কাদিয়ানীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস: কিছু মিথ্যাচারের জবাব
কাদিয়ানী প্রথম জীবনে হানাফী ছিলো। আর এটাই স্বাভাবিক। কারণ, তার জন্মই হয়েছে হানাফি পরিবারে। তখন তো আহলে হাদিস পরিবার ছিলোই না।
হানাফী থাকাকালীন সে তার বক্তদেরকে হানাফী মাযহাবের উপর আমল করার উপদেশ দিত এবং নিজেকেও হানাফি প্রচার করতো। হানাফী মাযহাব নিয়ে তার কিছু কথা পাওয়া যায়, সবগুলো এই সময়ের।
এরপর একটা সময় সে লা-মাযহাবী হয়ে যায় অর্থাৎ হানাফিদের সাথেও তেমন একটা সম্পর্ক নেই আহলে হাদিসের সাথেও তেমন একটা সম্পর্ক নেই। সে নিজের মতো করে চলতে থাকে। [সীরাতে মাহদী: ১/৩৩৪]
এরপর তার ভক্তদের অনুরোধে বাধ্য হয়ে আহলে হাদিস আলেম হুসাইন বাটলভীর সাথে মুনাজারা করতে গিয়ে হুসাইন বাটালবীর গরম বক্তব্য শুনে প্রভাবিত হয়ে পড়ে। এরপর সে আহলে হাদিস মতবাদের প্রতি পুরোপুরি ধাবিত হয়ে যায়।
অতঃপর আহলে হাদিস ওলামাদের সাথে তার গভীর সুসম্পর্ক তৈরি হয়। তৎকালীন বিশিষ্ট আহলে হাদিস হুসাইন বাটালভী তার প্রাণের দোস্তে পরিণত হয়। এমনকি সে আহলে হাদিস হওয়ার সুবাদে ৫০ বছর বয়সে আহলে হাদীস পরিবারের কুমারী মেয়ে বিয়ে করার সুযোগ পায়। আহলে হাদিস আলেমরাই তার বিয়ে পড়িয়েছে, আহলে হাদিস আলিমরাই তার বিয়ের ওকালতি করেছে। [সীরাতে মাহদী: ১/৫১]
আহলে হাদিস হওয়ার পর সে যেন মুক্ত বিহঙ্গ! কাজেই সে ধীরে ধীরে নিজেকে ইমাম মাহদী, ঈসা মসীহ, এক পর্যায়ে খোদ নবীই দাবি করে বসে।
এরপর তার কাফের হওয়ার বিষয়ে সর্বপ্রথম (১৮৮৪) ফতোয়া দেয় হানাফী আলেম মুফতি মুহাম্মদ লুধিয়ানবী রহ.। [ফাতাওয়ায়ে কাদেরিয়্যাহ: ২০]
তখনকার সময়ে আহলে হাদিস আলেম হুসাইন বাটালভী তার ইশা’তুস সুন্নাহ পত্রিকায় কাদিয়ানীর ভরপুর প্রশংসা করতো। কাজেই মুফতি মুহাম্মদ লুধিয়ানবীর পক্ষ থেকে কাফের ফতোয়া দেখে আহলে হাদিস আলেম কাদিয়ানীর পরম বন্ধু হুসাইন বাটালবী তাকে কাফের স্বীকৃতি দেওয়ার পরিবর্তে মুফতি সাহেব এর ফতোয়ার বিরোধীতা শুরু করে।
এমনকি ১৮৮৭ সালে (কাদিয়ানীকে কাফের ঘোষণার তিন বছর পরেও) গোলাম আহমদ কাদিয়ানী সপরিবারে বাটালবীর বাসায় মেহমান হয়েছিল। তারীখে আহমদিয়াতের গ্রন্থাকার লিখেন,
جون 1887 ء میں قادیان سے انبالہ جاتے هوئے حضور ( مرزا قادیانی ) اهل وعیال سمیت مولوی محمد حسین صاحب بٹالوی کے مکان پر ایک رات ٹهرے تهے اور مولوی صاحب نے حضرت اقدس اور آپ کے اهل بیت کی پر تکلف دعو ت بهی کی تهی
১৮৮৭ সালের জুন মাসে কাদিয়ান শহর থেকে আম্বালা যাওয়ার পথে মির্জা কাদিয়ানী সপরিবারে মৌলবী মুহাম্মদ হুসাইন বাটালবির ঘরে এক রাত অবস্থান করেন এবং মৌলবি সাহেব হযরত এবং তার পরিবারকে ভদ্রতা স্বরূপ আবার আসার দাওয়াতও করেছিলেন। [তারীখে আহমদিয়াত: ২/১৩৭]
এরপর যখন দল মত নির্বিশেষ সকল আলেম-ওলামা কাদিয়ানীকে কাফের ঘোষণা দেওয়া শুরু করলো, তখন হুসাইন বাটালবীও কাদিয়ানীকে কাফের ফতোয়া দিতে বাধ্য হলো। কিন্তু সে কিছুদিন পর (১৮৮৯ সালে) তার ফতোয়া থেকে আবার রজু/প্রত্যাহার করল। এবং ডিসট্রিক ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গিয়ে সিগনেচার করলো যে সামনে থেকে আমি কখনো কাদিয়ানীকে মিথ্যুক, দাজ্জাল, কাফের ইত্যাদি বলবো না। [মাগরিব মে তাবলীগে ইসলাম: ২১, যরূরতে মুজাদ্দিদ: ৩৩]
১৮৮৪ সালে কাদিয়ানীকে হানাফী আলেম মুফতি মুহাম্মদ লুধিয়ানভী কাফের ফতোয়া দেয় আর ১৮৮৪ সালেই কাদিয়ানীর গ্রন্থ ‘বারাহীন আহমদিয়া’ প্রকাশিত হয়।
এই গ্রন্থ সম্পর্কে আহলে হাদিস আলেম হুসাইন বাটালবী লিখেন
هماری رائے میں یہ کتاب اس زمانہ اور موجوده حالت کی نظر سے ایسی کتاب هے جس کی نظیر آج تک اسلام میں شائع نہیں هوئ آئنده کی خبر نہیں اور اس کا مولف بهی اسلام کی مالی جانی وقلمی ولسانی نصرت میں ایسا ثابت قدم نکلا هے جس کی نظیر پہلے مسلمانوں میں کم پائ جاتی هے همارے ان الفاظ کو کوئ ایشیائ مبالغہ سمجهے تو هم کو کم سے کم ایک ایسی کتاب بتا دے جس میں جملہ فرق هائے مخالفین اسلام سے اس زور وشور سے مقابلہ پایا جاتا هو
আমার মতে এই কিতাব এই জামানা এবং বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এমন একটি কিতাব যার নজীর (এমন কিতাব) ইসলামের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত দ্বিতীয়টি প্রকাশিত হয়নি। ভবিষ্যতে হয় কিনা তা জানি না। আর এই কিতাবের লেখক (কাদিয়ানীও) ইসলামের জন্য মালী, জানী, কলমী, লিসানী খেদমতে এমন অটল ও অবিচল প্রমাণিত হয়েছে যার উপমা প্রথম যুগের মুসলমানদের মধ্যেও খুব কমই পাওয়া যায়। আমার বলা এই কথাগুলোকে কেউ অতিরঞ্জিত মনে করলে সে যেন আমাদেরকে এমন একটি কিতাবের নাম বলুক যার মধ্যে ইসলামের শত্রুদের এমন জোরেশোরে মোকাবেলা পাওয়া যায়। [রিসালাহ ইশা’আতুস সুন্নাহ: ৭/১৬৯]
শুধু হুসাইন বাটালভী নয় বরং আহলে হাদিসের শাইখুল কুল ফিল মৌলভী নজীর হুসাইনও এই কিতাবের ভরপুর প্রশংসা করেছিলো। একইভাবে আহলে হাদীসের অন্য একজন আলেম মৌলভী আব্দুল্লাহ গজনবীও প্রথমে মির্জা কাদিয়ানীর খপ্পরে পড়ে। এমনকি সে এ পর্যন্ত বলে দিয়েছে যে, কাদিয়ান এর মধ্যে এক নূর অবতীর্ণ হয়েছে; কিন্তু আমার সন্তানেরা এই নূর থেকে মাহরুম থেকে গেলো! [মুজাদ্দিদে আ’যম: ২/৮৭৭, আরবা’ঈন: ৪/১২৩, রূহানী খাযায়েন: ১৭/৪৬৪]
📗 একটি আপত্তি ও সংক্ষিপ্ত জবাব
দেখা যায় রশিদ আহমদ গাংগুহী রহ. তাকে এক জায়গায় নেক মুসলমান বলেছিলেন।
জবাব: এর কারণ হচ্ছে, কাদিয়ানী প্রথমে তুলনামূলক ভালোই ছিলো। কাজেই তাকে ভালো বলা হয়েছিল।
আর বাস্তবেই মির্জা কাদিয়ানীর নবুয়তের দাবিটা একেবারে শুরুতে আসেনি বরং সে নবুয়তের দাবির পূর্বে বিভিন্ন ধরনের দাবি করেছিল, কখনো ইলহামপ্রাপ্ত হওয়ার দাবি, করেছিল কখনো মুজাদ্দিদ, কখনো মুহাদ্দিস, কখনো মাসীলে মাসীহ, কখনো প্রতিশ্রুত মাসীহ, কখনো ছায়া নবী। এ ধরনের বিভিন্ন মিথ্যা দাবি করার পরেই সে নবুওয়াত ও রিসালাতের দাবি করেছিল।
তার এই সমস্ত কুফরী দাবি সম্পর্কে গাংগুহী রহ. প্রথমে সবিশেষ অবহিত ছিলেন না। আর এটাই স্বাভাবিক। কারণ, তখন তো বর্তমানের মত যোগাযোগ ব্যবস্থা তো উন্নত ছিল না যে সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার সকল বিষয়ে আগে-গোড়া জেনে যাবেন। কিন্তু পরে যখন অবহিত হয়েছেন, তখন তিনিও তাকে কাফের ফতোয়া দিয়েছিলেন।
চলবে
লুবাব হাসান সাফওয়ান
অনেক কিছু জানতে পারলাম