গল্প অভিশাপ আফছানা খানম অথৈ

0

অভিশাপ

আফছানা খানম অথৈ

জোলেখা বিবির একটা ছেলে হওয়ার পর তার স্বামী নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।কোথায় গেছে কি করছে কেউ বলতে পারছে না।অনেক বছর পর জানতে পারেন স্বামী আর একটা বিয়ে করেছে।সেখানে স্ত্রী ছেলে মেয়ে নিয়ে সে দিব্যি সুখে আছে।অথচ জোলেখা তার একমাত্র ছেলেকে নিয়ে খুব কষ্টে আছে।পরনে নেই কাপড় পেটে নেই ভাত।কোন রকমে লোকের বাড়িতে কাজকর্ম করে ছেলের মুখে দুমুঠো অন্ন তুলে দিচ্ছে।একদিন সে তার স্বামীর কাছে শহরে চলে যায়।স্বামীর হাতে পায়ে ধরে তার দেখভাল করার জন্য।বেশিকিছু না,দুবেলা দুমুঠো অন্ন দিলে,আর তার কাছে থাকার অধিকার দিলে হবে।কিন্তু স্বামী মানলে তো?সে অস্বীকৃতি জানায়,তাকে দূরদূর করে তাড়িয়ে দেয়।কি আর করা সে আবার গ্রামে ফিরে আসে।তারপর একমাত্র ছেলে রায়হানকে প্রাইমারী স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করায়।জোলেখার ইচ্ছা সে তার ছেলেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করাবে,মানুষের মতো মানুষ করবে।যত কষ্ট হোক হবে,তবুও ছেলেকে বড় বিদ্যান করবে ইনশাল্লাহ।

যাক জোলেখা সারাদিন লোকের বাড়িতে কাজ করে।রাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে ছোট্ট কুটিরে ঘুমিয়ে পড়ে।আজকাল বড় লোকের কেনো জানি স্বার্থপর।কাজের বুয়াদের তেমন পারিশ্রমিক দিতে চাই না।দুনিয়ার যত বিলাসিতা আসে সবকিছুর জন্য খরচ করে।শুধু কাজের বুয়াদের পারিশ্রমিকের বেলায় অজুহাত দেখায়,হাতে টাকা নেই,ব্যবসায় লস,বেতন পায়নি,সংসারের টানা পোড়ন,এত টাকা দিতে পারব না। কাজ করলে কর,নইলে বিদায় হও।কি আর করা গরীর লোক যাবে কোথায়?বাধ্য হয়ে সামান্য পারিশ্রমিকে ও তারা কাজ করে।জোলেখাও ন্যায্য মজুরী পাচ্ছে না। তবুও সামান্য পারিশ্রমিকে ও কাজ করে শুধু পেটে দুমুঠো অন্ন তুলে দেয়ার জন্য।সামান্য পারিশ্রমিক যা পাচ্ছে তা ছেলের পড়ালেখার পেছনে ব্যয় করছে।নিজের জন্য কিছু রাখছে না।

রায়হান পড়ালেখায় খুব ভালো।সে পঞ্চম শ্রেনীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায়।হেডমাস্টার খুব খুশি হয়।জোলেখাকে সাধুবাদ জানায়।রায়হানকে ভালোভাবে পড়ালেখা করার জন্য নির্দেশ দেয়।
সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে রায়হান একসময় পড়ালেখা শেষ করে। মাস্টার্স ফাস্ট ক্লাশ পায়।মায়ের মন আনন্দে ভরে উঠে।মা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে খবু দোয়া করে।আল্লাহ যেন তার ছেলেকে বড় একটা চাকরী দেয়।মায়ের খুশির অন্ত নেই।এবার বুঝি তাদের দু:খ ঘুচবে।পাড়া প্রতিবেশি গ্রামবাসি,শিক্ষক মহোদয় সবাই খুশি।সবাই রায়হানের জন্য প্রাণভরে দোয়া করলেন।
রায়হান মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিলেন।মা সন্তানের কপালে চুমু খেলেন।প্রাণভরে দোয়া করলেন।আল্লাহ যেন তার সন্তানকে সুস্থ রাখে ছহিছালামতে গন্তব্যস্থানে পৌছায়।ছেলে চলে যাচ্ছে মায়ের চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছে।ছেলে মায়ের চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,
মা কেঁদো না।তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না। আরএকটু ধৈর্যধর। আগে আমার চাকরী হোক। তারপর তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাব।
দোয়া করি বাবা তাই যেন হয়।
ছেলে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিলো।মা দাঁড়িয়ে রইল।যতক্ষণ না ছেলে চোখের আঁড়াল হলো।

রায়হায় মেসে উঠল।আপাতত কিছু টিউশনি নিলো।আর বি সি এস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি….।
মাস শেষ মায়ের জন্য কিছু টাকা পাঠালো।মায়ের মন খুশিতে ভরে উঠল।ছেলের জন্য প্রাণভরে নামাজ পড়ে দোয়া করলো।যাক মায়ের দোয়া আল্লাহপাক কবুল করলেন।রায়হান বি সি এস ক্যাডার হয়ে গেল।সে শিক্ষা অফিসার পদে কর্মস্থলে যোগ দিলো।চাকরী হওয়ার পর তার কেমন জানি পরিবর্তন হয়ে গেল।উচু লেভেলের বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে মিশতে গিয়ে সে মায়ের কথা ভুলে যাচ্ছে….।
তেমন একটা খোজ খবর নিচ্ছে না।মা একদিন ফোন করে বলল,
বাবা রায়হান কেমন আছিস?
বিরক্তস্বরে জবাব দিলো রায়হান,
ভালো আছি।মা তুমি যে কি যখন তখন ফোন কর কেনো?
কি যে বলছ বাবা,যখন তখন কই ফোন করলাম।আজ কদিন পর ফোন করলাম।তাছাড়া তোকে তো আজকাল ফোনে পাওয়ায় যায় না।যখনি ফোন করি বলে বিজি।তোর কি হয়েছে বাপ?চাকরী পেয়ে মাকে ভুলে গেছিস বুঝি?
কি যে বলো না মা।এখন রাখি। আমার অনেক কাজ আছে।
হ্যালো রায়হান হ্যালো।তুই কবে আসবি?তোকে দেখতে খুব ইচ্ছা করছে।
কে শোনে কার কথা।রায়হান ফোন কেটে দিয়েছে সেই কখন।তবুও মা তার মনের জমানো কথাগুলো বলছে।সন্তানকে এক পলক দেখার জন্য মায়ের যে আকুলি বিকুলি তা প্রকাশ করছে।কিন্তু সন্তান বুঝলেতো।
আস্তে আস্তে রায়হান মায়ের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।মায়ের খোজ খবর তেমন একটা নিচ্ছে না।মাস শেষ কিছু টাকা মায়ের জন্য পাঠিয়ে দেয় এটাই যথেষ্ট। এর বাইরে মায়ের কোন দায়িত্ব সে পালন করছে না।

এক সময় সে ডিপুটি ম্যাজেট্টেট এর মেয়েকে বিয়ে করে।অফিসে তার সুযোগ সুবিধা বেড়ে যায়।বাঁহাতের কাজ করতে এখন তার কোন অসুবিধে হয় না।দুহাতে ঘুষ খায়।ঘুষের টাকায় অতি অল্প সময়ের মধ্যে গাড়িবাড়ি অনেক কিছু করে ফেলে।কিন্তু মায়ের সাথে এখন আর তার যোগাযোগ নেই।টাকা পয়সা ও পাঠাচ্ছে না।মা সেই আগের মতো লোকের বাড়িতে কাজকর্ম করে কোন রকমে দিন গুরজান করছে।সে সন্তানকে মা দশ মাস দশদিন পেটে ধরেছে।মাথার ঘাম পায়ে পেলে মানুষ করেছে।নিজে না খেয়ে সন্তানকে খাইয়েছে।সে সন্তান আজ মায়ের দেখভাল করছে না।অথচ সন্তানের টাকা পয়সার অভাব নেই।সামান্য কটা টাকা না হয় মায়ের জন্য ব্যয় করবে এ আর এমন কি?
এরা সন্তান নয়,সন্তান নামের কলঙ্ক।মানুষরুপী অমানুষ।এদের সাজা দেয়া দরকার।কিন্তু কে তার খবর রাখে।এতকিছুর পর ও মায়ের মন প্রবোধ মানছে না।সন্তানকে এক পলক দেখার জন্য আকুলি বিকুলি….।

একদিন মা রায়হানের গ্রামের বন্ধু সজলকে নিয়ে চলে আসে শহরে।ছেলের বাসার সামনে এসে দেখেন গেটের সামনে দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে।তাকে বললেন,
আমার ছেলে কি বাসায় আছে?
কে আপনার ছেলে?
রায়হান আমার ছেলে।ওকে বলো তার মা এসেছে?
দারোয়ান ফোন করে বলল,
স্যার আপনার মা এসেছে।ভিতরে ডাকব?
আমার মা নেই, মারা গেছে,যাকে তাকে মা বললে হবে?গাঢ়ধাক্কা দিয়ে বের করে দাও।
দারোয়ানের কাজ দারোয়ান করেছে।জোলেখা বিবিকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়ে বলল,
স্যার বলেছে।উনার মা নেই। মারা গেছে।আপনি মিথ্যে বলছেন কেনো?
মায়ের চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছে।তিনি বহুকষ্টে উঠে দাঁড়ালেন।তারপর কেঁদে কেঁদে বললেন,
বাবা আমি মিথ্যে বলছি না। সত্যি বলছি রায়হান আমার ছেলে।তাকে বলো আমি থাকতে আসিনি।কিছু নিতে ও আসিনি।আমি শুধু এক পলক দেখতে এসেছি।অনেক বছর হলো তাকে দেখিনা।তার মুখটা এক পলক দেখে চলে যাব।
দারোয়ানের কেনজানি মায়া হলো।সে ভিতরে গিয়ে মায়ের কথাগুলো পূনরাবৃত্তি করলো।কিন্তু পাষণ্ড সন্তানের দিল নরম হলো না।সে দারোয়ানের উপর চড়াও হয়ে বলল,
বললাম না উনি আমার মা না।আমার মা মারা গেছে।যেকেউ মা বললে হবে?তাড়াতাড়ি ওই মহিলাকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দাও।
দারোয়ান বসের নির্দেশ অনুযায়ী মাকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিলো।
দুখিনী মা কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলো।দেখতে পেলো না এক পলক সন্তানকে।তবুও সন্তানের প্রতি কোন অভিযোগ নেই।কিন্তু আল্লাহপাক সহ্য করলে তো?
মায়ের পায়ের নিজে সন্তানের বেহেশত এটা আমার কথা নয়, কোরানের কথা।এই কোরানের বিধান অমান্য করলে নির্ঘাত জাহান্নাম।আজ সেই মাকে অস্বীকার করেছে সন্তান।তাকে এমনি ছেড়ে দেবেন আল্লাহপাক?ইহকাল পরকাল দুকালে তার সাজা হবে।এই দুনিয়াতে হবে পতন,অপমান অপদস্থ,আর পরকালে পাবেন জাহান্নাম।
কিছুদিন যাওয়ার পর ঘুষের দায়ে তার চাকরী চলে যায়।চাকরী হারানোর শোকে সে স্ট্রোক করে।তার হাত পা অবশ হয়ে যায়,শুধু তাই নয় কন্ঠস্বর ও বন্ধ হয়ে যায়।দেশের ডাক্তার পরামর্শ দেয় তাকে বিদেশে নিয়ে যেতে।দ্রুতগতিতে তাকে বিদেশে নিয়ে যাওয়া হয়।বিদেশে চিকিৎসা ব্যয়বহুল।তার জমানো টাকা পয়সা গাড়িবাড়ি সব শেষ হয়ে যায়।কিন্তু তার চিকিৎসা হয় না।এক সময় স্ত্রী ছেলে মেয়ে তাকে দেখভাল করে না।রাস্তায় ফেলে দিয়ে যায়।অর্ধাহারে অনাহারে মশামাছির কামড়ে এক সময় সে মারা যায়।এক সময় সে তার মাকে ফেলে দিয়েছে।আজ তার সন্তানেরা তাকে ফেলে দিয়েছে।এটা মায়ের “অভিশাপের” ফল। যে সন্তান মাকে কষ্ট দেবে, কাঁদাবে, শেষ বয়সে দেখভাল করবে না।সে ইহকাল পরকাল কোন কালে সুখী হবে না।

ঃসমাপ্তঃ


Screenshot 3
বিজ্ঞাপনঃ বই কিনুন, বই পড়ুন

0

Afsana Khanam

Author: Afsana Khanam

লেখক

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

গল্প চেয়ারম্যানের মেয়ে আফছানা খানম অথৈ

চেয়ারম্যানের মেয়ে আফছানা খানম অথৈ মেহেরপুর একটি সুন্দর গ্রাম।এই গ্রামে কিছু অদ্ভুত নিয়মকানুন চালু আছে,যা অন্যকোন গ্রামে নেই।এই গ্রামে নারীরা

গল্প মেয়েরা ও মানুষ আফছানা খানম অথৈ

গল্প মেয়েরা ও মানুষ আফছানা খানম অথৈ রানু বউ হয়ে এসেছে চার পাঁচ মাস হলো।এরই মধ্যে তার স্বামী স্কলারশিপ এর

গল্প মেয়ে সাক্ষী আফছানা খানম অথৈ

মেয়ে সাক্ষী আফছানা খানম অথৈ আবিদ হায়দার বেড়াতে এসেছে গ্রামে তার বন্ধু ফুয়াদ'র বাসায়।অবশ্য সে একা না,তার সঙ্গে আছে,বন্ধু সজল

গল্প বন্ধ্যা আফছানা খানম অথৈ

গল্প বন্ধ্যা আফছানা খানম অথৈ আলেয়া বউ হয়ে এসেছে চার বছর হলো।এখনো মা হতে পারেনি। এজন্য রীতিমতো তাকে কটু কথা

Leave a Reply