অপেক্ষা। পর্ব-১৪। সুমাইয়া আক্তার বৃষ্টি

0

 

আলাউদ্দিন আলোদের বারান্দার গেটের কাছে দাঁড়িয়ে একনাগাড়ে জহির রায়হানকে ডেকে চলেছেন। এদিকে আলো বিছানার এক প্রান্তে ভীতিগ্রস্ত হয়ে বসে আছে। হাত-পা মৃদু বেগে কাঁপছে আলোর। এবার কি হবে সেটাই ভাবছে। সবথেকে বেশি যেটা পীড়া দিচ্ছে সেটা জহির রায়হানের কথা ভেবে।

কারন রাতের আঁধারে অবিবাহিত ছেলে-মেয়ে দেখা করেছে মানেই তো অনেক কিছুই। যতোই তারা সীমা অতিক্রম না করুক, সমাজের চোখে যে এ ঘোর অন্যায়। এতে যে সম্মানহানি হবে। আর কি করেই বা মুখ দেখাবে আলো নিজের বাবাকে? এসব ভেবে চলেছে আলো। একসময় কাঁদতেও আরম্ভ করলো।

তাফীফ শেষবারের মতো একবার চেষ্টা করার জন্য বললো,”দাদু এনতে চলেন। আমরা অন্যহানে গিয়া একটু শান্তিতে বইসা কথা কই। দাদু এতো রাতে কোনো শোরগোল কইরেন না। আমরা খারাপ কিছু তো করি নাই। দেখছেনই তো চলেন দাদু।”

আলাউদ্দিন তাফীফের প্রতিউত্তর করলেন না। শুধু জগুকে বললেন,”জগু যা তো, ওই বাহাদুররে ডাইকা আন।”

জগু তাফীফের দিকে তর্জনী আঙুল দেখিয়ে শাসিয়ে চলে গেলো বাহাদুর মিয়াকে ডাকতে। আলাউদ্দিন আবার ডাকতে লাগলেন জহির রায়হানকে। একসময় জহির রায়হান বেড়িয়ে এলেন নিজ শয়নগৃহ থেকে। এতো রাতে তাফীফ ও আলাউদ্দিনকে দেখে উনার মনে অজানা এক ভয় হানা দিলো। উনি বেশ বুঝতে পারছেন বিরাট এক ঝামেলা বেঁধেছে। এখন ঝামেলাটা কি সেটাই দেখার পালা। তবে উনি হয়তো কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছেন ব্যাপারটা।

“আসসালামু আলাইকুম চাচা। এতো রাতে আমার বাড়িতে যে? কোনো সমস্যা হয়েছে কি?”

“সমস্যার কথা কউ তুমি? তোমার মাইয়া আর এই পোলায় যে কি কি কইরা বেড়াইতাছে খবর রাহো?”

“মাফ করবেন চাচা। অনুগ্রহ করে যদি ব্যাপারটা একটু খুলে বলতেন!”

“রাইতের অন্ধকারে তোমার মাইয়া এই পোলার লগে দেহা করে জানো তুমি?”

আলাউদ্দিনের কথার প্রতিবাদ করলো তাফীফ।

“দাদু কুতুব চাচার মতো কথা কইতাছেন কেন? আমি আলোর লগে দেহা করতে আয়ছিলাম। জানালার বাহির থেইকা ওর লগে একটু কথা কইছি এইটুকুই। আমিও বুঝছি এইডা ঠিক না। তোয় আমরা খারাপ কিছুও করি নাই যে আপনে ব্যাপারটা নিয়া এতো শোরগোল করবেন। ব্যাপারটা কাইলকা দিনের বেলাতেও সমাধান করা যাইতো।”

তাফীফের কথায় আলাউদ্দীন তেতে উঠলেন।

“এই তোরে কিছু কইতে কইছি আমি? তোর রায় হুনতে চাইছি? আমার তো এহন মনে হইতাছে কুতুব যা কইছে তাই সত্যি আছিলো।”

তাফীফ প্রতিউত্তর করার আগেই জহির রায়হান তাফীফকে ইশারায় থামিয়ে দিয়ে শান্তস্বরে বললেন,”চাচা আমি মানছি ছেলে-মেয়েরা ভুল করেছে। ওরা যেনো ভবিষ্যতে এমন কিছু না করে সেদিকটায় আমি খেয়াল রাখবো।”

“তোমাগো খেয়াল রাহার নমুনা তো দেখলামই। কয়দিন আগেই ওগোরে নিয়া এতো কিছু হইলো এহন আবার ওরা রাইতের আন্ধারে এই কান্ড করে। ওরা যে আরো বেশি কিছু করবো না বা করে নাই এইডার পরমান কি? আর আইজকা ওগো বিচার না হইলে পরে গেরামের বাকি পোলা মাইয়াও সাহস পাইয়া যাইবো। আর এই গেরামে আমি এইসব সহ্য করমু না।”

এই রাতের বেলা শোরগোলের শব্দে আশেপাশের অনেকে নিজের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসেছে কি ঘটেছে সেটাই দেখতে । এর’ই মাঝে বাহাদুর মিয়াও এখানে উপস্হিত হলেন। ঘেমে একাকার উনার অবস্থা। আসার পথে এভাবে তলবের কারন জগুর কাছে শুনেছেন উনি। তা নিয়ে উনি বেশ চিন্তিত।

বাহাদুর মিয়াকে দেখে আলাউদ্দিন আবার বলতে লাগলেন,”এই যে বাহাদুর আহো আহো, তা পোলায় রাত বিরাতে ঘরে না থাইকা কি করে না করে খুঁজ খবর রাহো কিছু?”

“চাচা সবটাই জগুর কাছে হুনছি। তোয় এই রাইতে এইসব নিয়ে কথা না বইলা কালকে দিনের আলোতে একটা ফয়সালা করলে ভালা হয় না?”

“সবকিছু সময়েরটা সময়েই করা লাগে। এইডা তোমাগো বুঝা উচিত। জহির যদি ঠিক সময় নিজের মাইয়ার বিয়া দিতো আর তুমি যদি ঠিক সময় তোমার পোলারে কামে লাগাইতা তাইলে এইদিন দেহা লাগতো না।”

বাহাদুর মিয়া ও জহির রায়হান দুজনেই চিন্তা করছেন কিভাবে ব্যাপারটা সামাল দিবেন। দুজনেরই আপাতত মাথা কাজ করছেন না। কারন কিছু একটা বলে ফেললে যদি সেটা হিতের বিপরীত হয়? তাই জহির রায়হান কিছুটা চিন্তা করে বললেন,”চাচা যা হওয়ার হয়ে গেছে। এটা তো আর আমরা পরিবর্তন করতে পারবো না। তবে ভুলটা সুধরে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারি। বা পরবর্তীতে যেনো এমন কিছু না ঘটে তার জন্য প্রদক্ষেপ নিতে পারি। তাই আমার মনে হচ্ছে আমাকে আর বাহাদুর ভাইজানকে কিছুটা সময় দেওয়া উচিত ভাবার জন্য।”

বাহাদুর মিয়াও জহির রায়হানের কথা সমর্থন করলেন।

“হ চাচা আমাগো আজকের রাতটা সময় দেন। আর আমরা কথা দিতাছি পরে আর কোনোদিন এমন হইবো না।”

আলাউদ্দিন এর ঘোর বিরোধিতা করলেন।

“তোমাগো পোলা মাইয়া যা করছে তারপরও কোন মুহে সময় চাও তোমরা? এইডা সময় দেওয়ার মতো জিনিস? তোমাগো পোলা মাইয়া পাপ করছে, পাপ।”

বাহাদুর মিয়া প্রতিত্তোরে নম্রস্বরে বললেন,”চাচা ওরা অবুঝ। বুঝতে পারে নাই। এইবারের মতো ওগোরে মাফ কইরা দেন।”

এবার তাফীফ প্রতিবাদ করলো,”কিয়ের পাপ? আমরা কি পাপ করছি? আমরা কি পলাইয়া গেছি? নাকি হাত ধইরা বইয়া আছিলাম? আমরা শুধু একটু কথাই কইছি। তাও আলো আছিলো ঘরের ভিতরে আর আমি বাইরে। এইডা পাপ কেমনে হয় ওইডাই আগে আমারে বুঝান।”

তাফীফের কথার পীঠে বাহাদুর নিয়ে ক্ষিপ্ত স্বরে বলেন,”তুই চুপ কর। আর একটা কথাও কবি না। আমরা বড়রা কথা কইতাছি না? আমাগো বুঝতে দে ব্যাপারটা।”

আলাউদ্দিন তাফীফের কথায় যেনো আরো তেতে উঠলেন।

“বাহাদুর, তোমার পোলা কতটা অসভ্য হইছে খালি এইডা দেহো। আর এই মাষ্টার! তোমার মাইয়ারে ডাকো।”

জহির রায়হান এবার হকচকিয়ে উঠলেন। কিভাবে মেয়েকে এই বিপদ থেকে বের করবেন তার রাস্তা খুজতে লাগলেন।

“চাচা আমরা বড়রা আগে ব্যাপারটা মিটমাট করি। আমার মেয়েটা বড্ড নাজুক চাচা। ও না বুঝে ভুল করে ফেলেছে।”

এর’ই মাঝে পাশের বাড়ির রহিমা খাতুন বলে উঠলেন,”ভাই আমি আফারে কতো কইরা কইছি ওগো চলাফেরা মাইনষে খারাপ নজরে দেহে। তাও যদি আপনেরে ঠিকমতো খেয়াল না রাহেন মাইয়ার উপর তাইলে তো এমন হইবোই। মাইনষে তো আর কিছু না দেইহা আন্দাজে কথা কয় না।”

রহিমা খাতুনের কথায় সবুজও তাল মিলালো। তবে তা ছিলো সম্পূর্ণ বানোয়াট।

“আমিও তো কতোদিন ওগোরে একলগে নদীর পাড়ে একলা বইয়া থাকতে দেখছি। তোয় কুমারী পোলা মাইয়া একলগে বইয়া থাকবো আর ওগোর মাঝে কিছু হইবো না এইডা কইলেই কেউ বিশ্বাস করবো?”

তাফীফ আবারো প্রতিবাদ করলো।

“সবুজ ভাই একটাও বানাইয়া কথা কইবেন না। যার যা মুহে আয়তাছে তাই কইয়া যাইতাছেন। আমাগো আপনি একলা নদীর পাড়ে দেখলেন কবে?”

আলাউদ্দিন এবার তাফীফকে ধমকে বললেন,”তুই চুপ কর। তোর রায় কেউ হুনতে চাইছে এইহানে? আকাম করার সময় ধ্যান কই ছিলো?”

“কি আকাম করছি দাদু? শুধু একটু দেহা কইরা কথাই তো কইছি।”

“রাইতের অন্ধকারে একলা একটা মাইয়ার লগে দেহার করার মানে বুঝছ তুই? আর এই মাষ্টার ডাকো তোমার মাইয়ারে। আমিও দেখবার চাই তোমার মাইয়া কত নাজুক।”

“চাচা আমার কথাটা একটু…”

জহির রায়হানকে কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই আলাউদ্দিন বললেন,”তোমারে ডাকতে কইছি তুমি ডাকো।”

আমেনা বেগম বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিজের শাড়ির আচলে মুখ গুজে নিরবে চোখের পানি ফেলছিলেন। কি হবে মেয়েটার সেটা ভেবেই উনি আতংকিত হয়ে আছেন। এদিকে মেয়ের চিন্তায় ভয়ে জহির রায়হানের বুক দুরুদুরু কাঁপছে। মেয়েকে কি করে এই সমাজের রোশানল থেকে রক্ষা করবেন তাই ভেবে চলেছেন। এই সময় উনি রোশানের অভাব বোধ করছেন। রোশান থাকলে হয়তো ব্যাপারটা সহজের সামলে নিতো। রোশানের উপর প্রগাঢ় ভরসা আছে উনার। এছাড়াও রোশান ওকালতি পড়ছে। তাই আইনের ভয় দেখিয়ে হলেও সব কিছু সামলে নিতে পারতো।

পরিশেষে না পেরে জহির রায়হান নিজের সহধর্মিণীকে ধীর কন্ঠে আলোকে আনতে বললেন।

এদিকে আলো এতোক্ষণ নিজের ঘর থেকে সবকিছুই শুনছিলো। এমনিতেই ভয়ে করুন অবস্থা হয়েছে। তারউপর এখন সবার সামনে যেতে হবে বুঝতে পেরে কান্নার বেগ খানিকটা বেড়ে গেছে। ভয়ের চোটে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। হাত-পা এখনো কাঁপছে। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রতিবারই তা বিফলে যাচ্ছে।

চলবে…..

 


Screenshot 3
বিজ্ঞাপনঃ বই কিনুন, বই পড়ুন

0

Sumaiya Akter Bristy

Author: Sumaiya Akter Bristy

❝শুভ্রচিন্তার উদ্ভব ঘটে যার কথা ভেবে সে যদি মোহ হয় দোষ বা কি তাতে?❞ ~Sumaiya Akter Bristy

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

গল্প চেয়ারম্যানের মেয়ে আফছানা খানম অথৈ

চেয়ারম্যানের মেয়ে আফছানা খানম অথৈ মেহেরপুর একটি সুন্দর গ্রাম।এই গ্রামে কিছু অদ্ভুত নিয়মকানুন চালু আছে,যা অন্যকোন গ্রামে নেই।এই গ্রামে নারীরা

গল্প মেয়েরা ও মানুষ আফছানা খানম অথৈ

গল্প মেয়েরা ও মানুষ আফছানা খানম অথৈ রানু বউ হয়ে এসেছে চার পাঁচ মাস হলো।এরই মধ্যে তার স্বামী স্কলারশিপ এর

গল্প মেয়ে সাক্ষী আফছানা খানম অথৈ

মেয়ে সাক্ষী আফছানা খানম অথৈ আবিদ হায়দার বেড়াতে এসেছে গ্রামে তার বন্ধু ফুয়াদ'র বাসায়।অবশ্য সে একা না,তার সঙ্গে আছে,বন্ধু সজল

গল্প বন্ধ্যা আফছানা খানম অথৈ

গল্প বন্ধ্যা আফছানা খানম অথৈ আলেয়া বউ হয়ে এসেছে চার বছর হলো।এখনো মা হতে পারেনি। এজন্য রীতিমতো তাকে কটু কথা

One Reply to “অপেক্ষা। পর্ব-১৪। সুমাইয়া আক্তার বৃষ্টি”

Leave a Reply