গল্প পুতুলের বিয়ে আফছানা খানম অথৈ

0

পুতুলের বিয়ে

আফছানা খানম অথৈ

পুতুলের বয়স সবেমাত্র বারোতে পড়েছে।এতটুকুন মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করেছে।পুতুলের মা-বাবার আর তর সইল না।সত্যি তাকে বিয়ে দিয়ে দিলো।পুতুলকে বউ সাজিয়ে শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে।
সে কী! আচমকা সে বলে উঠল,
তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?আমি যাব না।
সে কীরে মা,এটা শ্বশুর বাড়ি, যেতে হবে তো?
না মা আমি তোমাদের ছেড়ে কোত্থাও যাব না।
এমন কথা বলে না মা।মেয়েরা সারাজীবন বাবা-মায়ের কাছে থাকে না।স্বামীর বাড়িতে যেতে হয়।তাছাড়া স্বামীর বাড়ি হলো মেয়েদের আসল ঠিকানা।
মা সত্যি আমি তোমাদের ছেড়ে থাকতে পারবো না।
লক্ষি মা আমার এসব কথা বলে না।
মা তাহলে তোমরা ও চলো আমার সাথে।
ঠিক আছে মা,তুমি এখন যাও।কাল তোমার বাবা গিয়ে নিয়ে আসব।
সত্যি যাবে তো?
হ্যাঁ যাবে।

পুতুলের মন কিছুতে সাঁই দিচ্ছে না শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার জন্য।সে মা- বাবা ছোট ভাই দাদি সবার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।সবাই মিলে বুঝিয়ে তাকে কোনমতে গাড়িতে তুলে দিয়েছে।গাড়ি চলছে তার আপন গতিতে পুতুলের কান্না কিন্তু থামছে না।
এদিকে পুতুলকে বরন করার জন্য শ্বশুর বাড়ির লোকজন সবাই প্রস্তুত।গাড়ি গন্তব্যস্থানে পৌছতে ছেলে-মেয়েরা চিৎকার করে উঠল,
বাঃ কী মজা।নতুন বউ এসেছে, বউ এসেছে।
মহিলারা এগিয়ে আসল তাকে বরন করার জন্য।তাকে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হলো।তাকে বসানো হলো।সে লাজুক লতার মতো ঘোমটা দিয়ে বসে আছে।মহিলাদের সে কী ভীড়,নতুন বউকে দেখার জন্য সবাই হুলুস্থুল।কার আগে কে দেখবে যেন প্রতিযোগীতা চলছে।

পুতুলের কাছে এসব কিন্তু ভালো লাগছে না।সে চুপচাপ আনমনা হয়ে বসে বসে মা-বাবার কথা ভাবছে।শ্বশুর-শ্বাশুড়ি জামাই এসবের দিকে তার মন নেই।যাক বউ দেখার পর্ব শেষ হলো।সেই সঙ্গে রাতের খাওয়া ও শেষ হলো।যে যার মতো করে ঘুমাতে গেলো।পুতুল তার শয়ন কক্ষে বসে আছে।এই প্রথম সে মা-বাবাকে ছেড়ে কোথাও রাত কাটাচ্ছে।কেনো জানি বারবার মা-বাবার কথা মনে পড়ছে।কিছুতেই ভুলতে পারছে না।ভাবছে কখন তাদের কাছে ফিরে যাবে।ভাবনার অবসান হতে না হতে তার স্বামী রাতুল এসে তার পাশে দাঁড়ালো।তাকে দেখে সে জড়োসড়ো হয়ে সরে বসলো।জামাইর আর আর তর সইল না।বউয়ের গা ঘেষে বসলো।বউকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে চাইল।তখনি সে বলল,
প্লিজ আপনি আমার গায়ে হাত দিবেন না।আমার ভয় করে।
সে কী! আমি তোমার স্বামী।স্বামীকে ভয় করতে নেই।জয় করতে হয়।
কী করতে হয়?
জয় করতে হয়,ভালোবাসতে হয়।
না আমি ভালোবাসতে পারবো না।আমার ভয় করে।আপনি আমার কাছে আসবেন না।
প্লিজ লক্ষি বউ আমার কাছে এসো,ভয় কিসের?

পুতুল এখনো কিশোরি।পুতুল খেলার বয়স।বিয়ে স্বামী ভালোবাসা এসব বুঝবে কি করে?তাই স্বামীর ভালোবাসা তার কাছে অসহ্য মনে হচ্ছে।
ভোর হতে না হতে শুরু হলো ডাকাডাকি।ননদ জ্যা এসে বলল,
ভাবী আস রান্না ঘরে।
পুতুল বুঝতে পারছে না,কেনো তাকে ডাকছে।সে ফ্যালফ্যাল করে তাদের মুখপানে তাকিয়ে আছে।কোনকিছু বলার আগে তাকে ধরাধরি করে রান্নাঘরে নিয়ে গেল।
সে কী!সবাই পিঠা বানাচ্ছে।নতুন বউকে বসিয়ে দেয়া হলো পিঠা বানাতে।
তাকে পাক্কন পিঠার নঁকশা কাঠতে দেয়া হয়েছে। এটা গ্রামের রেওয়াজ নতুন বউকে পাক্কন পিঠা কাটতে হয়।যে পারে তার প্রশংসা করা হয়।আর যে পারে না,তাকে একগাদা কথা শুনতে হয়।আজ পুতুলের ও সেই অবস্থা,সে পিঠা কাটতে পারছে না।চুপচাপ সুঁচ হাতে বসে আছে।ঘরভর্তি মেহমান কারো গাল কি আর থেমে থাকে,একেকজন একেক কথা বলছে।একজন ভ্যাংচি কেটে বলল,
সে কী বউ,তোমার মা কাজ কাজকাম শিখায় নাই।বসে আছ ক্যান, পিঠা কাট।
আরেকজন বলে,
মনে হয় পিঠা কাটতে পারে না।তাই বসে আছে।
উপস্থিত সবাই হা হা হো হো করে হেসে উঠল।পুতুল কাঁদতে শুরু করলো।

একজন মেয়ে যখন বউ হয়ে আসে। তখন শ্বশুর বাড়ির সবকিছু তার কাছে নতুন, মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগে।আর শ্বশুর বাড়ির লোকজনের ও এ ক্ষেত্রে হেল্প লাগে।বিশেষ করে শ্বাশুড়ির ভুমিকা এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী।বউকে আপন করে নিতে হয়।কাজ না পারলে শিখিয়ে নিতে হয়।ভুলত্রুটি হলে ক্ষমা করতে হয়।কিন্তু আমাদের সমাজে সবকিছু উলটো।বউ আসতে না আসতে কড়া আইন জারী করা হয়, কাজের ফরমায়েশ দেয় হয়।শুধু তাই নয়, না পারলে,ভুলত্রুটি হলে কড়াকথা শুনতে হয়।আজ পুতুলের ক্ষেত্রে ও তাই হয়েছে।কোথাও নতুন বউকে একটু আদর আপ্যায়ন করবে তা না পিঠা কাটতে দিয়েছে।সে এসবের কি বুঝে।তাছাড়া এখনো সে কিশোর বধু সাজার বয়স হয়ে উঠেনি।তাই এসব মাথায় কাজ করছে না।সবকিছু বিরক্তিকর মনে হচ্ছে।ইচ্ছে করছে এসব ছেড়ে চলে যেতে।
বাবা আসতে ছুটে গেল তার কাছে।বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে আর বলছে,
বাবা আমি আর এ বাড়িতে থাকব না।
কেনো রে মা?
সবাই আমাকে বকাবকি করছে।
ও কিছু না মা।শ্বশুর বাড়ির লোকজন একটু আধটু বলে।
পুতুলকে তার বাবা নিয়ে আসল।দুদিন থাকার পর স্বামী তাকে আনতে গেল।
সে কী!তার এককথা শ্বশুর বাড়ির লোকজন ভালো না।সে ও বাড়িতে যাবে না।মা-বাবা অনেকে বুঝিয়ে তাকে পাঠিয়ে দিলো।শুরু হলো পুতুলের সংসার।

একদিন ভাত পুড়ে যায়,আরেকদিন তরকারী পুড়ে যায়,এরজন্য নিয়মিত তাকে শ্বাশুড়ির বকা শুনতে হয়।একদিন রাতুল তার মাকে বলে,
মা পুতুল ছোট মানুষ,বয়স কম, তাকে বকাঝকা না করে কাজকাম শিখিয়ে নিলে তো পার?
কী বললি,আমি তাকে কাজকাম শিখাব কেনো?তার মা কী করেছে?মেয়েকে কাজকাম না শিখিয়ে শ্বশুর বাড়িতে পাঠিয়েছে কেনো?
প্লিজ মা বুঝতে চেষ্টা কর।পুতুল ছোট মানুষ।ভুলত্রুটি হবে।তাই বলে তাকে এমন বকাঝকা করবে?
হয়েছে আর বউয়ের পক্ষ হয়ে ওকালতি করতে হবে না।
পুতুলের কিন্তু এখনো ছেলে মানুষী যায়নি।সে সুযোগ পেলে বাড়ির ছোট বাচ্চাদের সাথে বউ বউ খেলে।হাসি তামাসা গল্প সল্প করে।একদিন সে দেখলো সদর দরজার উঠানে মেয়েরা কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলেছে।সে ও তাদের সাথে যোগ হয়ে খেলছে।এই দৃশ্যটা শ্বাশুড়ির নজরে পড়লো।তখনি তিনি বললেন,
বউ এখনো তোমার আক্কেল জ্ঞান হয়নি?
কেনো মা কী হয়ছে?
কী হয়নি বলো?তুমি এখানে খেলতে এসেছ কেনো?আমার মান সম্মান আর কিছু থাকল না?চলো বাড়ি চলো।
পুতুলকে ঘরে এনে একগাদা বকা দিলো।কেনো সে মেয়েদের সাথে খেলতে গেল।পুতুল কোনকিছু না বলে নীরবে সবকিছু হজম করে নিলো।

পুতুল মা হতে চলেছে।এখন তার ভালো থাকা,আগের তুলোনায় একটু বেশি খাওয়ার দরকার।কারণ সে এখন একা না,তার গর্ভে সন্তান আসছে।কিন্তু সে কী! শ্বাশুড়ি তাকে বেশি খেতে দিচ্ছে না।কারণ বেশি খেলে নাকি সন্তান বড় হয়ে যাবে।ডেলিভারী হতে কষ্ট হবে।তাকে রেস্ট নিতে দিচ্ছে না।কারণ কাজকাম না করলে বাচ্চা ভালোভাবে ডেলিভারী হবে না।ডাক্তারের কাছে চেকাপ করতে নিচ্ছে না।ডাক্তার ভুলভাল শিক্ষা দিবে।তাছাড়া আগেকার দিনে ডাক্তার ছিলো না।তো কি হয়েছে বাচ্চা হয়নি?পুতুল এসবের কিছুই বুঝে না।শ্বাশুড়ি যা বলছে তাই সঠিক বলে মেনে নিয়েছে।একদিন এক স্বাস্থ্যকর্মী তাদের বাড়িতে আসে।তার নাম ঠিকানা লিখে নেয় এবং তাকে উপজেলা সদরের মা মনি হাসপাতালে গিয়ে চেকাপ করতে বলে।কিন্তু শ্বাশুড়ি রাজী হয় না।তাকে যেতে দেয়নি।স্বাস্থ্যকর্মী অনেক বুঝিয়েছে কোন লাভ হয়নি।তার এককথা আগেকার দিনে ডাক্তার ছিলো না।তো বাচ্চা হয়নি?এখনো হবে কোন সমস্যা হবে না।

পুতুলের শরীর স্বাস্থ্য কিন্তু ভালো যাচ্ছে না।আস্তে আস্তে শুকিয়ে যাচ্ছে।রক্তস্বল্পতা দেখা দিয়েছে।মাথা ঘুরাচ্ছে, চোখে মুখে অন্ধকার লাগছে,হাত পা ঝিনঝিন করছে।এক্ষণি ডাক্তার দেখা দরকার।তার আয়রন,ক্যালসিয়াম খাওয়া দরকার।কিন্তু কে শুনে কার কথা।স্বামী শ্বাশুড়ি কেউ এসবের কেয়ার করছে না।
পুতুল কিন্তু থেমে নেই।অসুস্থ শরীর নিয়ে ও কাজকাম করছে।সময়মতো তার প্রসব ব্যথা শুরু হলো।একজন ধাত্রী ডাকা হলো।সে দেখেশুনে বললেন,
সব ঠিকঠাক আছে।ব্যথা বাড়লে বাচ্চা হবে।একদিন দুদিন কেটে গেল। ব্যথা একবার বাড়ে আবার কমে।কিন্তু বাচ্চা হচ্ছে না।এক সময় পুতুল অজ্ঞান হয়ে পড়ে।দ্রুত তাকে উপজেলা সদরের মা মনি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।গাইনি ডাক্তার নুসরাত ফাহরিয়ার অনেক চেষ্টার পর তার একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তান হলো কিন্তু পুতুলকে বাঁচানো গেলো না।সে মারা গেল।মা-বাবা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।ডাক্তার নুসরাত বললেন,
এখন কাঁদছেন কেনো?এত অল্প বয়সে মেয়েকে বিয়ে দিলেন কেনো?
কেনো কি হয়েছে ম্যাডাম?
কী হয়নি বলেন,অল্প বয়সে মা হওয়ার কারণে তাকে বাঁচানো গেলনা। তার উপরে রক্তস্বল্পতা, ক্যালসিয়াম আয়রনের ঘাটতি ছিলো।আঠারো বছর পূর্ণ না হতে মেয়েদের বিয়ে দেয়া উচিৎ নয়।কারণ এ বয়সে নারীর শরীরে পরিপূর্ণতা আসে না।মা হওয়াটা ও রিক্স।যার জ্বলন্ত প্রমাণ আজ চোখের সামনে দেখলেন।।পুতুলের মৃত্যুর জন্য আপনারা দায়ী।আপনাদের পুলিশে দেয়া দরকার।
ম্যাডাম আমরা এতকিছু বুঝি নাই।তাই পুতুলেরে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়েছি।আমাদেরকে মাফ করে দিন।
আপনারা আপনাদের ভুল বুঝতে পেরেছেন এটাই যথেষ্ট। প্রতিজ্ঞা করুণ আর কখনো এমন ভুল করবেন না।
ম্যাডাম আমরা প্রতিজ্ঞা করে বলছি।আর এমন ভুল করুম না।আর কেউ যাতে পুতুলের মতো অল্প বয়সে বিয়ে না দেয়,সেসব কথা বুঝিয়ে বলব ইনশাআল্লাহ।

ঃসমাপ্তঃ


Screenshot 3
বিজ্ঞাপনঃ বই কিনুন, বই পড়ুন

0

Afsana Khanam

Author: Afsana Khanam

লেখক

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

গল্প চেয়ারম্যানের মেয়ে আফছানা খানম অথৈ

চেয়ারম্যানের মেয়ে আফছানা খানম অথৈ মেহেরপুর একটি সুন্দর গ্রাম।এই গ্রামে কিছু অদ্ভুত নিয়মকানুন চালু আছে,যা অন্যকোন গ্রামে নেই।এই গ্রামে নারীরা

গল্প মেয়েরা ও মানুষ আফছানা খানম অথৈ

গল্প মেয়েরা ও মানুষ আফছানা খানম অথৈ রানু বউ হয়ে এসেছে চার পাঁচ মাস হলো।এরই মধ্যে তার স্বামী স্কলারশিপ এর

গল্প মেয়ে সাক্ষী আফছানা খানম অথৈ

মেয়ে সাক্ষী আফছানা খানম অথৈ আবিদ হায়দার বেড়াতে এসেছে গ্রামে তার বন্ধু ফুয়াদ'র বাসায়।অবশ্য সে একা না,তার সঙ্গে আছে,বন্ধু সজল

গল্প বন্ধ্যা আফছানা খানম অথৈ

গল্প বন্ধ্যা আফছানা খানম অথৈ আলেয়া বউ হয়ে এসেছে চার বছর হলো।এখনো মা হতে পারেনি। এজন্য রীতিমতো তাকে কটু কথা

Leave a Reply