অপেক্ষা। পর্ব-০৯। সুমাইয়া আক্তার বৃষ্টি

0

দেখতে দেখতে চারটা দিন কেটে গেলো। আজ চারদিন পর আলো বাড়ির বাহিরে নিজ পা ফেললো। এতোদিন কেমন নিজেকে বন্দি খাচার পাখি মনে হয়েছে। সবার নানা ধরনের কটুক্তির ভয়ে আলো নিজেকে সবার থেকে আড়াল করে রেখেছিলো। কিন্তু আলো এই চারদিন নিজের বাবার বলা কথা গুলো অনেক ভেবেছে। ভেবেছে রোশানের বলা কথাগুলো। আলো উপলব্ধি করেছে সে ভুল কিছু করে নি। ব্যাপারটা যতোটা জঘন্য ভাবে ছড়িয়েছে কুতুব মিয়া তেমন কিছুই তো হয় নি। আলো আর তাফীফ তো কোনো দিন নিজেদের হাত স্পর্শ করে নি। শুধু সেদিন রাগের বসে আলো তাফীফকে মারতে গেলেই তাফীফ আলোর হাত ধরে ফেলে। আর সেটাই ছিলো আলো তাফীফের প্রথম স্পর্শ। তবে সেই স্পর্শে তো কোনো লালসা ছিলো না? আর না ছিলো অন্য কোনো উদ্দেশ্য। তাহলে কেনো মানবে নিজের উপরে এই মিথ্যা অপবাদ? হ্যাঁ শৈশবে তারা খেলার ছলে একে অপরের হাত ধরেছে। কিন্তু বড় হয়ে তারা এমনটা করে নি। তাহলে কেনো ভয় পাবে আলো? এসব ভাবতে ভাবতে আলো নদীর পাড়ে পৌছে গেলো। অবশ্য পথে অনেকে আড় চোখে তাকিয়েছে আলোর দিকে। অনেকে আবার ফিসফিস করে একে অন্যকে কি যেনো বলেছে। তবে একটা কথা বুঝতে পারছে না আলো এতো সহজ কেনো লাগছে সব কিছু? এতোক্ষনে তো রণক্ষেত্র হয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। বাড়িতে মানুষ জন গিয়ে ঝামেলা করার কথা ছিলো। নানা কটুক্তি শুনার কথা ছিলো। এইযে এখন আলো বেড়িয়েছে এখনই তো অনেকে এসে আলোকে নানা কথা শুনিয়ে যেতো। তবে এসবের কিছু হলো না কেনো? জহির রায়হান বা তাফীফ কি তবে সবটা সবার কাছে পরিষ্কার করে দিয়েছে? নাকি এর পিছনেও রয়েছে নতুন এক গল্প? যা আলোর অজান্তেই হয়েছে।

আলো নদীর পানিতে পা ভিজিয়ে বসে আছে। দৃষ্টি তার অদূর পানে। আলো এতোটাই নিজের মাঝে নিমজ্জিত ছিলো যে খেয়াল করলো না পাশে এক লোক এসে বসেছে। কিছুক্ষন বাদে পাশ থেকে লোকটা আলোকে ডাকলো। একবার,দুবার, তিনবার। তৃতীয় বার ডাকতেই আলোর হুশ ফিরলো। পাশ থেকে পুরুষালি গলার স্বর পেয়ে সেদিকটায় তাকাতেই দেখতে পেলো রোশান বসে আছে আলোর মতো পানিতে পা ভিজিয়ে। আলো খানিকটা চমকে গেলো।

“আপনি? কখন এলেন?”

“যখন আপনি নিজের ভাবনাতে মত্ত ছিলেন।”

“দুঃখিত, আপনাকে খেয়াল করি নি।”

তারপর কিছুক্ষণ দুজনের মাঝে চললো পিনপতন নিরবতা। দুজনের মাঝে একজন তাকিয়ে রইলো নদীর অপর প্রান্তে। আরেকজন তাকিয়ে রইলো তার পাশে বসা থাকা স্নিগ্ধ এক অষ্টাদশীর পানে। আলো অনেকটা সংকোচ বোধ করছে এভাবে একটা লোকের পাশে বসে থাকতে। তাই কিছু একটা বাহানা দিয়ে এখান থেকে কেটে পরার উদ্দেশ্যে রোশানের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো রোশান আলোর দিকেই তাকিয়ে আছে। তবে রোশানের দৃষ্টিতে কিছু একটা ছিলো। যা আলো বুঝলো না। এই দৃষ্টি ছিলো অত্যন্ত প্রখর। যা বুঝে উঠার সাধ্যি আলোর নেই। একে তো এভাবে পাশাপাশি বসে থাকার জন্যে সংকোচ বোধ হচ্ছিলো এখন আবার রোশানকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তা শতগুন বৃদ্ধি পেলো। রোশান হয়তো ব্যাপারটা আচ করতে পেরেছে। তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ধীর কন্ঠে বললো,”আমি শহরে ফিরে যাচ্ছি আলো। সাথে নিয়ে যাচ্ছি আকাশ সম অপূর্ণতা।”

আলো বুঝলো না রোশানের কথার অর্থ। বুঝেছে তবে সেটা সাধারণ দৃষ্টিকোন থেকে। এর গভীরতা উপলব্ধি করতে পারিনি। তাই আলতো স্বরে জিজ্ঞেস করলো,”অপূর্ণতা?”

“সে তুমি বুঝবে না মেয়ে। ছাড়ো এসব, যেটা বলতে এসেছিলাম সেটা আগে বলে নেই।”

রোশানের কথায় আলো রোশানের পানে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।

“জানোই তো ওকালতি পড়ছি। সে হিসেবে মানুষ চিনতে ভুল হয় না আমার। তারউপর তোমাকে আমি কয়েকটা দিন পড়িয়েছি। তোমার কার্যকলাপ আমি পর্যবেক্ষণ করেছি। আর তা থেকে যা বুঝলাম তুমি মেয়ে বড়ই অদ্ভুত। তোমার সরলতার মাঝে চঞ্চলতা আছে। তোমার চুপচাপ থাকার মাঝে ঝগড়াটে এক সত্তা আছে। তোমার ভিতু স্বভাবের মাঝে প্রবল সাহস লুকায়িত। তুমি মেয়ে যতোটা শান্ত ঠিক ততোটাই ভয়ংকর।”

রোশানের প্রতিউত্তরে আলো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। রোশান যা যা বললো সব কেমন মাথার উপর দিয়ে গেলো। প্রতিউত্তরে কি বলা উচিত সেটা আলো বুঝতে পারছে না। এবারো আলোর মনোভাবটা রোশান ধরে ফেললো। তাই আলতো হেসে মাথা দু’দিকে দুলিয়ে বললো,”বুঝো নি তাই তো?”

আলো সম্মতিসূচক মাথা দুলাতেই রোশান বললো,”থাক পরে বুঝে নিও। তবে আমি একটা কথা জানতে চাই আলো। যে মেয়ে জুবায়ের-এর মতো লোকের সাথে কঠোর হতে পারে, সেই এক’ই মেয়ে কেনো কুতুব চাচার কথার প্রতিবাদ সেদিন করে নি?”

আলো অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো রোশানের দিকে। আর ভাবতে লাগলো রোশান কি করে জুবায়ের-এর কথা জানে। তবে সেটা নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলো না আলো। শুধু বললো,”কুতুব চাচা মুরব্বি মানুষ। উনার কথার প্রতিবাদ করাটা অনেকটা বেয়াদবি হয়ে যায় আমার কাছে। আর কুতুব চাচার কাছে সেটা বেয়াদবির মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। কারন এটা গ্রাম, আপনাদের শহর নয়। আর সেটা ভেবেই চুপ ছিলাম।”

“নিজের সম্মান রক্ষার্থে কারো ভুলভাল অপবাদের প্রতিবাদ করা যদি বেয়াদবি হয় তাহলে সেটাই সই আলো। হোন না বেয়াদব সমস্যা কি? তাতে অন্তত নিজের চরিত্রে আঁচ আসবে না। প্রতিবাদ করতে হবে আলো। নয়লে সবসময় সবার মিথ্যা অপবাদ সইতে হবে। একটা কথা সব সময় মাথায় রাখবেন আলো। হয় মান নয়লে জান। আর এটা মাথায় নোট করে রাখবেন।”

তারপর রোশান নিজের হাতে থাকা ঘড়ির কাটায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,”আমার সময় শেষ আলো। আমাকে যেতে হবে। ভালো থাকবেন। বেঁচে থাকলে আর রব চাইলে আমাদের আবার দেখা হবে।”

কথা শেষ করে রোশান যাওয়ার উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়াতেই আলো দ্রুততার সহিত বললো,”শুনুন!”

আলোর ডাকে রোশান স্হির হয়ে দাঁড়ালো। তারপর আলো নিজেও উঠে দাঁড়িয়ে রোশানের মুখোমুখি হলো।

“ধন্যবাদ। ”

“কেনো?”

“আব্বার পর যার কাছ থেকে আমি অনেক বেশি সাহস পেয়েছি তিনি হলেন আপনি। আপনার বলা প্রত্যেকটি কথা আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। সত্যিই আপনি আমার জীবনের এক অসাধারণ শিক্ষক।”

আলোর কথার বিনিময়ে রোশান সুন্দর এক হাসি উপহার দিলো। তারপর সেখান থেকে চলে যেতে লাগলো নিজ গন্তব্যে। যতোক্ষণ রোশানকে দেখা গেলো ততোক্ষণ আলো রোশানের যাওয়ার পথে চেয়ে রইলো। মানুষটার প্রতি না চাইতেও কেমন এক সম্মান জেগে উঠছে মনে। রোশান আলোর চোখের অন্তরালে যেতেই আলো পুনরায় পানিতে পা ভিজিয়ে বসে পড়লো। আর ভাবতে লাগলো রোশানের বলা কথাগুলো। হুট করে আলোর মনে হলো রোশান আলোকে তুমি সম্বোধন করেছে। আলো ভাবতে লাগলো সত্যিই কি এমনটা হয়েছে? নাকি আলোর মনের ভুল?

চলবে…..


Screenshot 3
বিজ্ঞাপনঃ বই কিনুন, বই পড়ুন

0

Sumaiya Akter Bristy

Author: Sumaiya Akter Bristy

❝শুভ্রচিন্তার উদ্ভব ঘটে যার কথা ভেবে সে যদি মোহ হয় দোষ বা কি তাতে?❞ ~Sumaiya Akter Bristy

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

গল্প চেয়ারম্যানের মেয়ে আফছানা খানম অথৈ

চেয়ারম্যানের মেয়ে আফছানা খানম অথৈ মেহেরপুর একটি সুন্দর গ্রাম।এই গ্রামে কিছু অদ্ভুত নিয়মকানুন চালু আছে,যা অন্যকোন গ্রামে নেই।এই গ্রামে নারীরা

গল্প মেয়েরা ও মানুষ আফছানা খানম অথৈ

গল্প মেয়েরা ও মানুষ আফছানা খানম অথৈ রানু বউ হয়ে এসেছে চার পাঁচ মাস হলো।এরই মধ্যে তার স্বামী স্কলারশিপ এর

গল্প মেয়ে সাক্ষী আফছানা খানম অথৈ

মেয়ে সাক্ষী আফছানা খানম অথৈ আবিদ হায়দার বেড়াতে এসেছে গ্রামে তার বন্ধু ফুয়াদ'র বাসায়।অবশ্য সে একা না,তার সঙ্গে আছে,বন্ধু সজল

গল্প বন্ধ্যা আফছানা খানম অথৈ

গল্প বন্ধ্যা আফছানা খানম অথৈ আলেয়া বউ হয়ে এসেছে চার বছর হলো।এখনো মা হতে পারেনি। এজন্য রীতিমতো তাকে কটু কথা

4 Replies to “অপেক্ষা। পর্ব-০৯। সুমাইয়া আক্তার বৃষ্টি”

Leave a Reply