আজকের এই পৃথিবী সহ মহাবিশ্ব আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বহু কাল পূর্বে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যে তাঁর নিজস্ব নীতিমালা রয়েছে। আল্লাহর নিজস্ব নীতিমালা থাকার ব্যাপারে তিনি মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় স্পষ্টরূপে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নীতিমালা গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আল্লাহর সৃষ্টি সকল কিছুর মধ্যেই নিজস্ব শক্তি দিয়েছেন। আবার প্রতিটি শক্তির ক্ষেত্রেই তিনি বিপরীত শক্তি দিয়েছেন। মহা বিশ্বের প্রতিটি বস্তুু কনা একে অপরকে নিজেদের দিকে আকর্ষন করে যাকে বলা হয়ে থাকে মহাকর্ষ শক্তি (force of gravitation) । এর বিপরীতে রয়েছে আবার সম্প্রসারণ শক্তি (force of expansion) যার ফলে একে অপরকে বিকর্ষণ করেন। যদি শুধুমাত্র আকর্ষণ থাকতো তাহলে সবগুলো গ্রহ একত্রে লেগে ধ্বংস হয়ে যেত, এজন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আকর্ষণের সাথে একটি বিপরীত শক্তি দিয়েছেন আবার শুধু বিকর্ষণ শক্তি যদি দিতেন আকর্ষণ না থাকতো তাহলে সকল গ্রহ-নক্ষত্র তাদের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলত। [১] আল্লাহপাক হলেন অশেষ দয়াবান আবার তিনি কঠিন হিসাব গ্রহন কারী। সকল কিছুর বিপরীত রয়েছে। তেমনি মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব, সকল সৃষ্টির সেরা আর তাই মানুষের শত্রুও অনেক বড় এবং নিকৃষ্ট। মানুষ সৃষ্টির সেরা হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহপাক বলেন
وَ لَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِیْۤ اٰدَمَ وَ حَمَلْنٰهُمْ فِی الْبَرِّ وَ الْبَحْرِ وَ رَزَقْنٰهُمْ مِّنَ الطَّیِّبٰتِ وَ فَضَّلْنٰهُمْ عَلٰى كَثِیْرٍ مِّمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِیْلًا۠
আমি অবশ্যই আদম সন্তানদের মর্যাদা দান করেছি, স্থলে ও সমুদ্রে আমি ওদের চলাচলের বাহন দিয়েছি এবং তাদের পবিত্র (জিনিসসমুহ দিয়ে) আমি রিযিক দান করেছি, অতপর আমি অন্য যতাে কিছু সৃষ্টি করেছি তার অধিকাংশের ওপরই আমি তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।
[২]
আায়াত থেকে বুঝা যায় আমরা বনি আদম আমরাই সবার সেরা। পৃথিবীতে যত শত্রুতা রয়েছে তার সবকিছুর সূচনা হয় শ্রেষ্ঠত্বের জায়গা থেকে। একজন মানুষ যখন যে কোন উপায়ে জীবনে উন্নতির শিখরে পৌছাতে চায় তখন-ই তার সাথে মানুষের শত্রুতার সূত্রপাত হয়। ঠিক তদ্রুপ মানুষ আমরা পৃথিবীর সবকিছুর চেয়ে শ্রেষ্ঠ। মানবজাতি পৃথিবীর সব থেকে শ্রেষ্ঠ জাতি হওয়ার কারণে আমাদের সাথে শত্রুতা করে ইবলিস। ইবলিশ আমাদের প্রকাশ্য শত্রু। [৩] আর আমাদের যে প্রকাশ্য শত্রু শয়তান সেও কিন্তুু অনেক চালাক চতুর এবং অনেক অভিজ্ঞ। আমরা মানুষ যেহেতু সবার থেকে শ্রেষ্ঠ আর মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুর বিপরীতাত্বক বিষয় বিবেচনা করলে বোঝা যায় শয়তান আমাদের সাধারন কোন শত্রু নয় বরং অনেক বড় অভিজ্ঞ এবং দক্ষ। যদিও কুরআনের এক স্থানে ঈমানদার বান্দাদের উৎসাহী করতে বলেছেন শয়তানের চাল দূর্বল। [৪] সে স্বাভাবিক কোন খারাপ কিছু নয় বরং অসৎ গুণাবলীতে পরিপূর্ণ, সর্বদা খারাপ কাজে সে লিপ্ত।
শয়তানের সাথে মানুষের শত্রুতা কবে এবং কেনো শুরু হয়েছিল তা সকলের জানা বিষয়। প্রত্যেক সচেতন ব্যাক্তি এ বিষয় জানেন যে আল্লাহ পাক আদম আলাহিস সালাম কে সৃষ্টি করার পর সকল ফেরেস্তাসহ ইবলিস কে আদম আলাহিস সালাম এর সম্মানে সেজদা করার আদেশ দিলেন। এ আদেশ সকলেই পালন করলেও ইবলিস অহংকার করলো এবং সিজদা হতে বিরত থাকলো। এসকল ঘটনা কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বর্নিত হয়েছে। যেমন আল্লাহপাক বলেন
وَ اِذْ قُلْنَا لِلْمَلٰٓئِكَةِ اسْجُدُوْا لِاٰدَمَ فَسَجَدُوْۤا اِلَّاۤ اِبْلِیْسَ اَبٰى وَ اسْتَكْبَرَ وَ كَانَ مِنَ الْكٰفِرِیْنَ
তারপর যখন ফেরেশতাদের হুকুম দিলাম, আদমের সামনে নত হও, তখন সবাই অবনত হলো, কিন্তু ইবলিস অস্বীকার করলো। সে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের অহংকারে মেতে উঠলো এবং নাফরমানদের অন্তর্ভুক্ত হলো। [৫]
আর এই অপরাধের জন্য সে চিরতরে অভিশপ্ত হয়ে আল্লাহর সেই রহমত থেকে বঞ্চিত হলো। সে তখন আল্লাহর কাছে কয়েকটি দাবি আদায়ের ঘোষণা দিলো। আল্লাহর কুরআনের ভাষায়
قَالَ فَبِمَاۤ اَغْوَیْتَنِیْ لَاَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِیْمَ ثُمَّ لَاٰتِیَنَّهُمْ مِّنْۢ بَیْنِ اَیْدِیْهِمْ وَ مِنْ خَلْفِهِمْ وَ عَنْ اَیْمَانِهِمْ وَ عَنْ شَمَآئِلِهِمْ وَ لَا تَجِدُ اَكْثَرَهُمْ شٰكِرِیْنَ-
সে বললোঃ “তুমি যেমন আমাকে গোমরাহীতে নিক্ষেপ করেছো তেমনি আমিও এখন তোমার সরল-সত্য পথে এ লোকদের জন্য ওঁত পেতে বসে থাকবো। সামনে-পেছনে, ডানে-বায়ে, সবদিক থেকে এদেরকে ঘিরে ধরবো এবং এদের অধিকাংশকে তুমি শোকর গুজার পাবে না।” [৬]
এই থেকে শুরু হলো শত্রুতা। আর সেজন্য আল্লাহ রব্বুল আলামীন কুরআন শরীফে ৯ বার একথা বলে আমাদের সাবধান করেছেন যে শয়তান আমাদের প্রকাশ্য শত্রু।
আমাদের কাছে আমাদের শত্রু সম্পর্কে সকল তথ্য থাকা সত্বেও আজ আমরা সচেতন হচ্ছি না। আমাদের চেয়ে গাফেল তথা বোকা বা নির্বোধ আর কে হতে পারে? পৃথিবীতে এমন কেউ কি আছে যার কাছে শত্রু সম্পর্কে সকল তথ্য আছে এবং তার হাত থেকে বাঁচার উপায় জানা থাকা সত্বেও সচেতন হচ্ছে না (একমাত্র ইবলিস এর বিষয় ছাড়া)।
শত্রু সম্পর্কে জানা সত্বেও তার হাত থেকে বাচার জন্য আমাদের হৃদয়কে কাজে লাগাচ্ছি না অথচ আল্লাহপাক আমাদেরকে চিন্তা ভাবনা করার জন্য অন্তর দিয়েছেন। আরো দিয়েছেন উন্মুক্ত চিন্তার জন্য মস্তিষ্ক। আবার আল্লাহর নেয়ামত দেখে সেই পথে চলার জন্য আমাদেরকে দেওয়া হয়েছে সুন্দর দুটো চোখ। আবার আমাদের কান দেওয়া হয়েছে। আমাদেরকে দেওয়া প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ , অসংখ্য নেয়ামতে পরিপূর্ণ আলহামদুলিল্লাহ। এতো কিছুর পরেও যদি আমাদের প্রকাশ্য শত্রু হতে ফিরে আসতে না পারি তবে আমাদের চেয়ে দুর্ভাগা আর কে হতে পারে?
এই সকল কিছু তো আল্লাহপাক আমাদেরকে দিয়েছেন তার পথে চলার জন্য সত্যের সন্ধান পাওয়ার জন্য। কিন্তু এর পরেও এসব নেয়ামত তথা অন্তর দিয়ে যদি শয়তান হতে বাচার চিন্তা না করি, চোখ দিয়ে নেয়ামত দেখা সত্বেও যদি কুরআন না পড়ে ধ্বংসের পথে চলি, কান দিয়ে কুরআন শ্রবন না করে যদি শয়তানের ওয়াসওয়াসা শুনে সময় অতিবাহিত করি তবে এসব হবে আমাদের জন্য জাহান্নম এর কারন। যেমন আল্লাহপাক সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন
وَ لَقَدْ ذَرَاْنَا لِجَهَنَّمَ كَثِیْرًا مِّنَ الْجِنِّ وَ الْاِنْسِ لَهُمْ قُلُوْبٌ لَّا یَفْقَهُوْنَ بِهَا وَ لَهُمْ اَعْیُنٌ لَّا یُبْصِرُوْنَ بِهَا وَ لَهُمْ اٰذَانٌ لَّا یَسْمَعُوْنَ بِهَا اُولٰٓئِكَ كَالْاَنْعَامِ بَلْ هُمْ اَضَلُّ اُولٰٓئِكَ هُمُ الْغٰفِلُوْنَ
আর এটি একটি অকাট্য সত্য যে, বহু জ্বীন ও মানুষ এমন আছে যাদেরকে আমি জাহান্নামের জন্যই সৃষ্টি করেছি। তাদের হৃদয় আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা উপলব্ধি করে না। তাদের চোখ আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা দেখে না। তাদের কান আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা শোনে না। তারা পশুর মত, বরং তাদের চাইতেও অধম। তারা চরম গাফলতির মধ্যে হারিয়ে গেছে। [৭]
আমরা দুনিয়ার ক্ষেত্রে এমন সচেতন হলে আসুন আজ থেকে আমরা আখিরাত বিষয়ে সচেতন হবো। কিভাবে সেই প্রকাশ্য শত্রু হতে বাঁচা যাবে তার পদ্ধতি জেনে নিয়ে আজ থেকে শয়তানের ওয়াস ওয়াসা থেকে বাঁচার চেষ্টা করবো। মনে রাখতে হবে শয়তান এমন শত্রু যে সে হত্যা করবে না,সে গুম করবে না, ডাকাতি করবে না রবং সে মনের মধ্যে কুরিপুর অনুপ্রবেশ করাবে। সে মনের মধ্যে খারাপ কাজের ইচ্ছে তৈরি করবে। সে ওয়াস-ওয়াসার মাধ্যমে আমাদের বিপথগামী করতে চাইবে। আর আমাদের লড়াই সংগ্রাম হবে তার এই সকল চক্রান্ত নসাৎ করে দিয়ে আমাদের সঠিক পথে চলা। কিন্তু শয়তান যখন চতুর্দিক হতে আক্রমণ করবে তখন কি করে এই চক্রান্ত নস্যাৎ করবো! এটি তাঁর কাছ থেকে জানতে হবে যিনি এই শয়তান সম্পর্কে আমাদের অবিহিত করেছেন। আসুন সেই সফল পদ্ধতি জেনে নিই যে গুলো আমাদের শয়তানের মোকাবেলায় বিজয়ী করবে।
তথ্যসূত্র,
১। Quran is all science.
২। সূরাবনী ইসরাঈল, আয়াত: ৭০।
৩। সূরা আল বাকারা, আয়াত ২০৮।
৪। সূরা আন নিসা, আয়াত: ৭৬।
৫। সূরা আল-বাক্বারাহ, আয়াত: ৩৪।
৬। সূরা আল আরাফ, আয়াত: ১৬-১৭।
৭। সূরা আল আরাফ, আয়াত: ১৭৯।
#শয়তানের_ধোঁকা_থেকে_বাঁচার_উপায়
#পর্ব: ০১
#আব্দুল_মজিদ_মারুফ
আরো পড়ুন-
- কুরআনের আলোকে ফেরেশতাগণের পরিচয়
- হযরত আলী (রা.) এর জীবনী
- তাকদীর অর্থ কি?
- হযরত আবু বকর (রা.) এর জীবনী
- হযরত উসমান (রা.) এর জীবনী

ভালো লিখেছেন কবি