ভোজন রসিক বাঙ্গালীর কাছে মিষ্টি জাতীয় খাবার অত্যন্ত প্রিয়। সন্দেশ, দই, রসমালাই, বিভিন্ন কোল্ড ড্রিংক, পায়েস ইত্যাদি পেলে বাঙালিকে আর দমিয়ে রাখা যায় না। এ সকল খাদ্য মিষ্টি করতে আমরা সাদা চিনি ব্যবহার করি। অথচ এই চিনির উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে আমরা বিন্দুমাত্র চিন্তা করি না।
আজকে আমরা জানবো চিনির উপকারিতা ও অপকারিতা। একই সাথে সাদা চিনির অন্যান্য বিকল্পগুলোকে নিয়েও আলোচনা করবো। এছাড়া সাদা চিনি পরিহার করে আপনি কিভাবে স্বাস্থ্যকর লাল চিনি ও অন্যান্য উপকরণ দিয়ে একেবারে মিষ্টির স্বাদ বজায় রাখতে পারবেন তাও জানাতে চলেছি।
চিনির ব্যবহার
খাবারে মিষ্টতা যোগ করার জন্য আমরা চিনি ব্যবহার করি। শরবত, পায়েস, চ, দই, রসমালাই, ছানা, দুগ্ধ জাতীয় খাবার, মিষ্টি ইত্যাদি খাবারে চিনি ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে চকলেট কিংবা নানা রকমের লজেন্স তৈরিতে প্রচুর পরিমাণ চিনি ব্যবহার করা হয়।
শিশুদের চিনি অত্যন্ত প্রিয়। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এই অভ্যাসটি কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্ডি তৈরিতে প্রচুর পরিমাণ চিনি ব্যবহার করছে। এতে তারা লাভবান হচ্ছে ঠিকই কিন্তু শিশুর স্বাস্থ্যের ক্ষতির স্বাস্থ্যের ঝুঁকিতে ফেলছে।
চিনি খাওয়ার নিয়ম
খাদ্যবিশেষজ্ঞরা আমাদের চিনি খাওয়ার পরামর্শ দেন না। তবুও চিনি যেহেতু আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় একটি অপরিহার্য উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই সীমিত পরিসরে চিনি খেতে অনুমতি দেন।
নারী ও পুরুষ ভেদে একজন মানুষের দৈনিক চিনি গ্রহণ করার সীমানা ভিন্ন। একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ দৈনিক নয় চামচ বা ৪০ গ্রাম সাদা চিনি গ্রহণ করতে পারবেন। অপরদিকে একজন পূর্ণবয়স্ক নারী দৈনিক ৬ চামচ বা প্রায় ২০ থেকে ২৫ গ্রাম চিনি গ্রহণ করতে পারবেন।
তবে বলে রাখছি, চিনি যে শুধু আমাদের বানানো ঘরে বানানো চা, শরবত, পায়েস ইত্যাদিতেই শুধু থাকে না। এমনকি বাজার থেকে কেনা চকলেট, ক্যান্ডি, দই, ইত্যাদি খাদ্যতেও থাকে।
এমনকি আমরা বাজার থেকে যেসব কোল্ড ড্রিংকস কিনে থাকি তাতে কয়েক চামচ পর্যন্ত চিনি বিদ্যমান। তাই দৈনিক চিনি গ্রহণের সময় আমাদের অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে উক্ত খাদ্যগুলোতে কতটুকু চিনি রয়েছে।
এছাড়া বর্তমানে বাজারে কিছু কোল্ড ড্রিংস পাওয়া যায় যেগুলো সম্পূর্ণ সুগার ফ্রি। অর্থাৎ সুগার ফ্রি কোল্ড ড্রিংসগুলোতে চিনি ব্যবহার করা হয় না।
চিনির উপকারিতা
চিনির অনেক অপকারিতা থাকলেও কিছু উপকারিতাও রয়েছে। যেহেতু চিনিতে রয়েছে গ্লুকোজ, যা আমাদের শরীরে খুব দ্রুতই শক্তির উৎপাদন করতে সক্ষম। তাই চিনি আমাদের অবসাদ বা ক্লান্তি দ্রুত দূর করতে সক্ষম।
আবার চিনি আমাদের ত্বকের জন্য উপকারী। চিনি খেলে আমাদের ত্বক আরো মসৃণ ও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
প্রাথমিক চিকিৎসাতেও চিনির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। আমাদের শরীরে কোনো স্থান যদি কেটে যায় এবং রক্ত বের হতে থাকে তবে প্রাথমিক চিকিৎসার প্রথম ধাপ হচ্ছে রক্তক্ষরণ দ্রুত সম্ভব বন্ধ করা।
যদি হাতের কাছে কোনো ব্যান্ডেজ না পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে চিনি হতে পারে উত্তম এন্টিসেপটিক। কাঁটা স্থানে চিনি লাগালে খুব দ্রুতই রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়।
চিনির ক্ষতিকর দিক
এবার আলোচনা করা যাক চিনির ক্ষতিকর দিক নিয়ে। চিনির উপকারিতা নিয়ে জানলেও বর্তমানে আমরা অনেকেই চিনির ক্ষতিকর দিক নিয়ে খুব সামান্য হলেও ধারণা রাখি।
চিনি নিয়ে বেশিরভাগ স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের সবচেয়ে বড় ভয় হচ্ছে ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যেখানে মানুষের ইনসুলিন নামক হরমোন উৎপাদন হয় না।
ইনসুলিন আমাদের শরীরে গ্লুকোজ ভাঙতে সাহায্য করে। কিন্তু ইনসুলিনের অভাবে আমাদের শরীরের রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বিশাল হারে বৃদ্ধি পায়। ডায়াবেটিস একটি স্থায়ী রোগ, একবার এরোগে আক্রান্ত হলে সারা জীবন বয়ে চলতে হয়।
তবে বেশি চিনি খাওয়া খেলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে আমাদের কিডনি ও লিভারকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা চিনিকে কিডনি রোগের জন্য অনেকটাই দায়ী করে থাকেন।
বিশেষ করে সফট ড্রিংকস পালন পান করার ফলে কিডনি ও লিভারের প্রচুর চাপ পড়ে। যারা নিয়মিত সফট ড্রিঙ্কস পান করেন তাদের কিডনি ও লিভারজনিত রোগ হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
চিনি খাওয়ার আরেকটি অপকারিতা হচ্ছে চিনি মানুষের ক্ষুধা বাড়ায়। অল্প একটু চিনি খেলে আমাদের ক্ষুদা বেড়ে যায় এবং আমরা বেশি করে খাবার খেতে থাকি। বেশি খাবার খেলে আমার মানুষ স্থূলতায় ভুগতে পারি। স্থুলতাও একটি মারাত্মক রোগ। যার ফলে হৃদরোগের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
আখের চিনি খাওয়ার উপকারিতা
আমরা যে সাদা চিনি খেয়ে থাকি তা আখ থেকে প্রস্তুত করা হয়। আখের রসকে প্রথমে ছেঁকে নিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে সাদা চিনি তৈরি করা হয়। এই সাদা চিনিতে গ্লুকোজ ছাড়া আর কোনো পুষ্টি উপাদান থাকে না।
কিন্তু আখ থেকে পাওয়া অপরিশোধিত চিনি লাল চিনি নামে পরিচিত। দেখতে কিছুটা লাল হওয়ার কানে এই অপরিশোধিত চিনিকে লাল চিনি বলা হয়। সাদা চিনির কোনো পুষ্টিগুণ না থাকলেও লাল চিনিতে রয়েছে অনেক উপকারিতা।
লাল চিনিতে গ্লুকোজের পাশাপাশি পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, বিভিন্ন খনিজ, উপকারী এনজাইম ইত্যাদি বিদ্যমান। যা খেলে আমাদের শরীরের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় উপাদানের অভাবে পূরণ হয়।
লাল চিনির উপকারিতা থাকায় চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা সাদা চিনি পরিবর্তে লাল চিনি খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। মজার ব্যাপার হলো, সাদা চিনির চেয়ে লাল চিনির দাম তুলনামূলক কম।
এছাড়া বর্তমানে যেকোনো মুদির দোকানে লাল চিনি পাওয়া যায়। এছাড়া লাল চিনির উপকারিতা যেমন রয়েছে, তেমনই গুড়ের উপকারিতাও রয়েছে।
সাধারণত আমরা আখ কিংবা খেজুর থেকে গুড় উৎপাদন করে থাকি। গ্রামে গঞ্জে গুড় দিয়ে নানা রকম মিষ্টি পিঠা তৈরি করা হয়। এই গুড়েও রয়েছে প্রোটিন, ভিটামিন, বিভিন্ন খনিজ পদার্থ, গ্লুকোজ, এনজাইম ইত্যাদি। সাদা চিনির বিকল্প হিসেবে লালচিনি ও গুড়কে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে দেওয়া উচিত।
ত্বকের যত্নে চিনির উপকারিতা
চিনির অনেক উপকারিতা থাকলেও প্রায় সবাই এটা মেনে নিয়েছেন যে ত্বকের যত্নে চিনির উপকারিতা রয়েছে। চিনি খেলে ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায় এবং মসৃণতা রক্ষা পায়।
তবে শুধু চিনি খেলেই যে ত্বকের উপকার হয় তা নয়। শরীরের ত্বকের কোনো অংশ চিনি দিয়ে ঘষলে ত্বকের ময়লা খুব দ্রুত উঠে যায়। চিনি এক প্রকার শোষণকারী পদার্থ, যা ত্বকে ঘষলে তেল, পানি বা ময়লা খুব দ্রুত শুষে নেয়।
চিনির উপকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ও উত্তর
প্রশ্ন: কাবাব চিনির উপকারিতা কি কি?
উত্তর: কাবাব চিনি কিন্তু আবার চিনির কোনো রুপভেদ নয়। বরং এটি গোল মরিচের মতো ক্ষুদ্র একটি গুল্মের অংশ। গোল মরিচের মতো কাবাব চিনিও ঔষধি গুণসম্পন্ন।
কাবাব চিনি যদিও মিষ্টি জাতীয় জিনিস নয়, তবে এটি খেলে জীবনশক্তি বৃদ্ধি পায়। পেট ও পাকস্থলী পরিষ্কার করে, মাথাব্যথা দূর করে এবং আরো অনেক উপকারে আসে।
প্রশ্ন: সাদা চিনির কি কোন উপকারিতা আছে?
উত্তর: না, সাদা চিনির উপকারিতা বলতে কিছুই নেই। পুষ্টি বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন চিনি এমন একটি খাদ্য যার কোন খাদ্যগুণ নেই। বরং চিনি খেলে আমাদের শরীরের অপকারিতাই বেশি।
চিনিতে রয়েছে গ্লুকোজ, যা আমাদের শরীর কোনো কাজে লাগাতে পারে না। অপরদিকে বিভিন্ন মিষ্টি জাতীয় ফল মূলে থাকা ফ্রুক্টোজ নামক চিনি আমাদের শরীরের জন্য উপকারী। এছাড়া লাল চিনি বা গুড় খেয়ে আমরা কিন্তু চিনির চাহিদা পূরণ করতে পারি।
প্রশ্ন: চিনি কখন শরীরের জন্য বিপজ্জনক?
উত্তর: মাত্র অতিরিক্ত চিনি খাওয়া বিপদজনক। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, আমাদের শরীরে প্রতিদিন ৪০ হতে ৫০ মিলিগ্রাম চিনি নিরাপদ। কিন্তু কোনো ব্যক্তি যদি এর চেয়ে বেশি পরিমাণ চিনি প্রতিনিয়তই গ্রহণ করতে থাকে সেক্ষেত্রে আমাদের শরীরে চিনির বিরূপ প্রভাব দেখা দিতে পারে।
বেশি চিনি খেলে ডায়াবেটিসের মতো রোগ হতে পারে। ডায়াবেটিস একটি ভয়ঙ্কর রোগ। একবার ডাইবেটিস হয়ে গেলে তা সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। তাই আমাদের মিষ্টি জাতীয় খাদ্য গ্রহণে সতর্ক হওয়া উচিত।
বিশেষ করে বিভিন্ন প্রকার কোলড্রিংস পান করা এখনই ছেড়ে দেওয়া উচিত। কারণ সবচেয়ে বেশি চিনি এই কোল্ড্রিংসগুলোতেই ব্যবহার করা হয়।
প্রশ্ন: ১৫ দিন চিনি খাওয়া বন্ধ করলে কি হবে?
উত্তর: টানা ১৫ দিন চিনি খাওয়া বন্ধ করলে শুরুতে কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে না। যদিও এতদিন মিষ্টি জাতীয় খাবার ছাড়া থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু বিভিন্ন ফলমূল খেয়ে চিনির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
কিন্তু বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন একেবারে চিনি খাওয়া পরিত্যাগ করা মোটে উচিত নয়। এক্ষেত্রে শরীরে নানা রকম উপসর্গ দেখা দিতে পারে। উপসর্গগুলোর মধ্যে একটি উপসর্গ হচ্ছে আমাদের নখ ক্রমেই নীল হয়ে যাওয়া।
যদি এমন কোন উপসর্গ দেখা দেয় তবে আমাদের উচিত কিছুটা চিনি গ্রহণ করা। এমনকি ডাক্তারেরা ডায়াবেটিস রোগীদেরও মাঝে মাঝে অল্প পরিমাণে চিনি খেতে পরামর্শ দেন।
চিনির উপকারিতা ও অপকারিতা লেখাটির মতো আমাদের ওয়েবসাইটে আরো কিছু স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক আর্টিকেল রয়েছে। যেগুলো অবশ্যই পড়ে দেখতে পারেন–
চিনি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারলাম, ধন্যবাদ।