তাহকীক-তাখরীজসহ ও সম্পাদিত ‘ফাযায়েলে আমাল’ নামক কিতাবের ভূমিকাতেই ধোঁকাবাজি | ও আমাদের খণ্ডন —১
📒 বিরোধীদের আপত্তি
আজকে কেবল শুরুর একটি ভুল নিয়ে আলোচনা পেশ করার চেষ্টা করছি। আর সেটা কি কেবলই ভুল নাকি খেয়ানত সেটা বিজ্ঞ পাঠকগণই বিবেচনা করবেন।
মাওলানা যাকারিয়া সাহারানপুরি তার উর্দু কিতাবের ভূমিকায় লিখেছেন:
حمد وصلوٰۃ کے بعد، مجد دین اسلام کے ایک درخشندہ جوہر اور علماء و مشائخ عصر کے ایک آبدار گوہر کا ارشاد ہے کہ تبلیغ دین کی ضرورت کے متعلق مختصر طور پر چند آیات واحادیث لکھ کر پیش کروں، چونکہ مجھ جیسے سیہ کار کے لئے ایسے ہی حضرات کی رضا و خوشنودی وسیلہ نجات اور کفارہ سیئات ہو سکتی ہے
দ্রষ্টব্য: ফাযায়েলে আমাল, ফাযায়েলে তাবলীগ, মাকতাবায়ে যিকরা, ইসলামাবাদ, পাকিস্তান, ২০১৫ খ্রিস্টাব্দ, পৃষ্ঠা ৭১০
তাবলীগী কুতুবখানা থেকে প্রকাশিত ‘ফাযায়েলে আমাল’-এর ভূমিকায় উপরিউক্ত অংশের যে অনুবাদ করা হয়েছে:
‘’আল্লাহ তায়ালার তারীফ ও প্রশংসা বা’দ ওলামায়ে কেরাম ছুফীকুল শিরোমণি, মোজাদ্দেদে দ্বীন, হজরত মাওলানা ইলিয়াছ (রহঃ) আমাকে আদেশ করেন যে, তাবলীগে দ্বীনের প্রয়োজন অনুসারে কোরআন ও হাদীছ অবলম্বনে যেন একটি সংক্ষিপ্ত বই লিখি। এত বড় বুজুর্গের সন্তুষ্টি বিধান আমার পরকালের নাজাতের উছিলা হইবে মনে করিয়া আমি উক্ত কাজে সচেষ্ট হই।‘’
দ্রষ্টব্য: ফাজায়েলে আ’মাল; অনুবাদ: মাওলানা মোঃ ছাখাওয়াত উল্লাহ (যাকারিয়া সাহারানপুরি কর্তৃক সরাসরি দোয়া ও এজাজত প্রাপ্ত এবং দিল্লী ও কাকরাইলের মুরুব্বিয়ানে কেরামের এজাজতে লিখিত); পৃষ্ঠা নং ৫; প্রকাশক: তাবলীগী ফাউন্ডেশন; পরিবেশক: তাবলীগী কুতুবখানা; প্রকাশকাল: সংশোধিত সংস্করণ, মার্চ ১৯৮৯
দারুল কিতাব থেকে প্রকাশিত ‘ফাযায়েলে আমাল’-এর ভূমিকায় উপরিউক্ত অংশের যে অনুবাদ করা হয়েছে:
‘’হামদ ও সালাতের পর। মুজাদ্দেদীনে ইসলাম ও যমানার ওলামা-মাশায়েখের উজ্জ্বল রত্ন (হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইলিয়াস রহঃ) আমাকে তবলীগে দ্বীনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু আয়াত ও হাদীস লিখিয়া পেশ করিতে আদেশ করেন।
এইরূপ বুযুর্গগণের সন্তুষ্টি হাসিল করা আমার মতো গোনাহগারের জন্য গোনাহ-মাফী ও নাজাতের ওসীলা- এই আশায় দ্রুত রচনা করতঃ এই উপকারী কিতাবখানি খেদমতে পেশ করিতেছি।‘’
দ্রষ্টব্য: ফাযায়েলে আমাল; অনুবাদ: মুফতী মুহাম্মাদ উবাইদুল্লাহ; নজরে ছানী ও সম্পাদনা: হাফেজ মাওলানা যুবায়ের; মাওলানা রবিউল হক; পৃষ্ঠা নং ৭; প্রকাশক: দারুল কিতাব; প্রকাশকাল: অক্টোবর ২০০১
এরপর এখন পর্যন্ত সর্বশেষ অনুবাদ- যেটা ‘দারুল ফিকর’ থেকে বের হয়েছে। এর ভূমিকা ও ফাজায়েলে তাবলীগ অংশের অনুবাদ করেছেন মাওলানা আমিরুল ইসলাম লোকমান। আর এই অংশের তাহকীক-তাখরীজ করেছেন মাওলানা আহমাদ ইউসুফ শরীফ ও মাওলানা ইউসুফ ওবায়দী। আর পুরো বইটির সম্পাদক হিসাবে রয়েছেন মাওলানা ইউসুফ ওবায়দী। আসুন এখন আমরা তাদের অনুবাদে নজর দেই:
‘’হামদ ও সানার পর। মুজাদ্দিদে দ্বীন ও সমকালীন উলামা-মাশায়েখের মাথার মুকুট (হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইলিয়াস রহ.) ইসলাম প্রচারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে কিছু আয়াত ও হাদীস একত্রিত করে উপস্থাপন করার আদেশ করেন।
যেহেতু আমার মতো গুনাহগারের জন্য এমন মহামনীষী ও আল্লাহওয়ালাদের আদেশ পালন নাজাতের মাধ্যম ও গুনাহ থেকে মুক্তির উসিলা হতে পারে…।‘’
দ্রষ্টব্য: ফাযায়েলে আমাল; অনুবাদ: মাওলানা আমিরুল ইসলাম লোকমান; তাহকীক-তাখরীজ সম্পাদনা: মাওলানা ইউসুফ ওবায়দী; মাওলানা আহমাদ ইউসুফ শরীফ; পৃষ্ঠা নং ১০; প্রকাশক: দারুল ফিকর; প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৩
সম্মানিত পাঠক! আপনারা মূল উর্দু কিতাবের লিখিত অংশ পড়েছেন। আপনাদের সুবিধার জন্য মূল অংশটুকু আবারো উল্লেখ করছি:
چونکہ مجھ جیسے سیہ کار کے لئے ایسے ہی حضرات کی رضا و خوشنودی وسیلہ نجات اور کفارہ سیئات ہو سکتی ہے
সরল তরজমা: ‘’কারণ আমার মতো গুনাহগারের জন্য এমন হযরতদের সন্তুষ্টি ও খুশি নাজাতের উসিলা এবং গুনাহসমূহের কাফফারা হতে পারে।’’
সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা:
তিন তিনটি প্রকাশনীর কেউই অনুবাদের যথাযথ হক আদায় করেননি। বরং দারুল ফিকর থেকে প্রকাশিত সর্বশেষ সংস্করণে বড় ধরনের আমানতের খেয়ানত করা হয়েছে। পূর্বের তাবলীগী কুতুবখানা ও দারুল কিতাব- উভয় প্রকাশনী ‘রাযা’ ও ‘খুশনূদী’ শব্দ দুটির যথাযথ অনুবাদ করলেও সর্বশেষ জালিয়াত প্রকাশনী এই শব্দ দুটি গায়েব করে দিয়েছে। ‘সন্তুষ্টি’ ও ‘খুশি’ শব্দ দুটির বদলে ‘আদেশ’ শব্দ আবিষ্কার করেছে। অথচ মূল উর্দু বইতে আদেশ শব্দের ‘আ’-ও নেই। যা একটি স্পষ্ট ধোঁকাবাজি। জগতের কোন ডিকশনারিতে ‘রাযা’ বা ‘খুশনূদী’-এর অর্থ ‘আদেশ পালন’ করা হয়েছে তা আমরা ওই সকল অনুবাদক, তাহকীক-তাখরীজকারী ও সম্পাদকের নিকট জানতে চাই। আমাদের জানামতে, সম্পাদক সাহেব মাওলানা আব্দুল মালেকের দী—র্ঘদিনের শাগরেদ। এই কি যোগ্য শাগরেদের নমুনা! আর এটাই কি গুরুর খেয়ানতের শিক্ষা!
মাওলানা যাকারিয়া সাহারানপুরি সাহেব তার উর্দু কিতাবের ভূমিকাতে স্পষ্টভাবেই বইটি লেখার উদ্দেশ্য উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, মাওলানা মুহাম্মাদ ইলিয়াস কান্ধলভী তাকে ফাজায়েল সম্পর্কে একটি বই লেখার নির্দেশ দেন। আর যাকারিয়া সাহারানপুরি মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভীর সন্তুষ্টি ও খুশনূদী পাওয়ার আশ?
📗 উপরিউক্ত মূর্খতাপূর্ণ আপত্তির খণ্ডন
[অনুবাদের ক্ষেত্রে খেয়ানত করা হয়েছে কি হয়নি এ বিষয়ে পরে আলোচনা করবো। আগে ইলিয়াস কান্ধলবী রহ. এর সন্তুষ্টি ও খুশনূদী কামনা সম্পর্কে আলোচনা করছি।]
📒 প্রারম্ভিকতা
কিয়ামতের পূর্বে চারিদিকে মূর্খতা ছড়িয়ে পড়বে। মানুষ মিথ্যাকে সত্য হিসেবে জানবে, আর সত্যকে মিথ্যা হিসেবে জানবে। সঠিক জিনিসকে বেঠিক মনে করবে আর বেঠিক জিনিসকে সঠিক মনে করবে। এক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটাই ঘটেছে।
শায়খুল হাদীস জাকারিয়া রহ. আল্লাহকে ছেড়ে বান্দার সন্তুষ্টির জন্য কিতাব লিখেছেন —এটাও আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে? তাঁর লিখিত কিতাব পড়ানো হয় মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নামী প্রতিষ্ঠানে; আর তিনি নাকি কিতাব লিখবেন বান্দার সন্তুষ্টির জন্য। সবই প্রহসন।
📒 সংক্ষিপ্ত জবাব
১. মূলত এই কিতাবটি জাকারিয়া রহ. এর আপন চাচা ওলীকুল শিরোমণি মহান বুযুর্গ ইলিয়াস রহ. এর আদেশে লেখা হয়েছে বিধায় জাকারিয়া রহ. ভূমিকাতে চাচার আদেশ পালন ও তাঁর সন্তুষ্টির বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। কারণ, সাধারণত মানুষ কারো আদেশ পালন করেই তাঁর সন্তুষ্টির জন্য (আল্লাহর সন্তুষ্টির বিষয়টা তো তাকওয়া-অনুযায়ী প্রত্যেকের অন্তরে থাকেই)। তো যেটা বাস্তবতা সেটা লিখলে সমস্যা কোথায়!
২. তিনি যদি আপন চাচা ও শায়খ ইলিয়াস রহ. এর আদেশ পালন না করতেন তবে কি ইলিয়াস রহ. অসন্তুষ্ট হতেন না? অবশ্যই হতেন। কারণ, ছাত্র যখন শায়েখের আদেশ অমান্য করে স্বভাবতই শায়েখ এতে অসন্তুষ্ট হোন। শুধু তিনি না, সবাই অসন্তুষ্ট হবেন।
তো আদেশ পালন করলে শায়খ সন্তুষ্ট হোন আর অমান্য করলে অসন্তুষ্ট হোন —এটা তো সবার জানা কথা। অতএব, যেহেতু তিনি আদেশ অমান্য করে তাঁকে অসন্তুষ্ট করতে চাননি বরং আদেশ পালন করে সন্তুষ্ট করেছেন এবং এর পিছনে তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো আখেরাতে নাজাত লাভ করা —সেহেতু ভূমিকাতে তাঁর সন্তুষ্টির কথা বললে সমস্যা কোথায়? বাস্তবতা মেনে নিতে শির্কের ভয় কেন?
৩. কারো সন্তুষ্টির জন্য কিছু করলেই সেটা নিন্দনীয় নয় —যদি সে কাজ দ্বারা আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করা না হয় এবং যদি উক্ত কাজে আল্লাহর সন্তুষ্টিরও উদ্দেশ্য থাকে। তো আমরা দেখতে পাচ্ছি, জাকারিয়া রহ. কেবলই ইলিয়াস রহ. এর সন্তুষ্টি কামনা করেননি বরং তাঁর আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে, তাঁর মতো মহান বুযুর্গ (আল্লাহর বন্ধুর) সন্তুষ্টি ও দোয়ার মাধ্যমে আখেরাতে নাজাত লাভ করা। আর আখেরাত হচ্ছে আল্লাহ-কেন্দ্রিক।
অর্থাৎ তাঁর মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে আল্লাহরই সন্তুষ্টি লাভ করা। আল্লাহ সন্তুষ্ট হলেই তো আখেরাতে নাজাত মিলবে।
৪. তিনি বুযুর্গের সন্তুষ্টি কোনো পার্থিব লাভের জন্য চাননি বরং বুযুর্গের সন্তুষ্টির মাধ্যমে তিনি প্রকারান্তরে আল্লাহর সন্তুষ্টিই চেয়েছেন। যেমন, হাদীসে বলা হয়েছে, মাতা-পিতার সন্তুষ্টির মধ্যে আল্লাহর সন্তুষ্টি নিহিত। [জামি’উস সাগীর: ৫৮২০]
৫. মাতা-পিতাকে সন্তুষ্টি করার মানে এই নয় যে, আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা হচ্ছে না বা এতে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্য নেই। বরং মাতা-পিতাকে সন্তুষ্ট করা মানেই আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা। একইভাবে এখানেও কেবল বুজুর্গকে সন্তুষ্ট করা উদ্দেশ্য নয় বরং এর মাধ্যমে বুজুর্গের নেক দোয়া ও ইমান-আমল বৃদ্ধি এবং আখেরাতে নাজাতে লাভ করাই উদ্দেশ্য।
৬. 📗 বিশেষভাবে প্রনিধানযোগ্য 📗
ইলিয়াস রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন জাকারিয়া রাহিমাহুল্লাহু এর আপন চাচা। আর হাদীসে চাচাকে বাবার সমতুল্য বলা হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
إنَّ عَمَّ الرَّجُلِ صِنْوُ أبِيِه
নিশ্চয়ই, চাচা তার বাবার মতই। [জামি’উল কাবীর: ১০/৭৯৩]
অন্য হাদীসে আরও স্পষ্টভাবে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন—
لا تُؤْذُوا العَبّاسَ فَتُؤْذونِي، مَن سَبَّ العَبّاسَ فَقَدْ سَبَّنى، إنَّ عَمَّ الرَّجُلِ صِنْوُ أبِيِه»
তোমরা (আমার চাচা) আব্বাসকে কষ্ট দিও না, কারণ তাকে কষ্ট দেওয়া মানে আমাকে কষ্ট দেওয়া। আর যে (আমার চাচা) আব্বাসকে গালি দিলো সে যেন আমাকেই গালি দিলো। নিশ্চয়ই মানুষের চাচা আপন বাবার মতই। [জামি’উল কাবীর: ১০/৭৯৩]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন-
رِضَا الرَّبِّ فِي رِضَا الْوَالِدِين وَسَخَطُ الرَّبِّ فِي سَخَطِ الْوَالِدِين
মাতা-পিতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর মাতা-পিতার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি। [জামি’উস সাগীর: ৫৮২০]
তিরমিজির হাদীসে বিশেষ করে বাবার সন্তুষ্টির কথাটা আরো স্পষ্টভাবে এসেছে- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
رِضَا الرَّبِّ فِي رِضَا الْوَالِدِ وَسَخَطُ الرَّبِّ فِي سَخَطِ الْوَالِدِ
বাবার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি আর বাবার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি। [তিরমীযী: ১৮৯৯]
তো এক হাদীসে বলা হলো, চাচা হচ্ছেন বাবার মত। অন্য হাদীসে বলা হচ্ছে, বাবার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি। অতএব চাচার সন্তুষ্টিতেও আল্লাহর সন্তুষ্টি। এটা কি কুরআনের আয়াত দিয়ে প্রমাণ করতে হবে?
তবুও অন্ধবিদ্বেষীরা বলবে, জাকারিয়া রহ. এই কিতাবটি রচনার ক্ষেত্রে বান্দার সন্তুষ্টি ও খুশনূদীর আশ করেছেন! না’ঊযুবিল্লাহ। মানুষের মস্তিষ্ক এতই দুর্বল হয়ে পড়েছে! আফসোস।
হে আল্লাহ, মস্তিষ্কের দুর্বলতা থেকে আমাদের রক্ষা করো।
৭. বান্দার সন্তুষ্টির জন্য কিছু করা তখনই নিন্দনীয় —যখন বান্দার সন্তুষ্টির জন্য আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করা হবে অথবা কেবল বান্দার সন্তুষ্টিই উদ্দেশ্য হবে, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য না থাকবে। কিন্তু এখানে তো পুরোপুরিই আল্লাহর সন্তুষ্টিই উদ্দেশ্য; আর কোনো পার্থিব উদ্দেশ্যই নেই।
৮. কেউ যদি কাউকে খুশি করার জন্য কোনো কাজ করে যার মাধ্যমে আল্লাহরও সন্তুষ্টি পাওয়া যায় —তাহলে তা কখনোই নিন্দনীয় নয়। যেমন মাতা-পিতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি। এক্ষেত্রে বাহ্যিকভাবে মাতা-পিতাকে সন্তুষ্টির কথা থাকলেও মূলত আল্লাহকে সন্তুষ্ট করাই উদ্দেশ্য। অতএব, এ ক্ষেত্রেও বাহ্যিকভাবে বুযুর্গের সন্তুষ্টির কথা থাকলেও মূলত আল্লাহর সন্তুষ্টিই উদ্দেশ্য।
৯. একজন বিশ্ববিখ্যাত আলেম আল্লাহর সন্তুষ্টি বাদ দিয়ে কোন মাখলুকের সন্তুষ্টির জন্য কিতাব রচনা করবেন —তা ভাবনারও বাইরে। একজন সাধারণ মুসলিমও তো জানে যে আল্লাহ ব্যতীত কারো সন্তুষ্টির জন্য কিছু করা জায়েয নেই। সেখানে একজন বিদগ্ধ শায়খুল হাদীস কেবল বুযুর্গের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কিতাব রচনা করবেন —তা প্রহসন বইকি!
যাই হোক, যা বোঝানোর চেষ্টা করছি তা হচ্ছে, এখানে কেবল বুযুর্গকে সন্তুষ্ট করাই তাঁর উদ্দেশ্য নয়, বরং আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে, বুযুর্গের নেক দোয়ার বরকতে ঈমান-আমল বৃদ্ধি, গোনাহ-মাফী ও আখেরাতে নাজাত লাভ করা —যা তিনি ভূমিকায় সুস্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেছেন।
অতএব, রাসূলের সুন্নাহের আলোকেই প্রমাণিত হলো, জাকারিয়া রহ. কেবলই ইলিয়াস রহ. সন্তুষ্টির জন্য এ গ্ৰন্থ রচনা করেননি বরং এর মাধ্যমে তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টিই কামনা করেছেন। সুতরাং, এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলা জাহালাত ছাড়া কিছুই নয়।
জ্ঞানীর জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। বলা হয়, অআকলমান্দ কে লিয়ে ইশারা হী কাফী হোতা হ্যায়।
📗 বিস্তারিত জবাব
📒 ভূমিকাতে বুযুর্গের সন্তুষ্টির কথা আসলো কেন
কারণ এই কিতাবটি তাঁকে লিখতে আদেশ করেছেন তাঁর উস্তাদ ইলিয়াস রহ.। আর যখন কারো আদেশ পালন করা হয় স্বভাবতই তিনি খুশি ও সন্তুষ্ট হন। আর মানুষ কারো আদেশ পালন করেও সাধারণত তাকে খুশি ও সন্তুষ্ট করার জন্য। কারণ, আল্লাহ ব্যতীত কারো আদেশ পালন করা জরুরী নয়। তবুও মানুষ মানুষের আদেশ পালন করে। ছাত্র উস্তাদের আদেশ পালন করে। ছোটরা মুরুব্বিদের আদেশ পালন করে। কেন করে? কারণ, যাতে করে মুরুব্বিগণ ছোটদের প্রতি খুশি ও সন্তুষ্ট হন। এবং খুশি হয়ে তাদের জন্য সফলতার দোয়া করেন। আর ছাত্র উস্তাদের আদেশ পালন করে —যাতে করে উস্তাদ ছাত্রের প্রতি সন্তুষ্টি হয়ে তার কল্যাণ কামনা করেন। ইলমের বরকতের জন্য দোয়া করে। ঈমান-আমল বৃদ্ধির দোয়া করে।
এমনিতেই দেখা যায়, যে সমস্ত ছাত্ররা উস্তাদের আদেশ পালন করে চলে, উস্তাদের খিদমত ও সেবা-যত্নের মাধ্যমে তাঁকে সন্তুষ্ট রাখে —সে সমস্ত ছাত্ররাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হেদায়েত প্রাপ্ত হয়। এবং তাদের ইলমেও বরকত হয়। পৃথিবীতে এমন কোনো সফল ব্যক্তি বা আলেম নেই —যার প্রতি তাঁর উস্তাদের সন্তুষ্টি নেই।
উস্তাদের মনে কষ্ট দিয়ে, উস্তাদকে অসন্তুষ্ট করে কেউ বড় আলেম হয়েছে, হেদায়েত প্রাপ্ত হয়েছে, এমন নজির পৃথিবীতে নেই। অর্থাৎ ছাত্রের সফলতার জন্য উস্তাদের সন্তুষ্টি একান্ত কাম্য। আর ওস্তাদের সন্তুষ্টি কি এমনি এমনি আসবে? উস্তাদের আদেশ-নিষেধ ও নির্দেশনা মানার মাধ্যমে তাকে সন্তুষ্ট করতে হবে না?
কাজেই উস্তাদ ছাত্রকে একটি গ্রন্থ লিখতে বললে ছাত্র সাধারণত সে আদেশ পালন করবে —যাতে করে উস্তাদ ছাত্রের প্রতি খুশি ও সন্তুষ্ট হন। এবং বিনিময়ে ছাত্রের জন্য নেক দোয়া করেন। ছাত্রের মাথায় এটাই থাকে যে, আমি উস্তাদের আদেশ পালন করলে উস্তাদ আমার প্রতি খুশি হবেন, সন্তুষ্ট হবেন। এতে করে আমি অনেক বড় আলেম হবো, হেদায়েত প্রাপ্ত হবো আখেরাতে নাজাত মিলবে।
[জবাবের জন্য এতোটুকুই যথেষ্ট; তবে আমরা আরো কিছু বিষয় আলোচনা করবো]
📒 সন্তুষ্টির প্রকারভেদ:
১. আল্লাহর সন্তুষ্টি। ২. বান্দার সন্তুষ্টি। ৩. পশু-পাখির সন্তুষ্টি।
আল্লাহর সন্তুষ্টি তো কমবেশ সবাই বুঝি। যেমন, কোনো কাজ খালেস আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা। যথা: খালেস আল্লাহর জন্য সালাত আদায় করা, সিয়াম পালন করা, যাকাত প্রদান করা ইত্যাদি ইত্যাদি। এ সবের সাথে বান্দার সন্তুষ্টির কোনো সম্পর্ক নেই। এ সব আমল বান্দা সন্তুষ্টির জন্য করা যাবে না।
📒 বান্দার সন্তুষ্টি
হাদীসে বর্ণিত আছে, “মাতা-পিতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি”। একই অর্থের আরো অনেক হাদীস রয়েছে। তো এ সব হাদীস থেকে প্রমাণিত হলো- শরী’আত আল্লাহর সন্তুষ্টির সাথে সাথে বান্দার সন্তুষ্টিকেও স্বীকৃতি দিয়েছে। অতএব আল্লাহর সাথে সাথে (নির্দিষ্ট) বান্দার সন্তুষ্টির আশা করা মোটেও দোষনীয় নয়।
তবে এ ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা ও মাপকাঠি রয়েছে। যেমন, আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে বান্দার সন্তুষ্টি কামনা করা যাবে না। হাদীসে এসেছে, যে আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে বান্দাকে সন্তুষ্ট করবে তাহলে তার প্রতি আল্লাহ ও বান্দা উভয়ই অসন্তুষ্ট হবে। আর যে বান্দার অসন্তুষ্টি উপেক্ষা করে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করবে, তার প্রতি আল্লাহ ও বান্দা উভয় সন্তুষ্ট হবেন।
তো হাদিসে মাতা-পিতার সন্তুষ্টিকে আল্লাহর সন্তুষ্টি বলা হয়েছে! অতএব কারো মাতা পিতা যদি কাউকে একটি গ্রন্থ লেখার আদেশ করে। অতঃপর সে তার মাতা পিতাকে সন্তুষ্ট করণার্থে তাদের আদেশপালনস্বরূপ একটি গ্রন্থ রচনা করে —তখনও কি আপত্তিকারীরা এই প্রশ্ন করবে যে, লেখক এখানে বান্দার সন্তুষ্টি কামনা করেছে! এটা শিরক!
📗 বান্দার সন্তুষ্টি কখন নিষিদ্ধ
যখন আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে বান্দার সন্তুষ্টি লাভ উদ্দেশ্য হবে অথবা আল্লাহকে বাদ দিয়ে কেবল বান্দার সন্তুষ্টির জন্যই কোনো কাজ করা হবে।
অথচ জাকারিয়া রহ. রাহিমাহুল্লাহ এই দুটি ভুল থেকে মুক্ত।
📗 সন্তুষ্ট হওয়া ও সন্তুষ্ট করা
মানুষের সন্তুষ্ট হওয়া ও মানুষকে সন্তুষ্ট করা একটি স্বভাবজাত বিষয়। যেমন বন্ধু বন্ধুর উপকার করলে বন্ধু সন্তুষ্ট হয়ে যায়। কেউ কারো বিপদে হাত বাড়ালে বিপদগ্রস্তের মন খুশি হয়ে যায়। ছোটরা বড়দের কোনো আদেশ পালন করলে বড়রা ছোটদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে সফলতার দোয়া করেন। উস্তাদ ছাত্রকে আদেশ করলে যখন ছাত্র তাঁর আদেশ পালন করে, তখন উস্তাদজিও ছাত্রের প্রতি সন্তুষ্ট হন এবং ছাত্রের জন্য নেক দোয়া করেন।
তো এখানেও বিষয়টি হুবহু এমনই। উস্তাদ/শায়খ জাকারিয়া রহ-কে একটি গ্রন্থ রচনা আদেশ করেছেন আর জাকারিয়া রহ. উস্তাদ/শায়খের আদেশ পালনার্থে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর আশা, এতে করে শায়খ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হবেন এবং তাঁর জন্য নেক দোয়া করবেন। আর শায়খের দোয়ার বরকতে আখেরাতে তাঁর নাজাত মিলবে। এ কথাই তিনি ভূমিকাতে বলেছেন।
তো এখানে ভুল হয়েছে —এমন তো কিছু দেখা যাচ্ছে না। জানি না, অযথা নিন্দা প্রচারের হেতু কী?
[দ্বিতীয় পর্ব আসবে। ইন-শা-আল্লাহ।]
.
লুবাব হাসান সাফওয়ান
ছাত্র: মাদরাসাতু ফায়দ্বিল উলূম
#Debateforsunnah
#Lubaabswritings
#Ahnaafwritersworld
আরো পড়ুন-
- আহলে হাদিস কারা
- আহমদ ইবনে হাম্বল (রাঃ) এর জীবনী
- সীরাত গ্রন্থ পরিচিতি
- আসমানী কিতাবসমূহ
- ফেরেশতাগণের পরিচয়