত্যটা বলে যেতে চাননি। তবে মারা যাবার আগে ছোট ছেলে আয়ানকে সবসত্য বলে গেছেন।এবং ছোট বোন হালিমার দায়িত্ব পালন করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করে গেছেন।আজ আয়ান বাবার সবসত্য সবার কাছে প্রকাশ করলো এবং হালিমাকে ছোট বোন হিসাবে মেনে নেয়ার জন্য সবাইকে অনুরোধ করলো।কিন্তু কেউ মানতে পারলো না।সবাই তাকে দূর দূর করে…।

একমাত্র আয়ান ছাড়া সবাই তার বিপক্ষে।বিশেষ করে ফারহানা মানতে পারলেন না,হালিমা বজল মাস্টারের মেয়ে।নারীরা কখনো স্বামীর ভাগ কাউকে দিতে পারে না।হালিমাকে মেয়ে হিসেবে মানা,মানে বজল মাস্টারের ভাগ কাউকে দেয়া।তার উপরে হালিমা ওয়ারিশ হিসেবে সম্পত্তি পাবে,এটা কি করে হয়।তাই ফারহানা কিছুতেই হালিমাকে মেয়ে হিসেবে মানতে রাজী না।তার এক কথা,এসব উটকো ঝামেলা রাস্তার মেয়েকে কখনো তিনি মেয়ে হিসাবে মানবেন না।শুধু তিনি নয় পরিবার শুদ্ধ সবার এক কথা।তবে মাস্টারের ছোট ছেলে আয়ান সম্পূর্ণ আলাদা।সে বাবার দেয়া অনুরোধ রাখতে প্রস্তুত।সে হালিমাকে ছোট বোন হিসেবে মেনে নিয়েছে।
মাকে অনেক বুঝিয়েছে এই নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে।হালিমাকে এ বাড়িতে থাকতে দিতে। কিন্তু না,তিনি রাজী না।তাকে এ বাড়ি ছাড়তে হবে।শুধু তাই নয় ভবিষ্যতে যাতে এই অধিকার নিয়ে এ বাড়িতে না আসে তার জন্য হুশিয়ারী সংকেত দিলেন।হালিমা কেঁদে কেঁদে বলে,
মা আমায় তাড়িয়ে দিবেন না।আমার এই জনমে কেউ নেই।আমাকে একটু আশ্রয় দিন।বিনিময়ে সবকাজ করে দেব।
না না তা কখনো হবে না।এই বাড়িতে শুধু আমার ছেলে-মেয়ে থাকবে,আর কেউ না।
হালিমা মায়ের পা ছেপে ধরে কেঁদে কেঁদে আবার ও অনুরোধ করলো।এভাবে সে কয়েকবার অনুরোধ করলো।কিন্তু ফারহানা নাছোড় বান্দা,সে কিছুতেই হালিমাকে এ বাড়িতে থাকতে দিবে না। তাই কড়া ধমক দিয়ে লাত্তি মেরে পেলে দিলো।চোখের জল মুছতে মুছতে হালিমা উঠে দাঁড়ালো।চলে যেতে প্রস্তুত হলো।তখনি আয়ান বলল,

হালিমা তুমি এই বাড়িতে থাকবে।চলো ভিতরে চলো।মা তোমাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি।ওকে তাড়িয়ে দিওনা।তাহলে বাবার আত্মা কষ্ট পাবে।তুমি কী চাও বাবা পরকালে জাহান্নামে যাক।ওকে যদি অধিকার থেকে বঞ্চিত করি বাবা জাহান্নামী হবে।মা প্লিজ এই নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করো না।
ফারহানা আপাতত থামলেন।কিন্তু পরিবারের অন্য সদস্যরা থেমে থাকল না।বড় দুবউ মুখ ভ্যাংচিয়ে বলল,
নিজে খাও অন্যের ঘাড়ে বসে।এর উপরে আর একজনকে কে খাওয়াবে।
ভাবী তোমরা আমাদের পারিবারিক ব্যাপার নিয়ে কথা বলো না।রিযিকের মালীক আল্লাহ।।আমার চাকরীটা হয়ে যাক।ওর সব দায়িত্ব আমি পালন করবো।বোন মন খারাপ করো না।আমি আছি তোমার পাশে।
হালিমার চোখের পানি মুছে দিয়ে আয়ান তাকে ভিতরে নিয়ে বসতে দিলো।তারপর নিজের হাতে ভাত বেড়ে খেতে দিলো।
এসব দেখে দুবউয়ের গা জ্বলে উঠল।মনে মনে বলে,তোকে ফ্রিতে খেতে দিলেতো।সংসারের সব কাজ তোকে দিয়ে করাব।এই সেরেছে,হালিমাকে বসে থাকতে দিলেতো?একটার পর একটা কাজের ফরমায়েশ দিয়ে চলেছে।কাপড় কাঁচা, থালা বাসন ধোঁয়া, ঘরমোছা,টয়লেট পরিস্কার ইত্যাদি।হালিমা কোন প্রতিবাদ করছে না।সবকাজ করে দিচ্ছে।তবুও কারো মন পাচ্ছে না,কথায় কথায় ভাতের খোটা দিচ্ছে।কাজের মেয়ের মতো ব্যবহার করছে।ভালো কিছু খেতে দিচ্ছে না।বাসি ও পঁচা খাবার খেতে দিচ্ছে।একদিন আয়ান দেখল রান্নাঘরের মেঝেতে বসে হালিমা ভাত খাচ্ছে,আর চোখের জল ফেলছে।প্লেটে কিছু ভাত আর বাসি তরকারী।অথচ সেদিন গোস্ত বিরানি রান্না করা হয়েছিল।আয়ান এগিয়ে এসে বলল,

বোন এসব কী খাচ্ছ?
ভাত খাচ্ছি।
তা বুঝলাম।কিন্তু তোমাকে কী রোজ ওরা এসব খাবার খেতে দেয়?
জ্বি না মানে…।
আয়ান বুঝতে পেরেছে হালিমার দু:খের কারণ।কিন্তু তার কিছুই করার নেই।হালিমার পক্ষ হয়ে কিছু বলতে গেলে হয়তো তাকে তাড়িয়ে দেবে।তাই কাউকে কোনকিছু না বলে বোনকে শান্তনা দিলো।
বোন বুঝতে পেরেছি ওরা তোমাকে ভালো খেতে দিচ্ছে না।চিন্তা করো না।আমার চাকরীটা হয়ে যাক।তোমাকে আলাদা বাসায় রাখব।তখন খাওয়া পরার কোন অসুবিধা হবে না।এই সময় পর্যন্ত একটু কষ্ট কর।
ভাইয়া আপনার মতো একজন ভাই পেয়েছি।এটাই অনেক।আমার কোন কষ্ট নেই।এই বাড়িতে ছোট মেয়ে হয়ে থাকতে পেরেছি,এটাই যথেষ্ট।আর বেশি কিছু চাইনা।আপনি আমাকে নিয়ে কোন টেনশন করবেন না।
ঠিক আছে বোন আর কেঁদো না।
বোনের চোখের পানি মুছে দিলো ভাই।তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলো।মুহূর্তের মধ্যে হালিমা সকল দু:খ ভুলে গেল।তার চোখে মুখে ফুটে উঠল খুশির রেখা।যাক অন্তত একজন মানুষ তাকে এই পরিবারের “ছোট মেয়ে” হিসেবে মেনে নিয়েছে।

ঃসমাপ্তঃ


Screenshot 3
বিজ্ঞাপনঃ বই কিনুন, বই পড়ুন

0

Afsana Khanam

Author: Afsana Khanam

লেখক

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

গল্প চেয়ারম্যানের মেয়ে আফছানা খানম অথৈ

চেয়ারম্যানের মেয়ে আফছানা খানম অথৈ মেহেরপুর একটি সুন্দর গ্রাম।এই গ্রামে কিছু অদ্ভুত নিয়মকানুন চালু আছে,যা অন্যকোন গ্রামে নেই।এই গ্রামে নারীরা

গল্প মেয়েরা ও মানুষ আফছানা খানম অথৈ

গল্প মেয়েরা ও মানুষ আফছানা খানম অথৈ রানু বউ হয়ে এসেছে চার পাঁচ মাস হলো।এরই মধ্যে তার স্বামী স্কলারশিপ এর

গল্প মেয়ে সাক্ষী আফছানা খানম অথৈ

মেয়ে সাক্ষী আফছানা খানম অথৈ আবিদ হায়দার বেড়াতে এসেছে গ্রামে তার বন্ধু ফুয়াদ'র বাসায়।অবশ্য সে একা না,তার সঙ্গে আছে,বন্ধু সজল

গল্প বন্ধ্যা আফছানা খানম অথৈ

গল্প বন্ধ্যা আফছানা খানম অথৈ আলেয়া বউ হয়ে এসেছে চার বছর হলো।এখনো মা হতে পারেনি। এজন্য রীতিমতো তাকে কটু কথা

Leave a Reply